ব্ল্যাক মিরর বলে একটা টিভি ধারাবাহিক আমি খুব আগ্রহ নিয়ে দেখি। যারা দেখেছেন, তারা জানেন; এই ধারাবাহিকের মূল প্রতিপাদ্য সামাজিক যোগাযোগের সাইট আর প্রযুক্তির ওপর অতিনির্ভরতা মানুষ হিসেবে আমাদের কীভাবে ভঙ্গুর করে তুলছে। প্রতিটি পর্বেই আলাদা গল্প। ভালো গল্পগুলো দেখতে বসলে মনের ওপর চাপ পড়ে। কী ভয়ানক একটা ভবিষ্যতের দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, সেটা ভেবে আতঙ্ক বুকের ওপর লাফঝাঁপ দেয়। কবি ইমতিয়াজ মাহমুদের কাব্যগ্রন্থ ‘কালো কৌতুক’ হাতে নিলে নামের কারণে যদিও প্রথমেই ব্ল্যাক মিরর ধারাবাহিককে মনে পড়ে, কিন্তু এ বইয়ের কবিতাগুলোর স্বাদ আসলে বহুমুখী। পাঠ শেষে তাই ভেতরটা অপরিচিত এক স্বাদে খিটখিট করে, মনে হয় যেন মুন্না ভাই এমবিবিএসের মতোই নিজের ক্ষুদ্রতা নিয়ে কৌতুক করে গেলাম কারো সামনে।
ইমতিয়াজ মাহমুদের লেখার সাথে আমার পরিচয় ফেসবুকের হোমপেজে। গ্যালাক্সির দার্শনিক হিসেবে লোকটা বেশ আগ্রহ জাগানিয়া এবং রসবোধ ভালো। তা সামাজিক যোগাযোগের সাইটে এমন বাক্যিনরেশের আর অভাব কী? তবু, সম্ভবত সত্যিকারের কবিতা লিখতে পারে বলেই মানুষটার এলোমেলো বাক্যবাণে তাকে নিয়ে একটা আগ্রহ তৈরি হয়। ফেব্রুয়ারির বইমেলা থেকে কেনা হয় অপুষ্ট কাব্যগ্রন্থ ‘কালো কৌতুক’। পড়া হয়েছিলো আগেই, ভালোও লেগেছিলো; কিন্তু ভেতরের অনুভূতিটা প্রকাশ করার তাগিদটা কোথাও যেন আটকে যাচ্ছিলো।
অর্গলটা ছুটে গেলো আজ, যখন সকালে ঘুম থেকে উঠে খাবার টেবিলে বসে আম্মাকে দেখে কী কারণে জানি মাথার ভেতরে ক্রমশ দানা পাকিয়ে উঠলো একটা পংক্তিঃ
মা এত কম উপকরণ নিয়ে স্বপ্ন দেখেন যে অবাক হতে হয়!
প্রতিটি পাঠক জানে, এমন কিছু মুহুর্ত আসে, যখন মনের ভেতর থেকে সে কবি হিসেবে সার্টিফিকেট দিতে পারে কোনো বিশেষ পংক্তি রচয়িতাকে। ফলে কালো কৌতুক আরেকবার না পড়ে আজ আমার আর নিষ্কৃতি থাকে না।
ইমতিয়াজ অ্যাতো কম উপকরণ নিয়ে কবিতা লেখে যে অবাক হতে হয়। তার উপকরণ কী? গদ্য কবিতা, নিত্যদিনের কথ্য ভাষার সাবলীল ব্যবহার, অ্যাপোলোনিয়ারের ধাঁচে নকশা বানানো; এই তো। ঘুরে ফিরে আসে পিতা-মাতা-সন্তানের সম্পর্ক আর ইনসোমনিয়ার মতো বিষয়। কিন্তু এসব তো দেহের গঠন কেবল, ইমতিয়াজের কবিতা আসলে প্রাণ পায় জীবনের প্রতি বিচিত্র এক ধরনের বিবমিষা প্রকাশ করে আর সেটার প্রতি এক ধরনের কৌতুক আরোপ করে।
পছন্দের কবিতা হারুণ থেকে উদাহরণ টানা যাকঃ
মানুষ কতটা হারামি হতে পারে বারান্দা
থেকে বউ না পড়লে তা বোঝাই যায় না,
এক কাগজে লিখেছে টাকার জন্য খুন,
এক কাগজে লিখেছে যৌনবিকৃতি
এক কাগজে লিখেছে আপনার
এক কাগজে লিখেছে দুজনারই।
সমাজ বাস্তবতার প্রতি ইমতিয়াজের এক ধরনের ক্ষোভ আছে। হারুণ ছাড়াও লাইভ বা খেলনা– এই কবিতাগুলোয় সেটার বেশ প্রমাণ মেলে। ক্ষোভটাকে হ্যান্ডল করার জন্য অবশ্য জেলে বা ব্যানার মেলে ধরতে শাহবাগে যেতে ইমতিয়াজের তীব্র আপত্তি, লোকটা বেছে নিয়েছে বিদ্রুপের রাস্তা। চটপটে গদ্য দিয়েই ভাবনা প্রকাশে কবির হাতটা বেশ চালু। পুলিশের রুলের গুঁতো খেয়ে মিথ্যা বলার পাপে তাই হারুণকে পাঠানো হয় দোযখে, আবার রাজাকে জাপটে ধরা পাইথন শেষতক সাংবাদিকের আস্ফালনে পরিণত হয় বাবুর্চি কামড়ানো রাজহাঁসে।
সংকলনের কিছু কবিতা অল্প কথায় সারা, কিছু কবিতা আবার দীর্ঘ। ইমতিয়াজের বলার ভঙ্গিটি এমন যে কথা বলার দৈর্ঘ্য বাড়লেই তার দিকে মনোযোগটা যায় বেশি। আত্মজীবনী বা রুচির মতো কবিতাগুলোয় তাই ভাবনাটা ফোটে বেশি। কখনো আবার এমন হয় যে একটি পংক্তি বিনয় মজুমদারের মাছের মতো এমনই লাফ মারে যে সেটার আলো চোখে লেগে থাকে অনেকক্ষণ। মায়ের উপকরণ স্বল্পতার কথা তো আগেই বলা, তার বাইরে আরো কিছু পংক্তিকে মনে ধরে পাঠকের।
১টা ভোর রচনার জন্য আর কতটা জোনাকির লাশ দরকার?
বা
গরুর দল জানে না, একটা বিশ্বযুদ্ধ খেয়ে ফেলার পর মানুষের আর খাবার রুচি থাকে না।
তবু, সমস্ত চোখ ধাঁধানো পংক্তিদের সরিয়ে দেয়া শেষে, ইমতিয়াজের কবিতা টানা পড়ে গেলে যে অনুভূতিটা হয়, তা হলো অসম্পূর্ণতা। মনে হয়, কীসে যেন আটকে গেছেন কবি, কী নেই যেন, কী যেন নেই।
তখন মনে পড়ে, পৃথিবীজোড়া সমালোচকদের জ্ঞানচক্ষুর সামনে ঘাড় নিচু করে থাকা মুরাকামির উপন্যাস। অজস্র ফাঁক আর উদ্ভট বর্ণনারীতির উপন্যাসগুলো সর্বজ্ঞের প্রজ্ঞা নিয়ে পড়ে গেলে ঔপন্যাসিককে ব্যর্থই মনে হয় ঠিক; কিন্তু পাঠক জানে, সমস্ত সূচকের পাতায় নিয়ম মানা বহু সফল লেখকও যা করতে পারে না, মুরাকামির ব্যর্থতা সেই কাজটি সম্পাদন করে অনায়াসে, পাঠককে আনন্দ দেয়া। জীবিত থেকে যে কবি হওয়া যায় না, ইমতিয়াজ সে বিষয়টা ভালোই জানে। আর মানুষের (বিশেষত সে যদি হয় কবি) মরণে মানুষই সবচেয়ে বেশি আনন্দ পায় এ ভুবনে, যে ভুবনে সন্তান হয়ে ওঠে খেলনা।
হাঁটতে হাঁটতে, বাজার বা অফিসে বসে, ঘরে বসে ডাল দিয়ে ভাত মাখাতে মাখাতে আমাদের আনন্দ দেয় বলে ইমতিয়াজ মাহমুদের কবিতা পাঠকের ভালো লাগে। আমরা তাই আশা করি যে ব্ল্যাক মিররের মতো কালো কৌতুক নাম-কবিতার ভবিষ্যত যেন সত্য হয়ে না ওঠে। আমর আশা করি যে সেলফি আর ডকুমেন্টারির ভিড়ে তার চোখে দশটি আঙুল গজাবে না।
[২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯]
Leave a Reply