(১)
কী ঘটে, যখন আমরা সদ্য রচিত কোনো উপন্যাস পড়ি? কী চলে আমাদের মনের ভেতরে, যখন সেই উপন্যাস লেখা হয় ভিনভাষার বদলে আমার নিজের ভাষায় আর উপন্যাসের প্রেক্ষাপট হয় আমারই চারপাশ?
মাসরুর আরেফিনের উপন্যাস আগস্ট আবছায়া পড়তে বসে, প্রশ্নবোধক চিহ্নের এই দল আমাকে তাড়া করে বেড়িয়েছে একটা সময় জুড়ে।
উপন্যাস যদি হয় অন্য কোনো সময়ের, বা অজানা কোনো ভাষার, বা অচেনা কোনো ইতিহাসের বুকে স্থাপিত; তাহলে তার হাত ধরাটা পাঠকের জন্য সোজা হয়ে পড়ে। আমরা জানি যে উপন্যাস আসলে সুড়ঙ্গের মতোই, একবার সেটার ভেতরে ঢুকে পড়লে পাঠক নিজের চেনা সময় আর ভূগোল থেকে বেরিয়ে চলে আসে অন্য কোনো সময়ে আর অন্য কোনো ভূগোলে। ঢাকা শহরের পাঠক যেমন নিজেকে ব্রন্টির হাত ধরে আবিষ্কার করতে পারে ইয়র্কশায়ারের বরফ ঢাকা সন্ধ্যায় বিষণ্ণ কোনো জানালার ধারে, একবিংশ শতাব্দীর পাঠকও তেমনই দস্তয়েভস্কির হাত ধরে বুঝতে পারে র্যাডিক্যাল, পশ্চিমা ভাবধারা আর রাশিয়ান আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের দড়ি টানাটানিতে ঠিক কী চলছে ১৮৭০ এর রাশিয়ায়। সুড়ঙ্গের ওপাশের সময় আর পরিবেশকে আবিষ্কার করতে পাঠকের মন স্বভাবতই উদগ্রীব। স্বল্প প্ররোচনাতেই পালাবার রাস্তায় সে গতি পায়।
অথচ নিজ ভাষা, নিজ পরিবেশ এবং সমকালকে বহন করা কোনো উপন্যাস পড়ার ক্ষেত্রে পাঠকের মন শুরু থেকেই খিটখিটে বুড়োর মতো। পরিবেশটা তার জানা, ভাষাটাকে সে নিত্য ব্যবহার করছে, নিজেও সে বহন করছে উপন্যাসে বর্ণিত সময়ের ডিএনএ। সাদাকালোর জগতের সাথে নিজেকে একাত্ম করতে গিয়ে সে একটা বিচিত্র এবং ক্ষেত্রবিশেষে অনৈতিক কাজ করে তখন, পাঠকের বদলে হয়ে বসে গোয়েন্দা। লেখকের পিছু পিছু হেঁটে গিয়ে, সে তখন টর্চ মারে লেখকের ব্যক্তিগত জীবনে।
একবিংশ শতাব্দীর ঢাকাবাসী পাঠক তখন বুঝতে চায়, লেখকও কি তার মতোই স্বস্তি পায় বিজয় সরণীর সিগন্যাল দ্রুত পেরিয়ে গেলে? ওই শালা কি সরকারি অফিসের পিয়নের প্রতি জিঘাংসা অনুভব করে সাধারণ কোনো মানুষের মতোই? দিন শেষে টিভি সেটের দিকে তাকালে কি ওই লেখক ব্যাটার রক্তেও তৃপ্তি নয়, উদ্বেগ নয়, খেলা করে যায় কেবল অবসাদ?
স্বাভাবিক ভাবেই, ইতিহাস বা ভূগোলের সার্বজনীন কোনো চাদর মাঝখানে না থাকায়, নিজ ভাষার সমকালীন উপন্যাসকে মানুষ বিচার করে ব্যক্তিগত দৃষ্টির মশারির ভেতর থেকে। লেখকের রাজনীতিক দর্শন বা ব্যক্তি জীবনের সূচকের বাইরে হালের সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং-এর চিরুনি জীবনে আলোচনায় উঠে আসে উপন্যাস নিয়ে লেখকের নিজের বক্তব্য, অন্যদের পাঠ প্রতিক্রিয়া বা উপন্যাসের প্রচার পদ্ধতি। কিন্তু যে পাঠক মশারির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে সমকালীন প্রেক্ষাপটের উপন্যাসকেও মাপতে চায় শুধুমাত্র সেটার অক্ষরগুলো দিয়েই, গোয়েন্দা প্রদোষ মিত্র না হয়ে সে তখন হয়তো সিধুজ্যাঠার মতো সত্যিকারের পাঠক হয়ে উঠতে পারে।
মাথা থেকে অন্য সব সরিয়ে আগস্ট আবছায়ার সুড়ঙ্গের ভেতর ঢুকতে পারলে, সমস্ত ভালো উপন্যাসের মতোই, পাঠক তাই নিজেকে অন্য দুনিয়ায় নিয়ে যেতে পারে।
(২)
আগস্ট আবছায়া এগিয়ে গেছে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে কেন্দ্র করে, তাকেই বলা যায় উপন্যাসের নায়ক। কাফকা, প্রুস্ত, পুশকিন আর বিভূতিভুষণের সাথে সাথে আমাদের প্রফেসর নায়কের মনকে আবিষ্ট করে রাখে ১৯৭৫ এর রক্তঝরা ১৫ আগস্ট; সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ড। কাহিনী কিছুটা এগোলে আবিষ্কার করা যায় খেয়ালি মানুষটার সাথে থাকা কাহিনীর গৌণ চরিত্রদেরও; তার দুই সহকর্মী মাসুম এবং নূর, তাদের স্ত্রীরা, অস্ত্র বিক্রেতা ইবরাহিম, পিংকি হিজড়া যেমন। তবে কাহিনীতে এদের চেয়ে গুরুত্বপুর্ণ চরিত্র হয়ে রয় প্রফেসরের দুই প্রেমিকা, তার বাংলাদেশি ছাত্রী মেহেরনাজ এবং নেপালি বান্ধবী সুরভী ছেত্রী। উপন্যাসের শুরুতেই আমরা জানতে পারি যে প্রতিবছর আগস্ট মাস এলেই বেশ এলোমেলো হয়ে যায় প্রফেসর, আর এ বছর সেটার সাথে যোগ হয়েছে মুহুর্তের প্রণোদনায় মুম্বাইয়ের ট্যাক্সিচালক আইয়ারকে বখশিস না দেয়ার গ্লানি। প্যারিসের রাস্তায় ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে পড়া একটি মুহুর্তে যেমন হঠাৎ করেই চেতনার গভীরে পতন শুরু হয়েছিলো কাম্যুর আইনজীবী জ্যাঁ ব্যাপ্টিস্ট ক্লেমেন্সের, আইয়ারকে বখশিস না দেয়াকে কেন্দ্র প্রফেসর আমাদের নিয়ে যান তার নিজস্ব অস্তিত্ববাদের সংস্করণে। এবং ঘটনার স্রোতে পাঠকের সামনে বর্ণিত হয় মানুষের চিরকালের ধ্বংসমুখীতা, ক্ষমতার জন্য চিরন্তন লোভ, আর সময়ের সামনে তার একান্ত ক্ষুদ্রতা।
এমন একটা কাহিনীকে কেন্দ্র করেই এগিয়ে যায় আগস্ট আবছায়া, সাথে থাকে তার উত্তরাধুনিক আঙ্গিক। বিশ্বসাহিত্য চষে খাওয়া আমাদের গল্পের নায়ক মুহুর্মুহু উদ্ধৃত করে বিখ্যাত সব লেখকের রচনা থেকে। কৌতুকের সাথে লক্ষ করি, মেটা ফিকশনের খেলাটির নিয়ম মাসরুরের ভালোই জানা। তার গল্পের নায়কের বয়ানে মাসরুর তুলে এনেছেন এমন সব উপন্যাস, যাদের অধিকাংশই আমরা পঠিত হতে দেখেছি অন্য কোনো সাহিত্যকর্মে। গল্পের প্রফেসর খুব করে ভালোবাসেন বিভূতিভুষণের পথের পাঁচালী, (সেই উপন্যাস, যা চিলেকোঠার সেপাই’তে ওসমান গণিকে আবিষ্ট করে রেখেছিলো), বিমানবন্দরে তিনি পড়েন তুর্গেনেভের আ স্পোর্টসম্যান’স স্কেচেস (সেই উপন্যাস, যা মদ গেলার ফাঁকে ফাঁকে জেক বার্নস পড়তো দা সান অলসো রাইজেস’এ), আর কথায় কথায় উদ্ধৃতি ছাড়েন মার্সেল প্রুস্তের ইন সার্চ অফ আ লস্ট টাইম থেকে (সেই বিশাল উপন্যাস, সতীনাথ ভাদুড়ি প্রায়শই নিজের নোটবুকে দিয়েছেন যার বিস্তারিত বর্ণনা)। মনে একটা প্রশ্নও জাগে। জেক বার্নস তো ছিলো হেমিংওয়ের আরেক সত্ত্বা। তবে কি উপন্যাসে বর্ণিত কাফকা অনুবাদক প্রফেসর আসলে আমাদের সুপরিচিত মাসরুরের কোনো অল্টার ইগো, যাকে আশ্রয় করে তিনি ফোটাতে চাইছেন বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে তার রাজনৈতিক দর্শন?
কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তরে খোঁজার আগেই ভেতরের গোয়েন্দাকে দমিয়ে দিতে হয় থাপ্পড় মেরে, কারণ পাঠকের বিস্মৃত হলে চলে না, যে উপন্যাসের আসল সৌন্দর্য্য কেবল তার শব্দের মাঝেই।
(৩)
উপন্যাস জুড়েই মাসরুরের ভাষাটি ঠিক গড়পড়তা নয়। অনুবাদের একটা আঁশটে গন্ধ বেশ দারুণ রকম জাপটে ধরে থাকে আগস্ট আবছায়াকে, অন্ততঃ তাই মনে হয় প্রথমে। কিন্তু আগ্রহী যে পাঠক আরেকটু এগিয়ে যাবে সহ্য করে, দেখতে পাবে, গদ্যের সেই এলোমেলো ভাবের ভেতরেই এক ধরনের শৃঙ্খলা উপস্থিত। মাসরুর প্রায়ই তার গদ্যের টেনসাইল স্ট্রেংথ পরীক্ষা করেন, উদ্ভট এবং ভারি সব ইংরেজি শব্দ ঢুকিয়ে দ্যান নিতান্ত অপ্রয়োজনেও, তবু গদ্যটা বেশ ভালো লাগতে থাকে এগিয়ে গেলে। অতীতায়নের ক্ষেত্রে ভালো লাগাটা খানিক বেড়ে পর্যন্ত যায়।
শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পেছনের রাজনীতিতে ঢোকার চেষ্টা অবশ্য মাশরুর করেননি। উপন্যাসকে সে চেষ্টা করতে হবে, তেমন দাবিও উত্থাপিত হয়নি কোনো রাজপথে। বরং অন্যপথে হেঁটে মনে রাখার মতো একটা কাজ করেছেন তিনি, রক্তাক্ত ১৫ আগস্টের বর্ণনাকে করেছেন দারুণ গতিশীল অথচ কাব্যিক। পুরো উপন্যাসে সবচেয়ে মনে রাখার মতো অংশ ছিলো এই অধ্যায়টিই। বিশাল একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে বাস্তবসম্মত করে তোলার জন্য ভাষিক আর আঙ্গিকগত যে কারুকাজের প্রয়োজন ছিলো, মাসরুর সেটিও সম্পাদন করতে পেরেছেন বেশ কৃতিত্বের সাথেই।
(৪)
কিন্তু সকল ক্ষেত্রে কৃতিত্ব দেখানোটা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না প্রায় সকলের ক্ষেত্রেই। আমরা জানি, বছরের পর বছর ধরে শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে গিয়ে ঔপন্যাসিক আসলে লক্ষ্য করে তোলে একটি কথাই কেবল, যার চূড়ায় সে সাজাতে পারে সাতটি অমরাবতী। অথচ উপন্যাসের ধারণার সাথে প্রেমিকার মতো বোঝাপড়া করতে চেয়ে আমার মনোভাব এমন, যে সামান্য অমনোযোগেই কায়িক কি মানসিক ওই পরিশ্রম হয়ে যেতে পারে লক্ষ্যহীন। আলোচ্য উপন্যাসের শেষাংশ নিয়ে তাই, একটা খচখচানি থেকেই যায়।
তবে পাতলা এই যাতনার চেয়েও দাগা দেয় আগস্ট আবছায়ায় হালজমানার উত্তরাধুনিক ধাঁচের উপন্যাসগুলোর বিশেষ এক বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি। সাহিত্যের প্রাচীনতম সূত্র যেখানে আমার গল্পকে দ্বিতীয় কারো কাছে নিয়ে যাওয়া, সেই বিশ্বাসে দাঁড়িয়ে মাসরুরের উপন্যাস ঠিক যেন আমাদের নয়। ইসমাইল কাদারের উপন্যাসে যেমন উঠে আসে আলবেনিয়া, ওরহান পামুক যেমন তার উপন্যাসে পাঠককে হাঁটিয়ে নেন নিস্তানসি স্কোয়ারে, উইলিয়াম ফকনারের পাঠক যেমন মিসিসিপির চারপাশে হাঁটতে পারে চোখ বুজে; মাসরুরের বর্ণিত বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা কি ঢাকা শহর যেন ঠিক ততটা আপন হয়ে ওঠে না পাঠকের। একবিংশ শতাব্দী যে সংস্কৃতিমনা উচ্চ-মধ্যবিত্তের প্রোটোটাইপ জন্ম দিয়েছে দুনিয়া জুড়ে, আগস্ট আবছায়ার প্রফেসর যেন সেই শ্রেণীটিরই প্রতিনিধিত্ব করে। তার চোখ দিয়ে আবিষ্কার করা যায় না ঢাকা শহরকে। মাসরুরের উপন্যাস তাই যতটা আধুনিক দুনিয়ার, ততটা যেন বাংলাদেশের নয়। উত্তরাধুনিক উপন্যাসের এই খামতিটি নিয়ে নিউ ইয়র্ক রিভিউতে ‘ডাল নিউ গ্লোবাল নভেল’ নামের এক প্রবন্ধ ফেঁদেছিলেন টিম পার্কস। জানিয়েছিলেন, প্রাদেশিকতা পরিত্যাগ করে অ-ইংরেজি ভাষী লেখকেরা অনেকেই আজ হতে চাইছেন বৈশ্বিক, অনুবাদের সুবিধার জন্য উপন্যাস থেকে তারা ছেঁটে ফেলছেন নিজ ভূগোলের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু, জানে ইতিহাস কি সাহিত্যের মনোযোগী পাঠক মাত্রই, আঞ্চলিকতার গন্ধ গা থেকে ঝেড়ে ফেলা মানেই বৈশ্বিক হয়ে ওঠা নয়, প্রকৃত বৈশ্বিকতা বরং অর্জিত হয় আঞ্চলিকতাকে নিজের মাঝে ধারণ করা গেলেই। ইতিহাসকে চক্রাকারে ফিরতে দেখানো মাসরুরও নিশ্চয় এই সত্য জানেন।
(৫)
তবে পাঠকের এই অনুযোগকে কানে রেখে আগস্ট আবছায়াকে বিচার করতে চাওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ? সে দাবি করা উচিৎ হবে না মোটেই। কারণ এমন এক বিশ্বে আমাদের বাস যেখানে শেখ রাসেলের মতোই আজও শিশুদের হত্যা করা হয় আর হামলা চলে খাবার রেস্তোরাঁয়। অবিশ্বাস্য এ পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত ভাঙছে বিশ্বাস, চুরমার হচ্ছে উপন্যাসের যাবতীয় ধ্যানধারণাও।
তেমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে আগস্ট আবছায়ার পাতায় মাসরুর আরেফিন গলা তুলেছেন সাহিত্যের চিরায়ত কাজটাকে আরো একবার সম্পন্ন করতে, নতুন ভঙ্গিতে গল্প বলা। গলাটা অপরিচিত, তবে আবছা নয়, স্পষ্ট। ভঙ্গির সাথে সাথে স্বরটিও বাংলাদেশের পাঠকের কাছে নতুন। কিন্তু উপন্যাসের পাঠক জানে, নতুনের কাছেই প্রত্যাশা রাখা যায় পুরোনোকে প্রতিস্থাপন করবার।
[সেপ্টেম্বর, ২০১৯]
Leave a Reply