সমস্ত পড়ুয়ার জীবনে কখনো কখনো এমন সব মুহুর্ত আসে, যখন শব্দের সৌন্দর্য্য তাকে অ্যাতো অভিভূত করে, যে তাকে বই বন্ধ করে খানিক বসে থাকতে হয়। একটা কিছু আবিষ্কারের, একটা কিছু নতুন করে অনুধাবনের কাঁটা তখন তাকে খোঁচায় ভেতরে, কিন্তু সেটা কীসের, তা ঠিক নিশ্চিত হওয়া যায় না। মানুষের জটিল মনোসরণির সবটা কখনোই জানা হয়ে ওঠে না আমাদের। কিন্তু দস্তয়েভস্কির উপন্যাস সেই বিরল উপলক্ষগুলোর একটা, যা পাঠককে নিয়ে যায় হৃদয়ের এমন কলোসিয়ামে, যেখানে মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা বহু উপলদ্ধি আর বহু জিজ্ঞাসার গ্ল্যাডিয়েটর তাকে ক্রমাগত রক্তাক্ত করে।
ফাঁসির আসামীকে যখন নিয়ে যাওয়া হয় ফাঁসিকাঠের দিকে, তখন তার সামনে বাকি জীবনটা পড়ে থাকে কেবল হাঁটার জন্যই। সময় কি তার কাছে অসীম হয়ে যায় সেই যাত্রায়? তার কি তখনো মনে হয় যে এখনো সময়ে রয়েছে অনেক, তাকে পেরোতে হবে আস্ত দুটো দালান, তিনটা রাস্তা আর পাঁচ ধাপ সিঁড়ি? একে একে এই সব দালান, রাস্তা, সিঁড়ি পেরিয়ে গেলে; যখন সে এসে পৌঁছে ফাঁসিকাঠে; তখনো তার মনে হতে পারে যে এখনো কিছু সময় তার হাতে আছে। তখনো সে পৃথিবী দেখতে পারে কিছুক্ষণের জন্য। মাথায় কাপড় জড়িয়ে দেয়ার পরেও শুনতে পারে দুনিয়ার কোলাহল, অনুভব করতে পারে তার গলায় জড়িয়ে রাখা দড়ি। সবশেষে, যখন তার কানে আসে ফাঁসিকাঠ খুলে দেয়ার আওয়াজ, তখনকি তার চেতনা নিবিষ্ট হয়ে পড়ে ওই অনন্তকালের দৈর্ঘ্য পেয়ে যাওয়া মুহুর্তটিতে?
ইডিয়ট পড়তে গিয়ে প্রিন্স মিশকিনের মুখে জনৈক মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামীর মনোজগতের বর্ণনা শুনতে শুনতে ওই বিশেষ মুহুর্তটি এসে আমি অনুধাবন করতে পারি, কী অকল্পনীয় নিরাসক্তি নিয়ে দস্তয়েভস্কি ঢুকে গেছেন মানুষের মনের ভেতরে। চিন্তার ল্যাবিরিন্থের ভেতরে এমন অনায়াসে পাঠককে নিয়ে যাবার ক্ষমতা খুব বেশি লেখকের নেই।
কী রকম উপন্যাস ইডিয়ট? একবাক্যে বলতে গেলে এই উপন্যাস এক আদর্শ ও মানবিকতা সম্পন্ন মানুষের অনুসন্ধান। ডন কুইক্সোট আর যিশু খ্রিস্টের ছায়ায় পরিপূর্ণ সেই মানুষকে দস্তয়েভস্কি খুঁজতে চেয়েছেন, আর দেখিয়েছেন সততার সাথে সৎ থাকতে চাওয়া এই সমাজে কতটা কঠিন।
কাহিনিতে যে খুব মারপ্যাঁচ আছে, তা নয়। বিদেশফেরত, আদর্শ ভালো মানুষ, সচ্চরিত্র প্রিন্স মিশকিন সেন্ট পিটার্সবার্গে এসে দেখা করে তার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়া, জনৈক জেনারেলপত্নী লিজায়েতভা য়েপানচিনের সাথে। তাদের তিন কন্যার মাঝে সবচেয়ে ছোটটি, এবং রুপকথার নিয়মানুযায়ী সবচেয়ে সুন্দরীটি, আগলাইয়া, প্রেমে পড়ে মিশকিনের আশ্চর্য সারল্যের। আগলাইয়াকে ভালোবাসে তারই বাবার সহচর গানিয়া, অথচ সে লোকটা আবার অর্থের প্রয়োজনে তোৎস্কি নামে এক বড়লোকের রক্ষিতা নাস্তাশিয়া ফিলোপ্পভনাকে বিয়ে করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতাতে চায়। নাস্তাশিয়া স্বশিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী এবং আশ্চর্য প্রাণোচ্ছল, তাকে পেতে উন্মুখ অনেকেই, এমনকী প্রিন্সের সাথে উপন্যাসের প্রথম দৃশ্যেই ট্রেনে পরিচিত হওয়া সেই রগোজিন নামের যুবকও। কিন্তু আমাদের প্রিন্স মিশকিনও ভালোবাসে ওই মেয়েটিকে। এক পর্যায়ে অনাহুত আগন্তক হয়ে মেয়েটির বাড়ির উৎসবে গিয়ে প্রিন্স নিজেই পাণিপ্রার্থনা করে বসে নাস্তাশিয়ার, এবং জানা যায় যে উত্তরাধিকার সূত্রে তারও বেশ মালকড়ি রয়েছে। নাটক এবার ক্রমশ ঘনীভূত হয়।
পাঠক দেখতে পায়, দস্তয়েভস্কির অন্যান্য উপন্যাসের মতোই, ইডিয়টেও সমাবেশ ঘটেছে প্রচুর চরিত্র, প্রচুর ঘটনা, প্রচুর শাখাগলি যুক্ত কাহিনির। এবং যথারীতি চরিত্রগুলো অস্থির, প্রবল ভাবাবেগে কম্পমান, নিজ নিজ মানস যাতনায় কাতর।
দস্তয়েভস্কির অব্যবহিত আগের উপন্যাস ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্টের মতো ইডিয়ট নয়। টানটান উত্তেজনায়, গোয়েন্দাকাহিনীর মতো কী হয়/কী হবে স্বরে কাহিনি এখানে এগোয়নি। ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্টের কেন্দ্রীয় চরিত্র রাস্কোলনিকভের দহন যেমন একটা দার্শনিক রুপ পেয়েছে, তেমনটাও হয়নি ইডিয়টের প্রিন্স মিশকিনের ক্ষেত্রে। স্পষ্ট হয়নি ঠিক এই চরিত্রকেই দস্তয়েভস্কি ভাবনা প্রকাশের কাছে বেছে নিলেন, সে ব্যাপারটাও। ইডিয়ট পড়তে পড়তে তাই প্রথমেই চোখ পড়ে রাস্কোলনিকভের সাথে মিশকিনের পার্থক্য। প্রথমজন অপরাধ করেছে, এবং আত্মদহনে পুড়ে সারাক্ষণ দ্বিধার মাঝে কাটিয়ে নিজেকে সমর্পণ করেছে সমাজের কাছেই, ভুল বুঝতে পেরে। কিন্তু প্রিন্স মিশকিন কোনো অপরাধ না করেও সমাজের চক্ষুশূল। নিজের ভুলটা কোথায়, তাও বুঝতে সে অপারগ। রাস্কোলনিকভ নিজের মধ্যবিত্তের চোখ দিয়ে অপরাধী সাব্যস্ত করেছে সমাজের উঁচুতলাকে, হত্যা করেছে সুদখোর এক বুড়িকে; আর ইডিয়টে পয়সাওয়ালা রুশী সমাজের অংশ হয়েও রগোজিন হত্যা করছে মধ্যবিত্তের চোখে প্রশ্নবিদ্ধ চরিত্রের নাস্তাশিয়াকে।
প্রিন্স মিশকিনের চরিত্র নির্মাণ নিয়ে তাই কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। আমরা জানি যে প্রিন্সের মাঝ দিয়ে পরিপূর্ণ সদ্বগুণে ভরপুর এক মানুষের ছবি আঁকতে দস্তয়েভস্কির মনোযোগ ছিলো এই উপন্যাসে। কিন্তু কখনো নাস্তিক আর ক্যাথলিক ক্রিশ্চিয়ানদের বকা দিয়ে; আবার কখনো রাশিয়ান জাতীয়তাবাদকে ইউরোপের চেয়ে ওপরে তুলে ধরে আমাদের প্রিন্স বেশ অনুদার মনের পরিচয় দেয়।
আমরা জানি, যে ঔপন্যাসিকের নিজের জীবনের দিকে তাকালে বহু উপন্যাসেরই ঘটনাপ্রবাহ আলাদা একটা দ্যোতনা নিয়ে ধরা দেয় পাঠকের কাছে। সময়ের প্রভাব, আর জীবনের পরিণত পর্বে ইউরোপিয়ান মতবাদের সাথে নিজের রুশী সত্ত্বার পার্থক্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠা ব্যক্তি দস্তয়েভস্কিকে বিবেচনায় নিয়ে প্রিন্স মিশকিনের ওসব অবস্থান যদি বা অনুমোদন করা যায়; কিন্তু কখনো আগলাইয়া আর পরমুহুর্তেই নাস্তাশিয়ার মাঝে তার প্রেম বন্টন করতে চাওয়াটা পাঠকের কাছে কখনো কখনো মেরুদন্ডহীনতাই মনে হয়। চরিত্রটাকে বড্ড বেশি একমাত্রিক লাগে। পথ ভুল হোক, রাস্কোলনিকভ তবু চেষ্টা করেছে সমাজে নিজের দাগ রাখতে; কিন্তু প্রিন্স মিশকিন সে পথে একেবারেই যায়নি। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি দিয়ে নাস্তাশিয়া অথবা আগলাইয়াকে একান্ত করে পাওয়াতেই যেন তার সব অর্জন। যে ডন কিহোতের মাঝে প্রিন্সের ছায়া আবিষ্কার করে কবিতা পড়েছে আগলাইয়া, সেই ডন কিহোতের পাশে প্রিন্স নেহাতই লক্ষ্যহীন।
তারচেয়ে বরং মন কাড়ে রগোজিন। ঘোরগ্রস্তের মতো সে ভালোবাসে নাস্তাশিয়াকে, আর অপরাধের দায়ভার ঘাড়ে নিতে পিছপা হয় না একদম। ভালো লাগে দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন কোলিয়াকে; কথায় নয়, কাজ দিয়েই এ তরুণ নিজেকে প্রমাণ করেছে বারবার। নাস্তাশিয়া আর আগলাইয়াও চোখে পড়বার মতো চরিত্র, ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্টের মতো বৃত্তাবদ্ধ নারী না হয়ে তারা বারবার নিজেদের অবস্থান নিজেরাই নিশ্চিত করতে চেয়েছে, লোকে কী ভাববে পরোয়া না করেই। নাস্তাশিয়া আর আগলাইয়া, দুজনেই প্রিন্সকে চেয়েও যেন চায় না। ডন কুইক্সোট বা যিশুর সাথে তুলনা টানা প্রিন্স মিশকিন ঠিক যেন তাদের পৃথিবীর নয়, এ কথা মেয়ে দুটি জানে।
ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্টের সাথে তুলনা বারবার টেনে এনে অনেকেই ইঙ্গিত দেন ইডিয়টের খর্বত্বের দিকে। এবং এই অনুযোগের কারণ আঁচ করাও কঠিন কিছু নয়। অজস্র জায়গায় কাহিনী কাণ্ড থেকে বেরিয়েছে শাখা। বহু জায়গায় চরিত্ররা হঠাৎ করেই বিভিন্ন মতবাদের পক্ষে বিপক্ষে অপ্রাসঙ্গিক ভাবে লম্বা লম্বা লেকচার মেরেছে। উদাহরণে যেমন বলা যায় যে ইপ্পলিত কাহিনির কোথাও নিজের প্রভাব না রেখেই হঠাৎ ক্ষেপে ওঠে এক জায়গায়, এবং আত্মহত্যার ভয় দেখিয়ে নিজের প্রতি সহানভূতি টানতে চায়।
দস্তয়েভস্কি কি এই পিচ্চি চরিত্রগুলোর মাঝ দিয়ে নির্দিষ্ট কোনো মতবাদ বা ধারণার উত্থাপন করতে চেয়েছিলেন? আমরা জানি না। আমরা যা জানি, তা হলো ব্যক্তিগত এক দুঃখভারাক্রান্ত চিঠিতে দস্তয়েভস্কি লিখেছিলেন যে সুন্দরতম এক মানুষ চরিত্রায়ণের উচ্চাভিলাষী প্রকল্পে তাকে সময়ের আগেই হাত দিতে হয়েছে আর্থিক টানাপোড়েনের জন্য। ব্যাপারটি নিশ্চিত হওয়া যায়। যখন আমরা ফিরে দেখি যে উপন্যাসটা লেখা হয়েছে দস্তয়েভস্কির প্রবাসজীবন কালে, তার দ্বিতীয় স্ত্রী এবং স্টেনোগ্রাফার আনা গ্রিগোরিয়েভনার সাহায্যে। ধারাবাহিকভাবে পত্রিকায় লেখার সময় মারা গিয়েছিলো তাদের মেয়ে। আনা গ্রিগোরিয়েভনা কর্তৃক সংরক্ষিত দস্তয়েভস্কির নোটবুক থেকেও দেখা যায়, ঠিক যেন নিশ্চিত তিনি ছিলেন না নিজের করণীয় নিয়ে। নোটবুকের পাতায় পাতায় তিনি অস্থির, রাগে ক্ষোভে হতাশায় তড়পাচ্ছেন; সেখানে তিনি উপস্থিত শিল্পীর চিরকালীন আর্তনাদটা নিয়ে।
আমরা এটাও দেখি, যে ইডিয়ট রচনার দু’বছর আগেই বাসেল শহরে হান্স হলোবাইনের আঁকা যিশু খ্রিস্টের সামনে দাঁড়িয়ে এমন ঘোরগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন দস্তয়েভস্কি, যে মৃগীরোগের কাঁপুনি ধরে গিয়েছিলো তার। যিশুর সেই প্রতিকৃতি, রগোজিনের ঘরে যে ছবির কপি দেখে প্রিন্স মিশকিন বলেছিলো, এই ছবি মানুষের বিশ্বাস নষ্ট করে দিতে পারে। ক্যানো? কারণ চিত্রশিল্পীরা ছবিতে যিশুর মুখকে সাধারণত স্বর্গীয় করে তোলার প্রাণান্ত চেষ্টা করেন। কিন্তু হলোবাইনের ছবিতে সদ্য ক্রুশ থেকে নামানো যিশুর মুখ যন্ত্রণায় কাতর। অ্যাতো তীব্র সে যাতনাকাতর মুখ, যেন তিনি এখনো ব্যথা পাচ্ছেন। পরিত্রাতা নয়, এক দলা মাংসের বেশি কিছু তিনি সেই ছবিতে হতে পারেননি। সেই যিশুকে দেখে প্রিন্সের মুখ দিয়ে দস্তয়েভস্কি প্রশ্ন রেখেছিলেন, প্রকৃতি যদি এমন শক্তিশালী হয়, তবে তাকে জয় করার উপায় কী?
কেউ বলে দেয়নি, পাঠক তবু বুঝে নেয়, হলোবাইনের সেই ছবির দীর্ঘ বর্ণনা আর কিছু নয়, মানুষের চিরন্তন ক্ষুদ্রতার দিকে দস্তয়েভস্কির ইঙ্গিত ।
ইডিয়ট শেষ পর্যন্ত তাই মানুষের ক্ষুদ্রতাকেই ব্যক্ত করা উপন্যাস, এবং আজকের পৃথিবীতে এই উপন্যাস আরো বেশি প্রাসঙ্গিক। ঈশ্বর যে দুনিয়ায় মৃত, পরিত্রাতা যখন আমাদের সকলের কাছেই একদলা মাংসের বেশি কিছু হতে পারছে না; মূর্খ হয়ে থাকা ছাড়া একজন ভালো মানুষের সামনে সেখানে আর রাস্তা কোথায়?
[মে, ২০১৯]
Leave a Reply