(১)
ফিওদর দস্তয়েভস্কির সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাসটি, সম্ভবতঃ ‘অপরাধ ও শাস্তি’। আগ্রহী পাঠকের স্মরণ হয়, গোয়েন্দা কাহিনির গতিতে এগিয়ে চলা সেই উপন্যাসে তারা প্রত্যক্ষ করেছে রাস্কলনিকোভের প্রবল যুক্তিবাদী চরিত্রের টানাপোড়েন, দহনে পুড়তে পুড়তে যুক্তির সিঁড়ি ভাঙা শেষে যে মানুষটা আবিষ্কার করেছে জীবন কোনো অংক নয়, তত্ত্ব দিয়ে তাকে ব্যাখ্যা করা যায় না কিছুতেই। তো, সেই দস্তয়েভস্কিরই আরেক উপন্যাস দা ডেমনস পড়তে গিয়ে রাস্কলনিকোভকে কখনো কখনো স্মরণ হবার কারণ হচ্ছে, এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র পিওতর স্তেপানোভিচের সাথেও কিছু কিছু জায়গায় সাদৃশ্য রয়েছে রয়েছে।
স্বীকার করি, সেই সাদৃশ্য আবিষ্কার করার আগেই দা ডেমনস উপন্যাসের সাথে আমার পরিচয় ঘটে যায় দুটি ভিন্ন রাস্তায়। প্রথম রাস্তাটির অবস্থান জে এম কোয়েটজি’র ‘দা মাস্টার অফ পিটার্সবার্গ’ উপন্যাসে। আঠারোশো উনসত্তরের এক শীতে সৎ পুত্র পাভেলের রহস্যময় মৃত্যুতে দস্তয়েভস্কি সেন্ট পিটার্সবার্গে ফিরে এসেছেন ইউরোপ থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন শেষ করে, এমন এক কাল্পনিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে এগিয়েছে কোয়েটজির উপন্যাসটির কাহিনি। সেই আখ্যানে দস্তয়েভস্কি মুখোমুখি হন ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে থাকা সের্গেই নাচায়েভ নামের এক নিহিলিস্টের সাথে, আর উপন্যাসটির শেষ পাতায় দস্তয়েভস্কি শুরু করেন ‘দা ডেমনস’ উপন্যাস লেখার কাজ। দা ডেমনস উপন্যাসের সাথে আমার দ্বিতীয় সাক্ষাৎ ঘটে প্রিয় ঔপন্যাসিক অরহান পামুকের এক আলোচনায়। দেখতে পাই, পামুক সেখানে দস্তয়েভস্কির এই উপন্যাসকে আখ্যা দিচ্ছেন সর্বকালের সেরা রাজনৈতিক উপন্যাস বলে।
পড়তে বসার আগেই এই দুই মোলাকাতের ফলে যেটা হয়, দা ডেমনস নিয়ে একটা আবহ তৈরি হতে থাকে পাঠকের মনের ভেতর। সে প্রস্তুত হতে থাকে তীব্র রাজনৈতিক ঘরানার একটা উপন্যাস পড়ার জন্য। আমরা জানি যে সকল উপন্যাসই আসলে রাজনৈতিক, যেখানে রাজনীতির অর্থ দ্বিতীয় কারো দৃষ্টি থেকে কোনো বিষয়কে বুঝতে চাওয়া। তবু, কোয়েটজির দেয়া ইঙ্গিতে তাড়িত হয়েই হোক, বা পামুকের বিশ্বাসে আস্থা স্থাপন করেই হোক, পাঠকের মন উৎসুক হয়ে থাকে জানতে, ঠিক কোন ধরনের রাজনীতিক উপন্যাস দা ডেমনস? ক্যামন ধরনের রাজনীতির মারপ্যাঁচে কাউকে আখ্যা দেয়া যায় ‘দানব’ বলে?
(২)
দা ডেমনস উপন্যাসের রাজনীতির ভেতরের দিকে ঢুকে সেটার সাথে পরিচিত হতে গেলে একটু মনে হয় দেখে নেওয়া দরকার দস্তয়েভস্কির সমকালের রাজনীতির দিকে।
১৮৬১ সালে দ্বিতীয় জার যখন পাশ করেন দাস মুক্তির আইন, রাশান সমাজে তখন ভালোই বাড়ে সামাজিক অস্থিতিশীলতা। প্রকৃতপক্ষে, রাশিয়া আসলে দ্বিধাবিভক্ত হতে শুরু করেছে আরো বছর বিশেক আগে থেকেই। সামাজিক এই বিভক্তির একদিকে আছে স্লাভোফাইলরা (যারা রাশিয়ান জাতিসত্ত্বা এবং রাশান অর্থোডক্স চার্চে বিশ্বাসী), অন্যদিকে আছে ইউরোপকে অনুসরণ করতে চাওয়া লোকজন; বেলিনস্কি, হারজেন, চাড্ডায়েভ, গ্রানোভস্কির মতো বুদ্ধিজীবীরা যাদের মাঝে অগ্রগণ্য। উনবিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে শুরু হওয়া এই টানাটানির খেলায়, দস্তয়েভস্কি একটা মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে চেয়েছিলেন যৌবনের অনেকটা সময়। তবে ষাটের দশকে এসে, দাস মুক্তির আইনের মতো আরো অনেক ঢেউ এসে যখন নিয়ত পালটে দিচ্ছে রাশানদের সামাজিক জগত, মধ্যপন্থার সেই জায়গায় তখন পায়ের তলায় মাটি রাখা সম্ভব হয় না। নিকোলাই চেরনিশভস্কি আর ইভান তুর্গেনেভের মতো লেখকেরা তখন ঝুঁকে পড়েন ইউরোপের দিকে, নিহিলিস্ট শব্দটারও জন্ম দ্যান তারা। কিন্তু দস্তয়েভস্কি, তখন আরো পরিণত তিনি, অবস্থান নেন ইউরোপের ছায়াহীন রাশিয়ান জাতিসত্ত্বার বিকাশের পক্ষে।
আগ্রহী পাঠকের স্মরণ থাকতে পারে, আরো অর্ধযুগ আগেই চেরনিশভস্কির ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান?’ নামের উপন্যাসটির জবাবে নিজের ভাবনাকে দস্তয়েভস্কি প্রকাশ করেছিলেন ‘নোটস ফ্রম দা আন্ডারগ্রাউন্ড’ নামের উপন্যাসিকায়। সেই চেরনিশেভস্কি, যিনি তার উপন্যাসে দেখতা চেয়েছিলেন জার রাজতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে কী করে শিল্পবিপ্লবকে সাথে নিয়ে রাশিয়াকে একটা সমাজতান্ত্রিক শাসনের দিকে নিয়ে যাওয়া যায়, সেই চেরনিশেভস্কি, লোকে বলে যিনি কার্ল মার্ক্সের চাইতেও বেশি প্রভাবিত করেছিলেন লেনিনকে; সেই নিহিলিস্ট চেরনিশেভস্কি’র বিপরীতে কলম ধরতে দস্তয়েভস্কি দ্বিধা করেননি একটুও। এবং ১৮৭১ সালে দস্তয়েভস্কি যখন আবারো উপন্যাসের পাতায় হাত দিলেন, এবার তিনি কাটাছেঁড়া করতে চাইলেন আরেকটু পপুলিস্ট ঘরানার এক নিহিলিস্ট (বস্তুবাদী র্যাডিক্যাল বলেও যারা পরিচিত ইতিহাসে) এর বিপক্ষে, যার নাম সের্গেই নাচায়েভ।
কে এই নাচায়েভ?
ইতিহাসের পাতায় নাচায়েভ পরিচিত নিহিলিস্ট এক দলের চাঁই হিসেবে, গোপন লিফলেটে এই র্যা ডিক্যাল দল প্রচারণা করে বেড়াতো ঘুণে ধরা রাশান সমাজকে ধ্বংস করতে হলে কী করণীয় আমাদের। ‘অপমানের অধিকার’ বলে আরো এক অদ্ভুত প্রোপাগান্ডা ছিলো দলটির, তারা প্রচার করতোঃ যা জনগণের জন্য নয়, সেটি ঈশ্বরের জন্যেও নয়, বরং তা শয়তানের আজ্ঞাবহ। এবং সে রকম যে কোনো কিছুকে বেইজ্জত করবার অধিকার আমাদের আছে।
নাচায়েভ তার দলের জন্য বানিয়েছিলো কুঠারযুক্ত একটি সিল, লিখেছিলো ‘বিপ্লবীর দায়িত্ব’ শিরোনামে প্রায় ২৬ অনুচ্ছেদের এক রচনা, যেখানে বলা হয়েছিলো যে একজন বিপ্লবীকে রীতিমতো উন্মাদের মতো বিপ্লবের প্রতি নিবেদিত থাকতে হবে। তা নাচায়েভের দল সত্যি উন্মাদের মতোই ছিলো। ইভান ইভানভ নামের এক ছাত্র যখন সেই দল পরিত্যাগ করতে চায়, নাচায়েভ ও তার স্যাঙ্গাতেরা তখন নৃশংস ভাবে হত্যা করে ইভানভকে। খুনের পরেই নাচায়েভ পালায় ইউরোপে, তবে তার দলের বাকিরা ধরা পড়ে এবং তাদের বিচারে তোলা হয়। কী করে বিপ্লবী তত্ত্ব বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মানুষ আর মানুষ থাকে না, ইভানভ হত্যা মামলার বিবরণ পত্রিকার পাতায় পড়তে গিয়ে সমস্ত রাশিয়া তা অনুধাবন করে বিবমিষায়।
ধাক্কা খেয়েছিলেন দস্তয়েভস্কি’ও, এবং ইভানভ হত্যাকাণ্ডকে মাথায় রেখেই তিনি লিখতে বসেন দা ডেমনস। আর এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র পিওতর স্তেপানোভিচ’কে, গড়ে তোলা হয়েছে সের্গেই নাচায়েভের আদলেই।
(৩)
পিওতর স্তেপানোভিচের সাথে রাস্কলনিকোভের চরিত্রের সাদৃশ্য কোনখানে? সাদৃশ্য এই যে দুজনেই নিজের মতো করে মানব সমাজ নিয়ে খাড়া করেছে তত্ত্ব, সে তত্ত্ব বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তারা লংঘন করেছে নৈতিকতা আর আইনের সীমানা, সোজা কথায় নিজের তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে অপরাধ করতে দ্বিধা করেনি। কিন্তু রাস্কলনিকোভের অপরাধ সীমাবদ্ধ থেকেছিলো কেবল একজোড়া খুনের মাঝেই, যার একটি আসলে ঘটনাক্রমে। অথচ পিওতর স্তেপানোভিচের তত্ত্বের বাস্তবায়নে আছে রাজনৈতিক গোলযোগ আর অস্থিরতা সৃষ্টি, অগ্নিকাণ্ড, আত্মহত্যার প্ররোচনা যোগানো আর একাধিক ঠাণ্ডা মাথার খুন। রাস্কলনিকোভের চাইতে যে স্তেপানোভিচের তত্ত্ব বাস্তবায়ন অ্যামন নৃশংসতর হয়ে উঠলো, বলাই বাহুল্য, সেটা সম্ভব করেছে আসলে বিশেষ এক অনুঘটকের উপস্থিতি, সংগঠন। রহস্যময় কোনো এক ‘উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের’ নির্দেশে, গোপন এক সংগঠনকে পরিচালিত করে পিওতর স্তেপানোভিচ ত্রাসের সঞ্চার করে ছোট্টো এক শহরে, তার উদ্দেশ্য ধ্বংসের এই আগুন সারা রাশিয়াতেই ছড়িয়ে দেওয়া।
শুধু সংগঠনের সদস্যরাই নয়, জন্য, জেনে হোক বা না জেনে, শহরের বহু লোকজনই কার্যত পিওতর স্তেপানোভিচের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করায় সহায়তা করে। ফেদকার মতো দাগী আসামী, টাকার বিনিময়ে যে কোনো ঘৃণ্য কাজ করতে যে দ্বিধা বোধ করে না, পিওতর স্তেপানোভিচের দলে যেমন তার মতো লোক আছে; ঠিক তেমনই গভর্নরের স্ত্রী ইউলিয়া মিখাইলোভনা পর্যন্ত লাই দিয়ে দিয়ে দলটিকে মাথায় তোলেন।
আবার সংগঠনের সবাই যে আবার অবিকল স্তেপানোভিচের ধ্যান ধারণা লালন করে, তাও নয়। র্যা ডিক্যাল বিপ্লবীদের বিবিধ তত্ত্ব উপস্থাপনের জন্যই বোধ করি, উপন্যাসের সংগঠনের বেশ কজন সদস্যই দস্তয়েভস্কির বর্ণনায় হয়ে উঠেছে বিশিষ্ট। বলা যায় শিগাইলভের কথা। তার তত্ত্ব অনুযায়ী দুনিয়ার সমস্ত লোককে ভাগ করা উচিৎ দুই ভাগে। এক-দশমাংশ লোকই শিক্ষা, মর্যাদা, স্বাধীনতা ভোগ করবে; বাকিরা হবে এদের অনুগত দাস কেবল, অধিকার বলতে কিছু তাদের প্রয়োজন নেই। বলতে হবে কিরিলভের কথাও, তার ধারণাটিও বেশ কৌতূহলজনক। সে বলে, মানুষ জীবনের ব্যথা-বেদনার কথা বলে কান্নাকাটি করে ঠিকই, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই বেদনা বহনের ভারবহ কাজটি সে পছন্দই করে, যে কারণে সে মরতে ভয় পায়। মৃত্যু ভয়কে জয় করতে পারলেই মানুষের পক্ষে সম্ভব ঈশ্বর হয়ে ওঠা, এই ভাবনায় অধীর কিরিলভ মৃত্যুকে ভয় না পেয়ে আত্মহত্যা করতে চায়।
এমনই সব বৈপ্লবিক মতবাদের লোকদের নিয়ে পরিস্থিতি জট পাকাতে থাকে দা ডেমনস উপন্যাসে বর্ণিত শহরটায়, আর পুতুলনাচের সুতোটা থাকে ওই পিওতর স্তেপানোভিচের কাছেই। রাস্কলনিকোভ অপরাধ করে ঠিকই, দহনে ভুগে, অনুশোচনা হয় তার, সে শাস্তি পায়। অথচ স্তেপানোভিচ আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ করলেও তা নিয়ে তার যেমন ভাবান্তর নেই, তেমনই অনুশোচনা বলেও কোনো কিছুর দেখা তার মাঝে মেলে না। মানব আর দানবের পার্থক্য কি এই অনুশোচনাতেই নয়?
পরিকল্পিত নেতৃত্ব দিয়ে গোপন সংগঠন চলতে পারে ঠিকই, কিন্তু গণমানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা (এক্ষেত্রে যেটা ভয় বা আনুগত্য) পেতে হলে দরকার সংগঠনের একজন মুখপাত্র, এইজন্য স্তেপানোভিচ চেয়ে থাকে নিকোলাই স্তাভরোগিনের দিকে। স্তাভরোগিন অমানুষিক রকম শীতল চরিত্রের, সে দুর্ব্যবহার না করলেও লোকে তাকে তীব্র অপছন্দ করে, সে সত্য উচ্চারণ করলেও লোকে বোধ করে বিবমিষা। পিওতরের সংগঠনের যা ধারা, সেটাতে জৌলুস যোগ করতে পারে এই স্তাভরোগিন। পিওতর তাই ঐ লোকটিকে ফুঁসলিয়ে টানতে চায় নিজের দলে।
নিকোলাই স্তাভরোগিন নামের চরিত্রটিকেও আসলে উপন্যাসের স্বার্থে পাঠকের ভালো মতো বুঝে ওঠা দরকার। কিন্তু অত সহজে তাকে বুঝে ওঠা যায় না আসলে। প্রকৃতপক্ষে, উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্বের একটি অধ্যায়ে পাদ্রীর কাছে দেয়া এক জবানবন্দীতে স্তাভরোগিন জানিয়েছিলো কীভাবে এক দরিদ্র, অপ্রাপ্তবয়স্কাকে ধর্ষণ করে মেয়েটাকে সে ঠেলে দিয়েছিলো আত্মহত্যার দিকে। কিন্তু রাশিয়ান হেরাল্ডের সম্পাদক অশ্লীলতা আর তীব্রতা বিবেচনায় এই অধ্যায়টা পত্রিকায় প্রকাশিত হতে দেননি, পরে দস্তয়েভস্কি নিজেও সেটা যুক্ত করেননি উপন্যাস আকারে বইটা প্রকাশের সময়। ফলে নানাভাবে লেখককে সম্পাদনা করতে হয়েছিলো পরের অধ্যায়গুলো, স্তাভরোগিনকে পুরো উপন্যাস জুড়ে অনেকটা সময় যে লক্ষ্যহীন মনে হয়, এটা মনে হয় তার একটা কারণ।
(৪)
সাধারণত যখন আমরা কোনো উপন্যাসের ভেতর ঢুকতে যাই, প্রথম কয়েক পাতা কি কয়েক অধ্যায় জুড়ে আমরা দাবা খেলার মতো করে বিশ্লেষণ করতে চাই লেখকের প্রতিটা ইঙ্গিতকে, আমরা বুঝতে চাই যে কাহিনিটার ভেতরে আমরা পা রাখছি, সেটার প্রকৃতি, আকার আর গুরুত্ব। কোনো অভিযাত্রীর দুর্গম অরণ্যে ঢুকবার সাথে তুলনা করা যায় বিষয়টাকে। অভিযাত্রীকে প্রথমে প্রতি মুহুর্তে স্নায়ূ টানটান করে সতর্ক থাকতে হয়, তবে চারপাশের বৃক্ষরাজির ধরন, সম্ভাব্য বিপদ আর হৃদয়-হরণকারী উজ্জ্বল ফুলদের সম্বন্ধে প্রাথমিক ধারণা হয়ে গেলে; সে তখন স্বচ্ছন্দে পা চালাতে পারে।
কিন্তু দস্তয়েভস্কির অরণ্য স্বাভাবিকের চাইতে একটু বেশিই যেন ঘন। ভাষা বা বাক্যের বা চিন্তার জটিলতায় নয়, সবকিছুতেই আশ্চর্য সরল হয়েও যে দস্তয়েভস্কি হাতে নিয়ে পাঠক ধন্দে পড়ে, তার কারণ লোকটার চরিত্রগুলোর অদ্ভুত মনোজগৎ, যা পাঠকের মাথার ভেতর এক অদ্ভুত চাপ তৈরি করে। দস্তয়েভস্কির চরিত্রগুলো সর্বদা মেজাজের এক তুরীয় মাত্রায় থেকে চ্যাঁচায়, কথা বলে, ধমকায়। এই হাসে, তো পরমুহুর্তেই কেঁদে দেয়। কাহিনির পুরোটা জুড়েই বজায় থাকে এই ধারা। দস্তয়েভস্কির সাথে পাঠকের তাই, দাবা খেলতে হয় বলতে গেলে সম্পূর্ণ অরণ্য পাড়ি না দেয়া পর্যন্তই। দা ডেমনস উপন্যাস পড়তে গেলে, সেই অরণ্যের সাথে আরো যোগ হয় কালের কোদাল নামক আপদটা।
এ উপন্যাসে অজস্র সমসাময়িক উদাহরণ টেনেছেন দস্তয়েভস্কি, ইঙ্গিত দিয়েছেন সেকালের রাশিয়াকে আলোড়িত করা ঘটনার। কখনো ইশারায় খুঁচিয়েছেন তুর্গেনেভকে, কখনো ইঙ্গিত দিয়েছেন নিজেরই যৌবনের নির্বুদ্ধিতার। এবং এই সমস্ত ঘটনাকে বুঝতে হলে পাঠককে চোখ বোলাতে হয় অজস্র টীকায়। উপন্যাস পড়ার কাজটা কঠিন হয়ে যায় তখন। ১৮৭০ সালে লেখা এক চিঠিতে, দা ডেমনস উপন্যাস রচনার কালে, এক ব্যক্তিগত চিঠিতে দস্তয়েভস্কিকে বলতে দেখিঃ
“I have great hopes for the work that I’m writing for the Russian Herald, not from the artistic but from the tendentious point of view; I want to express several ideas- even if my artistry should suffer as a result… Even if it turns out to be nothing more than a lampoon, I’ll have my say.”
টের পাই, দস্তয়েভস্কিও জানতেন, যে সমসাময়িকতাকে জায়গা করে দিতে হলে ঝুঁকি থাকে উপন্যাসের সৌন্দর্য্য খসে যাবার। আর দা ডেমনস পড়তে গেলে টের পাওয়া যায়, এই প্রজ্ঞা লেখকের ভেতরে অবিরত জন্ম দিয়ে গেছে দ্বিধা। ঠিক একবিংশ শতাব্দীর ঢাকা শহরে বসে চারপাশের অজস্র অন্যায় আর মতবাদের বিস্ফোরণ দেখে আজ যেমন আমি অসহায় বোধ করি, ডেমনসের পাতায় পাতায় নানা রাজনৈতিক আর সামাজিক মতবাদ নিয়ে দস্তয়েভস্কিরও ঠিক তেমন টানাপোড়েন লক্ষ করা যায়। লোকটা যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না কোন পক্ষ সে নেবে।
কিন্তু লেখককে সহানুভূতিতে ভাসানোর সুযোগ দস্তয়েভস্কি পাঠককে দেন না, বরং সব মহৎ ঔপন্যাসিকের মতোই, রাজনৈতিক সমস্যার বাইরেও তিনি ছুঁয়ে আসেন আমাদের ভেতরের গভীর কোনো দানবিকতা। কালের শক্ত কোদালে দেহের অনেকটা অংশ ক্ষয়ে গেলেও তাই, দা ডেমনস উপন্যাসের আত্মাটি আজও রয়ে গেছে উজ্জ্বল।
যতদিন টিভি সিরিয়ালের পর্দায় সেক্রেড গেমসের গণেশ গায়তোণ্ডে’রা নিজেকে দাবি করে যাবে ভগবান আর পৃথিবী জুড়ে ঈশ্বরের রাজ্য প্রতিষ্ঠায় কাউকে অকারণ নৃশংস হত্যা করা হবে নাইজেরিয়া কি বাংলাদেশে, যতদিন পৃথিবীতে গায়ের জোরে নিজ আদর্শ কায়েম করতে মানুষ হয়ে উঠবে অনুশোচনাহীন দানব, দা ডেমনস ঠিক ততদিনই থেকে যাবে প্রাসঙ্গিক, আর সমসাময়িক।
[জানুয়ারি, ২০২০]
Leave a Reply