লেখালেখি

বইমেলা ২০২০/ কিস্তি ০২

২০২০ এর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত বইগুলো পড়া শেষে আমার এলোমেলো অনুভূতি গুছিয়ে রাখার জন্য এই সিরিজ। সম্যক আলোচনা কিছুতেই বলা যায় না এসব শব্দ সমষ্টিকে, আমার বরং মনে হয় আলোচ্য বইগুলো নিয়ে এসব কথাবার্তা পাঠের চটজলদি প্রতিক্রিয়া ছাড়া আর কিছু হতে পারেনি। তবু, আকারে ছোট বলে হোক আর পরিচিতদের সাথে তাদের লেখা নিয়ে তর্ক করার লোভে হোক; দ্রুতই পড়ে নিয়ে নিজস্ব অনুভূতি জানিয়ে রাখলাম আগ্রহীদের।

তিনটি ছোটগল্প সংকলন নিয়ে আজ রইলো সিরিজের দ্বিতীয় পর্ব (প্রথম কিস্তি এইখানে)।

জুড়িগাড়ি
জিল্লুর রহমান সোহাগের ছোটগল্প সংকলন ‘জুড়িগাড়ি’তে গল্প রয়েছে আটটি। এদের মাঝে দুয়েকটি গল্প আগেও পড়েছি ওয়েব পোর্টাল বা অন্য কোনোখানে। কিন্তু সংকলন পড়ে যেটা হয়, লেখককে নিয়ে দুয়েকটা কথা বলার স্পর্ধাটা সামগ্রিক ভাবে বাড়ে। সেই দাপটের চোটে কিছু কথা তাই বেরিয়েও পড়ে কী-বোর্ড থেকে।

সোহাগের এই সংকলনে সবচাইতে চোখে পড়া বিষয় কোনটা? লেখকের অস্থিরতা। আটটি গল্পের মাঝে ছয়টিই গড়ে উঠেছে একাকী কোনো পুরুষ (মুরাকামির মেন উইদাউট ওমেন ঘরানার)-কে কেন্দ্র করে। কিন্তু বর্ণনা ভঙ্গি, ভাষা, পাঠকের সাথে দূরত্ব; এগুলোর মাঝে কোনো সাদৃশ্য চোখে পড়ে না গল্পগুলো টানা পড়ে গেলে। মনে হয় গল্পকার এখনো তার নিজের স্বর আর ভঙ্গিটা খুঁজে পাননি যেন।

চতুর্দিক থেকে আমাদের ওপর চেপে বসা কর্তৃপক্ষের বিবিধ আরোপ করা নিয়মের প্রতি সোহাগ উদাসীন ছিলেন না। বাস্তবতাকে তুলে ধরতে তিনি প্রায়ই আশ্রয় নিয়েছেন পরাবাস্তব কোনো অলিগলিতে, সেটাকে মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্যও করতে পেরেছেন। তবে ‘উড়োপ্লেন’ গল্পটার বলার ভঙ্গি -প্রিয় এক লেখকের হাত ধরে আমাদের অনেক পাঠকের কাছেই বেশ পরিচিত তা- ভালো লাগেনি। ভালো লাগেনি একেবারে বাস্তব পরিবেশ ঘেরা ‘পেগাসাস’ গল্পটিও।

ভালো লেগেছে ‘রিইউনিয়ন’, ‘চরকামানুষ’ আর ‘অবনমনের কালে’ গল্প তিনটি। তার মাঝে ‘রিইউনিইয়ন’ গল্পের মোচড়টা অসময়প্রসূত বলে একটু একটু খচখচ থাকলেও, অন্য দুটিকে নিয়ে তেমন আক্ষেপ করতে হয় না। ‘চরকামানুষ’ একটি নিটোল ছোটোগল্পের মতো তারিয়ে তারিয়ে পড়া যায়। কিন্তু আমার কাছে  সংকলনের সেরা কাজ হয়ে রয় ‘অবনমনের কাল’। এ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রের টানাপোড়েন আর দ্বিধার পৃথিবী, ঢাকার ভোরকে নিয়ে যায় দস্তয়ভস্কির কোনো ধ্রুপদী চরিত্রের মাথার ভেতরে। এবং তখন একটু আশাও জাগে। মনে হয়, অনভ্যাসের গণ্ডি কাটিয়ে জিল্লুর রহমান সোহাগ আরেকটু সচেতন হয়ে উঠলেই এমন গল্প তার কাছে আরো পাওয়া যেতে পারে।

চাঁদগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
যে বইয়ের পাণ্ডুলিপি পড়বার সুযোগ হয়েছে আগেই, যে বইয়ের পেছনে আমার নিজেরই বাগাড়ম্বর শোভা পাচ্ছে লেখক বন্ধু কুশল ইশতিয়াকের অনুরোধে, সে বই সম্পর্কে নতুন করে আর কী বলা যায়? বিশেষত আমি নিজে যখন বইয়ের ব্যাককভারে ছাপ্পড় মেরে রেখেছি যে কুশল ইশতিয়াকের মূল কুশলতা, কেটে কেটে নেওয়া ছবির স্ন্যাপশটে গল্প বলায়?

চাঁদগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে এর চমৎকার প্রচ্ছদটির (সিপাহী রেজার করা) দিকে তাকিয়ে অনুধাবন করি, কুশল ইশতিয়াকের এই ছোটগল্প সংকলনটির আরো একটি মাত্রা আমার কাছে ধরা দেয়নি পাণ্ডুলিপি হয়ে থাকা পিডিএফে, যার নাম কল্পনা। বই আকারে পড়তে বসলে কুশলের কল্পনাশক্তির বৈচিত্র্য বেশ স্পষ্ট হয় তাই পাঠকের কাছে, এবং প্রচ্ছদটাকে তখন বেশ সাযুজ্যপূর্ণ বলে মনে হতে থাকে।

নামকরণ থেকে শুরু করে গল্পগুলোর ভেতরের কাহিনি, প্রায়ই তারা পাঠকের মনে যেন কোনো ছায়াছবির দৃশ্য আঁকে। কখনো সেই ছায়াছবিকে মনে হয় পূর্ব ইউরোপের নরম রৌদ্রস্নাত (‘একজন টাইপিস্ট’ গল্পটা যেমন), কখনো আবার মনে হয় সেটা হলিউডি কোনো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি (‘ভাঙা টেলিভিশন’)। ‘স্টেলার ডায়েরি’ গল্পটা বেশ মনে ধরেছে আমার, সেটা থেকে থেকে মনে করাচ্ছিলো প্রিয় উপন্যাস অল কোয়ায়েট অন দা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টের শুরু অংশটাকে। পছন্দ হয়েছে ‘আমার বুকে মায়ের দোয়া’ আর ‘ইনফার্নাল’ গল্প দুটোকেও।

বইয়ের গল্পগুলো ছোট, বেশ ছোট। কিন্তু সমস্যা সেটা নয়, আমার প্রিয় গল্পকার বনফুলও পেশায় কুশলের মতো চিকিৎসকও ছিলেন না শুধু, তিনিও লিখে গেছেন কুশলের মতোই পোস্টকার্ড সাইজের গল্প। কিন্তু বনফুল যেমন এগিয়ে যান ‘গল্প বলার’ রাস্তায়; কবি বলেই হয়তো, কুশলের কোশেশ বরং নিবদ্ধ থাকে ‘দৃশ্যের জন্ম’ দেওয়ায়। ফলে দু’জনের গল্পই যদিও স্বল্পদৈর্ঘ্যের, কখনো কখনো অ্যামন দৈর্ঘ্যের যে পাঠকের মনে ঠিক দাঁত বসানোর পূর্বেই সেটা শেষ হয়ে এগিয়ে যায় পরের গল্পের অনেকটা, তবুও দুজনের গল্পের অভিঘাত মনের ভেতর একইভাবে হয় না, কুশলের গল্পপাঠের ক্ষেত্রে পাঠকের মন হয়ে পড়ে অনেক বেশি বিক্ষিপ্ত। গল্পের দৈর্ঘ্য যখন একটু বড় হয়েছে, পাঠকের জন্য তখন বরং সহজ হয়েছে সেখানে প্রবেশ করা। ‘আলীর অন্তর্ধান’ বা ‘যে গল্পটি কারো বোনের নয়’ গল্প দু’টি তাই, ভালো সব ছোটগল্পের মতোই মনে আবেশ রেখে যায়।

স্ন্যাপশট তৈরি আর কল্পনার কারিগরিতে তার পারদর্শীতায় আস্থা স্থাপনের সাথে, নতুন পথে হাঁটার চেষ্টা করা কুশল ইশতিয়াকের জন্য পাঠককে জানাতে হয় শুভকামনাও। কারণ সাহিত্যের এগিয়ে যাবার ইতিহাস আসলে নতুন পথ খোঁজারই ইতিহাস।

হিম বাতাসের জীবন
পাঠক যখন এক-একটা বই পড়বার সময় ভাবতে চেষ্টা করে ক্যামন স্বতন্ত্র পরিস্থিতির মাঝ দিয়ে যেতে হয়েছে লেখককে, তখনই আসলে সেই বইকে আরো নিবিড় করে বোঝার সুযোগ তৈরি হয় তার। নাহিদ ধ্রুবর গল্প সংকলন হিম বাতাসের জীবন পড়তে গিয়ে তাই বারবার বোঝার চেষ্টা করছিলাম যে কোন ঘটনা, বা কোন পরিস্থিতি তাকে এই বিশেষ গল্পটি লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছে। পাণ্ডুলিপি পড়বার সুবাদে কোনো কোনো গল্পে সেটা অনুধাবন করতে পারায় গল্পটার স্বাদ যেন বেড়ে গেছে, গল্পকারের প্রতিও আস্থা বেড়েছে।

নাহিদ এমনিতে কবিতা ল্যাখে। পোস্টকার্ড সাইজের এক কুড়ি গল্পের এই সংকলনেও গল্পের নামকরণ থেকে শুরু করে বাক্য বয়ানেও স্পষ্ট কবিতার প্রতি তার পক্ষপাত। তা হোক, কিন্তু ছোটগল্প হিসেবে তার লেখা ক্যামন উৎরেছে এই বইতে? সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয় ভালো, বেশ ভালো।

নিজস্ব ভাষাভঙ্গির সাথে বাস্তব আর পরাবাস্তবের মিলমিশে বেশ এগিয়ে গেছে বইয়ের গল্পগুলো। প্রচুর প্রতীকের ব্যবহার আছে নাহিদের এসব গল্পে, কখনো কখনো বাকি সব মুছে ফেলে ওই প্রতীক তৈরিটাই হয়ে গেছে তার কাজ (‘পৃথিবীর শেষ চিত্র’, ‘মা কখনো মিথ্যা বলেন না’– গল্পগুলো যেমন)। প্রতীকায়নের অতিশায়ন অবশ্য কখনো কখনো ক্লান্তিকরও হয়ে পড়েছে।

নাহিদের বর্ণনা এমন, যে অনুবাদের সময় সেটা অনেকগুলো সম্ভাবনা দ্যায়। পাঠক বেছে নিতে পারে নিজ পছন্দের ব্যাখ্যা। ফলে আমার কাছে চারপাশের অস্থির সময়ের প্রতি ভেঙচি বা থাপ্পড় হয়ে ধরা পড়ে কিছু গল্প (‘কয়েকটি খণ্ডচিত্র’, ‘শোকের আয়ূ’, ‘বিপদ সংকেতে বদলে যাওয়া আয়ূরেখার গল্প’); গ্রেডিং সিস্টেমে গল্পকার একধাক্কায় অনেকটা উপরে উঠে আসেন এসব গল্পে।

এবং প্রতীক বা অস্থিরতাকে সরিয়ে নাহিদ যখন সত্যিকার অর্থেই ‘গল্প’ বলতে চান; ছোটগল্প তখন নিজ প্রকরণের সত্যিকারের সৌন্দর্য্য নিয়ে হাজির হয় পাঠকের সামনে। ‘সংসার’, ‘পাখিটির নাম ফুল’ কিংবা ‘মুমূর্ষু বৃক্ষের তীরে’ হলো এই সংকলনের সে জাতের রচনা। পাঠক হিসাবে এমন গল্পই আমি বেশি প্রত্যাশা করবো।

আর পাঠকের প্রত্যাশার কি শেষ থাকে? নাহিদ ধ্রুব বলবার আঙ্গিক ভেঙে ছোটগল্পের চেনা পথকে নতুন করে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন, পাণ্ডুলিপি পাঠ করেই এ মন্তব্য জানিয়েছিলাম তাকে। আশা করবো, মাঝপথেই ছেড়ে না দিয়ে নিজের যাত্রাকে তিনি করে তুলবেন অবিরত এবং স্পষ্ট।

[২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০]

Previous

বইমেলা ২০২০/ কিস্তি ০১

Next

কফিশপের মানুষেরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress & Theme by Anders Norén

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: