সুদূর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ফেব্রুয়ারিতে একেবারে নিজের আঙ্গিনা বানিয়ে ফেলা একুশে বইমেলা চত্বরে ব্যস্ততা আর অসুস্থতার প্রকোপে এবার যাওয়া হয়েছে বেশ কম। দিন তিনেক হবে। বই কেনার মাঝে তাই প্রথম দফায় ছিলো পরিচিতদের লেখা বইগুলোই। মেলায় কেনা বই মেলার মাঝেই পড়ে ফেলাটা গরম জিলিপি খাবার মতোই, সারতে পারলে বেশ আরাম লাগে। সেজন্যেই আকারে ছোট বলে হোক আর পরিচিতদের সাথে তাদের লেখা নিয়ে তর্ক করার লোভে হোক; কয়েকটা বই দ্রুতই পড়ে ফেললাম।

পরিচতদের বই নিয়ে আলোচনার করার ঝুঁকি থাকে। থাপ্পড়টাও মারতে হয় ললিত স্বরে, আবার প্রশংসা বিলাতে হলে বজায় রাখতে হয় আঁটোসাঁটো লাইন লেংথ। ফলে আলোচনার ওই ছকে বাঁধা এবং ভুরু কুঁচকানো পথে না হেঁটে আমি তাই এলোমেলো কথাই বলে গেলাম এখানে। আশা রাখি পডকাস্ট আর ইউটিউবারের যুগে বইমেলা ২০২০ থেকে কেনা বাকি বইগুলো নিয়েও এমন খাপছাড়া কথার ঝুলি চালু রাখতে পারবো পরের কোনো অবসরে।

অমরাবতী
এবারের বইমেলায় ব্যাগে ভরা বইগুলোর মাঝে প্রথম পড়তে বসা হলো রাসেল রায়হানের অমরাবতীকে। ক্যানো? কারণ নানা মাধ্যমে শুনতে পেয়েছিলাম রাসেলের অমরাবতী উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্র করে লেখা। ইতিহাসকে আশ্রয় করে রচিত উপন্যাসে আমার ব্যক্তিগত আগ্রহ যথেষ্টর চাইতেও বেশি। আর সেই পালে হাওয়া যুগিয়েছিলো ফেসবুকে রাসেল উক্ত উপন্যাস থেকে যে সব টুকরো অংশ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন, সেগুলোয় চোখ বুলানো। আমার সমসাময়িক একজন তরুণ হিসেবে রাসেল কীভাবে দেখলেন মুক্তিযুদ্ধকে? জানার জন্য আমি তাই মুখিয়ে ছিলাম।

অমরাবতী উপন্যাস পাঠের পরে আমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয় বিক্ষিপ্ত। ঝরঝরে, পাঠকের জন্য কোনো পরীক্ষা তৈরি না করা ভাষায় এবং ভঙ্গিতে গল্প বলে গেছেন রাসেল। ঠিক নির্দিষ্ট কোনো গল্পকে কেন্দ্রে রেখে কি এগিয়েছে এই উপন্যাস? নাহ, রাসেল বরং চেয়েছেন কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন গল্পকে মুক্তিযুদ্ধের একটা সাধারণ সুতোয় গেঁথে বয়ান এগিয়ে নিতে। কখনো পাকিস্তান জাতীয় খেলতে উন্মুখ এক ক্রিকেটার, কখনো মুক্তিযুদ্ধের সময় এক সেনানিবাসের কয়েকজন বাঙালি মেডিক্যাল সহকারী, কখনো গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করা এক যুবক; রাসেলের গল্পে উঠে আসেন এরাই।

তবে বহু নৌকায় একত্রে পা রেখে চলায় ঝুঁকি থাকে। অজস্র চরিত্র হওয়ায় যেটি হয়, অমরাবতী উপন্যাসে কোনো একটি চরিত্র যে পাঠকের মুখোমুখি ঠিক হিম্মত নিয়ে দাঁড়াতে পারে না। আবার, ঢাকা শহরটাও ঠিক যেন ৬৯’  বা ৭১’ এর প্রেক্ষাপটে বসে না। উদাহরণ টানা যায় প্রিয় গল্পকার হুমায়ূন আহমেদের, তার বর্ণনার জোরে বহু অসম্ভব অবাস্তব ঘটনার পরেও  কাহিনির বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ইচ্ছা পাঠকের হয়ে পড়তো গৌণ, সে উলটে যেতো পাতার পর পাতা। কবজির অতটা জোর দেখাতে না পারলেও রাসেল হেঁটেছেন গল্প, এবং কেবল গল্পই, বলবার পথেই। ফলে পাঠক এগিয়ে গেছে পাতার পর পাতা উলটে, আর জিতে গেছেন লেখক। পাঠক আশা করতে পারে যে রাসেল রায়হানের গল্প বলার হাতটি আরো মসৃণ হয়ে আসবে সামনে, এবং তখন তিনি পাঠককে ধ্রুপদী কোনো উপন্যাস দিতে উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠবেন।

আরিমাতানো
সাধারণভাবে গদ্য লেখকেরা হন দু’রকমের।একদল লেখেন খুব ভেবেচিন্তে। পুরো কাহিনিটাকে কাগজে বা মগজে ছকে ফেলে সাজিয়ে তবে তারা লিখতে বসেন। লিখতে বসেও লেখার বিবিধ পর্যায়ে অজস্র কাটাকুটি তারা করেন। যা তারা লেখেন, তার চাইতে পরিমাণে অনেক বেশি থাকে তাদের না লেখাটাই। এ জাতীয় লেখকের রচনা পড়তে গেলে পাঠক আনন্দ পায় জটিল একটা অঙ্ক মেলানোর। অন্যদলের লেখকেরা আবার ভারি স্বতঃস্ফূর্ত। লেখার টেবিলে তারা বসে যান যেন খেলাচ্ছলেই, এবং মূল লেখাটি দাঁড়িয়ে গেলে শুরু করেন কাটাকুটি করা। সবশেষে যখন তাদের গল্প বা উপন্যাসটা পূর্ণরুপ পায়, পান্ডুলিপির শুরুর সেই ছেলেমানুষি কিন্তু একেবারে মুছে যায় না; আর পাঠক নিজেও সেই ছেলেমানুষিতে সামিল হয়ে নিতে পারে আনন্দ।

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ দ্বিতীয় দলের লোক। ছোটগল্প সে লেখে অনেকদিন ধরেই, এবং পড়তে বসলে পাঠক সে গল্পগুলোকে তার বলে চিহ্নিতও করতে পারে। গল্পের ওপর সেই নিয়ন্ত্রণ রিশাদ অর্জন করে নিয়েছে তার নিজস্ব খামখেয়ালিপনাকে দিনের পর দিন পুষে রেখে। কিন্তু উপন্যাসের বিস্তৃত আঙিনায় এসে ছোটগল্পের সেই ঢেউয়ের জোর কি সে ধরে রাখতে পারবে? রিশাদের প্রথম উপন্যাস আরিমাতানো পড়তে বসার আগে এই শঙ্কা আমার ছিলো।

আবিষ্কার করি আরিমাতানো পড়ার পরে, কল্পনার যে উদ্ভট জগৎটি রিশাদের জ্বলন্ত সাক্ষর, উপন্যাসের জমিতেও সেটা উৎরে গেছে বেশ ভালোভাবেই।

আরিমাতানো কীসের উপন্যাস? একটা ক্যাম্পাসের রাজনীতির। কিন্তু রিশাদের বয়ানে (ছোটগল্পে, এবং উপন্যাসেও) ব্যক্তি সবসময় খুঁজে যায় তার অস্থিরতার কারণ, দিয়ে যায় নিঃসঙ্গতা নামের বেঁচে থাকার ট্যাক্স। ফলে গল্প যে কেবল রাজনীতির বয়ানেই ভারি হয়ে থাকে তা নয়, সেখানে থাকেআত্মপরিচয় নিয়ে দ্বিধায় থাকাযৌবনের কথাও।

উপন্যাসের পটভূমি আমাদের ফেলে আসা একটি দশকে কোনো একটি মেডিক্যাল কলেজ। নামচরিত্র আরিমাতানোর অতীত ঢাকা ধোঁয়াশায়, আর উত্তাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তার বদল হতে থাকে দ্রুত। নানা সময়ে চলাচলের সাথে নানা জগতেও অনায়াস যাতায়াত আমাদের গল্পের কথক। বাস্তব আর কল্পনাকে দুই কাঁধে বয়ে নিয়ে আরিমাতানো পাঠককে গল্প বলে যায় নানা টুকরো চরিত্রের সমাহারে।

কিন্তু এসবই তো গৎবাঁধা কথা। গল্পের বাইরে কী আছে আরিমাতানোর পাতায়? একবিংশ শতাব্দীর দায়ভার মাথায় রেখে ঠিক যেভাবে বাংলাদেশের উপন্যাসকে পড়তে চাইবে কোনো ভুরু কুঁচকানো পাঠক, স্বীকার করি, তার পুরো ক্ষুধা হয়তো মেটাতে পারে না এই উপন্যাস। কিন্তু সাহিত্যের ইতিহাস চিরকাল পায়ে পায়ে এগোনোর। আঙ্গিক নিয়ে রিশাদের হালকা পরীক্ষাগুলো তাই আমাদের কাছে একেবারে নতুন না হলেও, হয়তো কোথাও সেটা বসিয়ে দিতে পারে ভবিষ্যতের চিন্তার বীজ। ঔপন্যাসিক রিশাদের জন্য তাই রইলো শুভকামনা।

বা, অথবা কিংবা
মুক্তিযুদ্ধকে আশ্রয় করে লেখা আশান উজ জামানের উপন্যাস অন্যচোখে পড়া হয়েছিলো বেশ আগে, মাঝে এলোমেলো নানা জায়গায় পড়া হয়েছে তার ছোটগল্পও। দেখার চোখজোড়া শক্তিশালী, গদ্যের ভাষাটিও তৈরি; লেখক সম্পর্কে এমন একটা ধারণা আগেই তাই মনে ছিলো। তবু চমকে উঠতে হলো আশানের গল্প সংকলন বা, অথবা কিংবা পড়ার পরে। চশমা পড়া বড়ভাইয়ের ভূমিকায় নেমে তাই বলেই ফেলি, যে ছোটগল্প পড়তে ভালোবাসেন যে সব পাঠক,  তাদের জন্য এই সংকলনটি সংগ্রহ করা রীতিমতো অত্যাবশ্যাক।

এক ডজন ছোটগল্পের এই সংগ্রহে দুর্দান্ত কাজ দেখিয়েছেন আশান। কখনো আঙ্গিকে (অ্যালবাম, তন্ত্র বা কাচঠোকরা-র মতো গল্পগুলো) কখনো বিষয় নির্বাচনে (আকাশ ভেঙে মুখে দিলেই বিদঘুটে স্বাদ), কখনো আবার ছোটগল্পের চিরন্তন সেই চমক লাগানো মুহুর্ত তুলে এনে (কী আগুনে পুড়ে যায় ঘর, জানে না উঠোন) আশান আশ্বস্ত করেছেন, বাংলা ছোটগল্প এখনো জীবিত। এক একটা আঞ্চলিক সংলাপে আশান এঁকে দিয়েছেন উত্তরবঙ্গের আস্ত এক একটা মানুষ; কখনো পাগলাটে কোনো কলেজ শিক্ষক, কখনো বাংলা সিনেমার চিরকালীন খলনায়ক কোনো চেয়ারম্যান।

আমাদের চতুর্দিকে চলমান জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা যে গল্পকারের চোখ এড়োয়নি, এবং সেটাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে তিনি যে বরং নজর রেখে গেছেন সেইসব ঘটনার নানা মাত্রার অভিঘাতে; এই ব্যপারটিই সবচাইতে ভালো লাগার। সতর্কতা এই মাত্রায় উপস্থিত থাকার ফলে সামগ্রিকভাবে একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে গ্রামবাংলার একটা ছবি যেমন ফুটে ওঠে, ঠিক তেমনই রাষ্ট্র-সমাজ-কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিনিয়ত ঠাপ খেয়ে মৃয়মাণ হয়ে পড়া আমরা কোনদিকে যে আঙুল তুলবো,  তারও দিশা পাই না।

গল্পকারের সাক্ষর খানিক আলগা মনে হয় কেবল শিশু।স্বর্গ।নরক আর ফুঁ গল্পদুটির আঙ্গিক আর বয়ানেই। এক ডজনের বাকিগুলো পাঠককে এগিয়ে নিয়ে যায় জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার অনুসন্ধানে নয়, কেবল গল্পের সৌন্দর্য্যের জন্যই।

মনে রাখার মতো এই সংকলনের জন্য গল্পকার আশান উজ জামানের জন্য টুপিখোলা কুর্নিশ জানিয়েই এই সকালে শেষ করি।

[২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০]