অঞ্জন দত্তের গান প্রথম শোনার দিন না হলেও ক্ষণটা আমার মনে আছে, মনে আছে যে তখনো আমি প্রাইমারি স্কুলেই পড়ি। প্রাইমারি স্কুলে পড়বার সময় আমার ধারণা ছিলো প্রতিবছর ঈদ হয় ঠিক শীতকালে, আর সেই ঈদের জন্যে শীতের সকালে গ্রামের বাড়িতে পেছনের লাগোয়া গোসলঘরে কাঁপতে কাঁপতে গোসল করতে হয় মাথায় পানি দিয়ে। তো, সেরকমই কোনো একটা ঈদ করবার পর মামার গাড়িতে চেপে গ্রাম থেকে রওয়ানা দিয়েছি চট্টলা শহরের দিকে। মেজোমামার ভোক্সওয়াগনের জানালা দিয়ে গালে হালকা থাপ্পড় মারছে ঠান্ডা বাতাস, আমি আম্মার সামনে আধ-বসা-আর-আধেক-দাঁড়ানো অবস্থায় সামনের সিটের কাঁধ আকঁড়ে ধরে আছি, ছোট্টো কিন্তু যাত্রী পূর্ণ গাড়ির নানা আসন থেকে নানা বিষয়ে কথা বলে চলেছে বড়রা, আর এসবের মাঝে কেমন একটা গলায় কে যেন সমানে চ্যাঁচিয়ে যাচ্ছে- ‘বড় বড় বড় বড় গোল গোল চোখ, হরিপদ একজন সাদামাটা ছোটোখাটো লোক…..’

সেই যাত্রায় নয়, সেই গাড়িতেও নয়; কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ সবল মেজোমামা হঠাৎ রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বুক চেপে ধরে অন্য একটা গাড়ির ভেতরেই নিঃসঙ্গ মারা গেছেন খুলশীতে, অনেক বছর হয়ে যাবে সেই দিনেরও। মামার আগেই বিদায় নিয়েছে তার সেই ভোক্সওয়াগেন গাড়িও, কিন্তু অঞ্জন দত্ত রয়ে গেছেন আমার ল্যাপটপে, আমার ফোনের ছোট্টো প্লে-লিস্টে, আমার মন খারাপের দিনের বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে।

ফাইভ সিক্সেই ধার করা ক্যাসেট আর সামনের বিল্ডিঙের তিনতলার ভাইয়াটার জোরালো স্টেরিওর কল্যাণে মুখস্থ থাকে বেলা বোস আর বারান্দায় দাঁড়ানো রঞ্জনার গান। পত্রিকার পাতায় আম্মা দেখান ইন্টারে স্ট্যান্ড করা ছাত্রের বচন; ‘আমি দিনে সাত ঘন্টা পড়াশোনা করেছি’ আর ‘বড় হয়ে দেশের সেবা করতে চাই’ জাতীয় আজাইরা কথার মাঝে চোখ আটকে যায় অন্য কোনো লাইনে। ‘অবসরে গান শুনি- অঞ্জন দত্তের।’

নিজে ক্যাসেট কিনলাম মনে হয় ক্লাস এইটে। নিউমার্কেটের নিচতলায় ওভারব্রিজের সাথের দোকানটার নাম ‘গীতাঞ্জলি’ ছিলো মনে হয়, ঠিক খেয়াল নেই। খেয়াল আছে, দিনরাত বাজিয়ে বাজিয়ে অস্থির করে ফেলেছি বাসার সবাইকে ক্যাসেটের এপিঠ-ওপিঠ। সবচেয়ে মিষ্টি লাগে ‘তুমি না থাকলে’ গানটার গিটারে হাত বোলানো, সবচেয়ে মনখারাপ হয় শংকর হোটেলের নীলচে পাহাড়ের মেয়েটার জন্যে গাওয়া গানটা শুনলে। বুকের ভেতরে সবচেয়ে বেশি ভারী হয় ‘শুনতে কি চাও তুমি’ গানটা শুনতে গেলে। ক্যানো, কে জানে!

ক্লাস নাইনে অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত ভাবে জীবনকে অত্যন্ত অর্থহীন মনে হয়। নতুন স্কুলের নতুন বন্ধুদের সাথে একটু একটু করে জমে খাতির, আব্বাকে দিয়ে দেশের বাইরে থেকে আনাই সনি’র ওয়াকম্যান। খাতার ভেতর চ্যাপ্টা গোলাপ খুঁজে পাওয়া যায় না কিছুতেই, ফলে মাথার ভেতরে এলভিস প্রিসলিকে নিয়ে উদাস মুখে ঘুরে বেড়াই। ছুটির দিনে দুপুরবেলায় খুব মনটন খারাপ হলে ক্যালসিয়ামের গানটান বাজিয়ে সেটাকে ভালো করার চেষ্টা করি। খোঁজখবরে উঠে আসে, বন্ধু পাড়ায় সবার অবস্থা প্রায় একই রকম, ল্যাংচে হেঁটে বা ডিগবাজি দিয়ে কি ভেঙচি কেটে আজকাল নাকি কারোর’ই আর খ্যাকখ্যাকখ্যাক হাসি পায় না। এসব মুসিবতের মাঝ থেকে আঘাত আসে অন্য দিক থেকে, কোনো এক বদমাশ স্কুলের ব্যাগ থেকে চুরি করে নিয়ে যায় আমার সাধের ওয়াকম্যান।

সেই ওয়াকম্যান; যে চিনিয়েছে মালা, মেরি অ্যান, সঙ্গীতা আর ঢাকা-১২১৫ এর জয়িতাকে। এক একটা বাসস্টপে কোনো মেয়েকে একা উঠতে দেখলেই আমি আবিষ্কার করি ভীষণভাবে চেনা মৌলালির মোড়টাকে, ফেলুদার সাথে গোরস্তানে সাবধান পড়তে গিয়ে আর্কাস সাহিব-মার্কাস সাহিবের সময় মনে পড়ে অ্যাংলো পরিবারের নোনা দেয়াল থেকে ঝোলানো মলিন যিশুর কথা, সৌরভ গাঙ্গুলির পোস্টার ঝোলানো আর রিকি মার্টিনকে চিঠি লিখে যাওয়া অচেনা কোনো সঙ্গীতার সাথে হাফ চকলেট খেতে না পারার দুঃখে বিষাদ আরো বাড়ে। এলোমেলো কত সব, অন্য লোকের গানে অঞ্জন আমাদেরকেই খুঁজে ন্যান তার পুরোনো গীটারে।

নটরডেমের করিডোরে গেলে দুনিয়া বদলায় ম্যান। ডিজুসের রাত জেগে কনফারেন্স মাত্র চালু হয়েছে সে সময়, সাইন্স ফেয়ারের দিন গোণে ছেলেরা, অথচ অঞ্জন দত্ত অটুট ইস্টার্ন প্লাজার পাশে বিগ বাইটের মতন। সত্যজিতের ছবি দেখতে বসে আধুনিক সিনেমায় দুষ্টু গানের প্রভাব ধরে হাসাহাসি চলে, ঘুরেফিরে সাত দিন দাশবাবুর ওই কেবিনের মতোই ছেলেপিলে খুঁজে বের করে বহু ফাস্টফুড শপ, প্রচুর জায়গা আমাদের চারশো বছরের পুরোনো এই ঢাকায়।

ঢাকার বুকেও পরিবর্তন আসছে, টের পাই। নর্থ সার্কুলার রোডের বাড়িগুলো ভেঙ্গে নতুন সব অ্যাপার্টমেন্ট গজায়। রিকশায় পাশ দিয়ে যেতে যেতে টের পাই এরকম কোন বাড়িতেই হয়তো বেহালার মাস্টার জেরেমি না হলেও শহীদুল জহিরের বান্দরের দুধ খাওয়া পোলা চানমিয়া আর জুলি ফ্লোরেন্সের ছায়া পড়ে আছে। ঢাকাও বদলাচ্ছে, এখানে, এই ভূতের গলিতে আজ বখাটে ছোকরার ঠাট্টা তামাশা করার জায়গা নেই। সাট্টা কি অন্য কিছুর নেশা দেখতে চাইলে চলে যাও সেই এজিবি কলোনী বা ধরো আরেকটু দূরের সেই মুগদা, কমলাপুরে। তবু, নিয়ত পরিবর্তনশীল ঢাকার বুকেও বহ কিছু মিলে যায়। টার্ম ব্রেকের মাঝের সময়ে রাত জেগে হাঁটাহাঁটির সময়ে বিমলাদের চোখে পড়ে, কলাবাগানের জামে আটকে থাকা সময় দেখা যায় ডিজেলের ধোঁয়া অগ্রাহ্য করা টোকাই, নজর সরতে চায় না আজিমপুর কলোনীতে দুপুর বেলা বেহালা বাজিয়ে আসা লোকটাকে দেখকে। ক্যানো সব এভাবে মিলে যায়? কীভাবে সব মিলে যায়?

পাগল করা সুর নেই গানে, গায়কীটাকেও চেষ্টা করে ‘চলনসই’ এর ওপরে তোলা যায় না, তবু অঞ্জন একরকমের ইন্দ্রজালে মাতিয়ে রাখেন আমাকে, আমাদের কয়েকজনকে। দীপ্তের সাথে হঠাৎ হেঁটে টিএসসি বিকেলেও লোকটা পিছু ছাড়ে নাম জয়িতার সবুজ রঙা সালোয়ারে ছোট হয়ে আসে বিকেল। ফাঁকা ক্যাম্পাসের ড়্যাগ কর্ণারে ২৪৪১১৩৯ এর সুরে সিগারেটের ধোঁয়া ঘন হয়ে উপরে উঠতে থাকে। একদিন রিকশার মাঝে বৃষ্টিতে হঠাৎ কারো কাছে ধরা পর্যন্ত পড়ে যাই।

মাসের শেষে নয়, এখন কান্না পায় প্রায় প্রত্যেকটা দিনই। নিয়ন আলো এলোমেলো করে ধর্মতলার মোড়ে ফিরে আসতে নয়, অ্যালবার্ট জুতোর মতো দিনের পর দিন ক্ষয়ে আসে আমাদের স্বপ্ন, কোনো রাজা রায়ের মতোই। ঘড়ির এলার্ম আর পাঞ্চ কার্ডের ব্যাকরণে সকালটা এখন আজ আর মিষ্টি বলে বোধ হয় না। সকালের রোদে ওম খুঁজে খুঁজে অফিস যাবার কালে রিকশার চাকা ঘোরে,আর আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে আসে মিস্টার হলের কণ্ঠ। কিন্তু নিজের ডেস্কে গিয়ে বসলে জোনাথন ডে, নান্দীকার আর কমপ্ল্যান খাওয়া বালকের দল এমন দলাদলা বা গুঁড়োগুড়ো হয়ে এমন অবস্থায় যায় যে সেগুলোর অন্তর্ধান রহস্য সমাধানে শার্লক কাম্বারব্যাচের আরো দুটো সিজন আস্ত লাগবে। এইসব কিউবে বসতে নিজেরই এমন অস্বস্তি, অঞ্জনকে আর জায়গা দেবো কোথায়? ফলে চলে যায় আরো একটা দিন।

তবু, যখন ফেসবুকের উত্তাল হোমপেজের যাবতীয় রঙিন পিক্সেল চোখের মাঝে দুলতে থাকে ববি রায়ের জানালার আলো হয়ে, আর কিছু টাকা জমানোর আশ্চর্য সরল স্বপ্ন নিয়ে অপেক্ষমান কোনো থানার দারোয়ানের সাথে জীবন বদলাতে যখন লোভ হয় ধানমন্ডি কোনো এস্থেটিক কফির কাপে, যখন কানের মাঝে ‘ইশ, এইভাবে কেউ চলে যায়!’ ফিসফিস করে ওঠে কেউ; তখন আমি আজও ফেরত যাই অঞ্জন অরণ্যে।

কতকিছু পালটে গেছে। মেজোমামা নেই, হুমায়ূন আহমেদ নেই, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট নেই। চোট্টা আম্পায়ার নিয়ে আজিমপুরের শীতের ছুটির টেস্ট ম্যাচ হারিয়ে গেছে, পৃথিবী বদলে দেয়ার স্বপ্নের মতোই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় স্বপ্নের মতোই। কিন্তু অঞ্জন দত্ত থেকে গেছেন দেবলীনা, ঘুমের ঘোরে কোথাও ফিরে যাওয়া মালা আর ঝগড়াঝাঁটির গান নিয়ে। অনুভব করি এই শহরেরই অন্য কোথাও কেউ একজন গভীর আবেগে শুনছে চ্যাপ্টা গোলাপের গান, তাল কেটে যাচ্ছে সদ্য গীটার বাজাতে শেখা ছেলেটার। হয়তো কেটে যাচ্ছে তার আঙুল, ঠিক দেখতে দেখতে কেটে যাওয়া আরো একটা দিনের মতোই।

বেঁচে থাকার জন্য পৃথিবীর সমান প্রাচীন একটা পুরোনো দুঃখে জর্জরিত এই অসময়ে; যখন চারটা ঠোঁটের ভালোবাসার বদলে চারিপাশে আজ কেবল উঠে আসে হ্যাশট্যাগ মি’টু, যখন কেরালার আকাশ নীল নয় আর, বরং লাল হয়ে থাকে মিছিলে নামা মানুষের লোহিতে, পডকাস্ট আর ইউটিউবের দুনিয়ায় যখন উপন্যাসের টেবিলে শব্দের খোঁজে নেমে প্রতিটি দিন নিজেকে মনে হয় গলা বসে যাওয়া কোনো এক সিনাত্রা; অঞ্জন দত্তকে তখনো মনে হয় একটা জানালার মতো। সেই জানালায় বিকেলের রং হেমন্তে হলুদ, সেই জানালায় পাশের বাড়ির কান্না শোনা যায়, সেই জানালা দিয়ে কলকাতার আকাশকে দেখা যায় ঠিক তেমন তীব্র ভালোবাসায়, যেমন করে সুহান ভালোবাসে ঢাকাকে।

মন খারাপের মেঘের মাঝে অঞ্জন দত্ত তাই, একটা আকাশ দেখার জানালা। আমার নিজের জানালা-মানুষ।

[জানুয়ারি ২০২০]