বর্ণালী সাহার ‘দ্যা নর্থ এন্ড’ উপন্যাসটি পড়বো বলে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়নি আমার দুটো কারণে। ফেসবুক মারফত নজরে আসা মাত্র মনে হয় যে, কি নামকরণে কি প্রচ্ছদে, এই উপন্যাসটি বেশ অভিনব। তদুপরি বিক্ষিপ্তভাবে নানা জায়গায় বর্ণালীর টুকরো টুকরো রচনাগুলো যা পড়া হয়েছে, তাতে করেও তার গদ্যে বেশ আস্থা স্থাপিত হয়। বর্ণালীর প্রথম উপন্যাস হিসেবে ‘দ্যা নর্থ এন্ড’কে সংগ্রহ করাকে কর্তব্য নির্ধারণে আমি তাই দ্বিধান্বিত হইনি।

অথচ মার্চের এক সন্ধ্যায়, ঘন্টা তিনেক টানা পড়ে শেষ করে ফেলবার পর, ‘দ্যা নর্থ এন্ড’ নিয়ে কিছু বলতে গিয়ে আমার ভেতরে বেশ দ্বিধা চাপে, বিক্ষিপ্ত বলে মনে হয় নিজেকে।

ক্যানো এই উপন্যাস বিক্ষিপ্ত করে তোলে পাঠককে?

কোনো উপন্যাসের ভেতর হারিয়ে যাবার আগে পাঠকের মনকে একটি কঠিন কাজ সমাধা করতে হয় আসলে, মাথার ভেতর থেকে লেখকের মূর্তি কি ভাবমূর্তিকে খুন করা। আগেও বলেছিলাম কোথাও, উপন্যাস অন্য ভাষায় কি অন্য সময়ের পটে হলে পাঠকের জন্য কাজটা তুলনামূলক ভাবে সহজ। কিন্তু পাঠক যদি হন রচয়িতার সমসাময়িক; ব্যক্তিগত মত, কৌতূহল আর সমকাল নামের দেহরক্ষীরা তখন দাপটের সাথে ঘিরে রাখে লেখকের ভাবমূর্তিকে; সেই ভাবমূর্তি খুন করে কেবল অক্ষরের শক্তি দিয়ে উপন্যাসের সৌন্দর্য্য বিচার তখন বেশ কঠিন।

বর্ণালীর উপন্যাসের ক্ষেত্রে কাজটা হয়ে দাঁড়ায় মাসুদ রানার চিরশত্রু কাপু উ-সেন’কে খুন করার মতো আরো কঠিন এক ব্যাপার। উপন্যাসের নায়িকার নাম মিলে যায় পাঠকের পরিচিত লেখিকা বর্ণালীর সাথে; উপন্যাসের আধার এমন সব জায়গা, সেইসব প্রগতি সরণি কি যমুনা ফিউচার পার্কের বাতাস শুঁকলে পাওয়া যাবে পাঠকের দৈনন্দিন অফিসযাত্রার ঘাম; আর উপন্যাসের আর্গুমেন্টসমূহ ‘জোকার’ সিনেমার মতো এমন সমকালীন, যে পাঠকের মনে হয় মাত্র ফেসবুক থেকে লগআউট করার সময় এই নিয়েই তো কয়েক শালাকে বড় বড় বাক্য বুনতে দেখলাম!

উপন্যাসে গল্প থাকে, কিন্তু গল্পের জন্যই তো উপন্যাস নয়। উপন্যাসের গল্প, অনেক ক্ষেত্রেই থাকে আসলে লেখকের চিন্তার ধারাবাহিকতা বর্ণনার স্বার্থে। ‘দ্যা নর্থ এন্ড’ ও এগিয়ে গেছে সেই পথ ধরে। বর্ণালী আর তার বন্ধু রাহাতের মাঝে একটি দিনের আলাপনই এই উপন্যাসের আশ্রয়। তাদের মাঝে কখনো কখনো নাক গলিয়েছে বর্ণালীর স্বামী শাওন, প্রেমিক ডেনিশ আর ডেনিশের সদ্য প্রয়াত দাদি রোজমেরি। রোজমেরির আগমন কি কেবল বৈশ্বিক সমস্যগুলোকে বাংলাভাষী পাঠকের কাছে নিয়ে আসার রাস্তা করে দিতেই? পাঠক খানিক সন্দিহান থাকে, যেমন সন্দিহান সে থাকে প্রথমদিকে উপন্যাসটার এলোমেলো গতি নিয়ে।

কিন্তু ধৈর্য্য ধরে খানিক এগিয়ে গেলে ওই এলোমেলো গতির মাঝে বেশ একটা আদল ধরা পড়ে আর উপন্যাসটা ভালো লাগতে থাকে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার যাত্রাপথে শাওন আর বর্ণালীর মাঝে কথোপকথনের স্মৃতিচারণে ভালো লাগার মাত্রাটাও যেন বেড়ে যায়।

এবং পাঠক মুগ্ধ হয় ঢাকার দিকে লেখকের দৃষ্টিপাতে। যে ‘শহরের পুরান সমস্ত গল্প ধানমন্ডি, মগবাজার, তল্লাবাগ, খিলগাঁও এর উপ্রে দাঁড়ায়া আছে…’, সেই একই শহরকে বর্ণনায় লেখক করে তোলেন ‘রক্ষণশীল, বোরখাবৃত মহিলাভর্তি, ইংলিশ ভার্শন আর বি-গ্রেড ইংলিশ মিডিয়াম পড়ুয়া বাচ্চাকাচ্চাওয়ালা, ঘরে ঘরে কালো ভেলভেটের উপর স্বর্ণাক্ষরে লেখা চওড়া ফ্রেমের শাহাদা ঝোলানো’ সতেরো তলা সব বিল্ডিং আর এসিরুমে বসে সাড়ে চুয়াত্তর সিনেমা দেখা নিকেতন বারিধারার। ভাষার কারিকুরিতে উপন্যাসের সমস্তটা মিলিয়ে লেখকের এই পক্ষপাত অ্যাতো সুনিপুণ হয় যে পাড়ার ফুটবলের মতো ‘পার্শিয়াল্টি’ বলে চিৎকারও মারা যায় না।

রোজমেরির অংশটাও ভালো লাগে। এমন নয় যে এই অংশে ব্যবহৃত আঙ্গিকগুলো ভারি অভিনব, জোনাথন স্যাফ্রন বা প্যাট্রিক মোদিয়ানো তো বটেই, ওপাড়ার সুবিমল মিশ্রের উপন্যাসেও তো (সুবিমল নিজে অবশ্য ওগুলোকে এন্টি-উপন্যাসই বলেন!) এই কায়দাগুলো আমরা আগে দেখেছি। কিন্তু যা অপ্রচলিত, তাকেই ভালো লাগার একটা বদভ্যাস পাঠকের থাকে, তার মনে হয় যে আঙ্গিককে আক্রমণ না করলে বাংলাদেশের উপন্যাসের মুক্তি নেই। আর শুধু আঙ্গিকই নয়, রোজমেরির আগমন যেহেতু উপন্যাসটার প্রেক্ষাপটকে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর উষ্ণতা দিয়ে গরম করে তোলে, ফলে ওই চরিত্রটির দিকে পাঠকের আসলে পক্ষপাত গড়ে ওঠে একরকমের। তবে আক্ষেপও থাকে, তার এটাও মনে হয় যে বৈশ্বিক সমস্যাগুলোর আওতা আরো বিস্তৃত হলে পরে উপন্যাসটা আরও লক্ষ্যভেদী হয়ে উঠতে পারতো।

কী সেই লক্ষ্য? বোধ করি, সেটা বহু ব্যবহৃত কিন্তু আজও পুরাতন না হওয়া আমাদের সেইসব একাকীত্ব, ধানমন্ডি কি টোকিও কি টেক্সাসের কফিশপে একাকী সকাল কাটানো সমস্ত মানুষ যা অনুধাবন করে ভেতরে।

আজকের যুগে, যখন -আঞ্চলিকতা বলো আর পরিচয় বলো- স্বাতন্ত্র্য ঢেকে রাখতে আমরা কথা বলি হিন্দিতে; যখন বোমা হামলায় আহত ইয়ামেনের শিশু নেমে এসেছে আমাদের ঘরের কম্পিউটারের পর্দায়, সংবেদনশীল মানুষ তখন নিজের অস্তিত্বের কোনো অর্থ খুঁজেই বা পাবে ক্যানো? অর্থ নেই। সদ্য খুনীতে পরিণত হওয়া জোকারের সামনে যখন প্রাণের ডরে মিনতি করে উচ্চতার জন্য দরজার খিল খুলতে অপারগ কোনো বামন, এমন একটি দৃশ্যে যখন সিনেমাহল ভরে থাকা দর্শকদের সাথে আমরাও হেসে উঠি আর আবিষ্কার করি নিজের ভেতরে লুকিয়ে থাকা হারামিকে; তখন আমাদের সেই অন্তর্গত সহনশীলতা আবিষ্কার করে একটি, মাত্র একটি পথই আসলে অবশিষ্ট আছে তার। পালানো। কিন্তু সেই কাজ সহজ নয়। মুক্তবিশ্বের প্রতিটি বদ্ধ দরজার সামনে ‘খোলিয়ে, খোলিয়ে, খোলিয়ে!’ চিৎকার করতে করতে তাই আমাদের মুখ দিয়ে কষ ছিটকায়।

এবং কোনো এক কফিশপে বসে এই লেখা শেষ করতে করতে পাঠকেরও তাই, বর্ণালীর উচ্চাভিলাষী ‘দ্যা নর্থ এন্ড’ কে ভালোই সফল লাগে, মনে হয় আজকের দুনিয়ার কফিশপ মানুষদের বেশ চেনা যাচ্ছে এখানে।

[মার্চ, ২০২০]