আগস্টের ডেঙ্গু মহামারিতে টইটম্বুর শহরে মাঝরাতেরও বেশ কিছু সময় পরে দেখে ফেললাম বিগ ব্যাং থিওরি’র শেষ পর্ব, বারো মৌসুমের সমাপ্তি। বলতেই হবে, শেষ দু পর্বের শুরুতে যখন টুকরো সব দৃশ্যের মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছিলো প্রথম মৌসুমের প্রথম পর্ব থেকে শুরু করে কাহিনির সুতো ধরিয়ে যাওয়া বিন্দুগুলো; এক ঝলকে গত একটা দশক যেন স্পষ্ট হয়ে উঠলো চোখের সামনে।

মনে পড়ে, অন্য অনেক কিছুর মতোই, কোনো পিএলের ছুটিতে সময় কাটাতে নীলরঙা সেই পেনড্রাইভে করে ফুয়াদের কাছ থেকে যোগাড় করেছিলাম সিজন ফোর। শুরুটা সেই রোবোটিক হাতের পর্ব দিয়ে। এরপর কখনো ক্যালটেকের ল্যাবরেটরিতে ঢুকে, কখনো চিজ কেক ফ্যাক্টরীতে ডায়েট কোক টেনে, কখনো স্টুয়ার্টের কমিক বইয়ের দোকানে একুয়াম্যান ঘেঁটে, কখনো চির নষ্ট এক এলিভেটর সর্বস্ব সিঁড়িঘরে তর্ক করতে করতে, কখনো ইন্ডিকেটর বিকল হয়ে থাকা গাড়িতে বিখাউজ সব প্রশ্ন শুনে, কখনো ক্যাফেটরিয়ায় আর কখনো শেলডনের সোফার পাশে দাঁড়িয়ে; কেবল হেসেই গেলাম। সিজন ফোর আমার এমনই ভালো লাগে যে অচিরেই এক-দুই-তিন যোগাড় করতে আটকায় না। শুরুতেই সেই বিঞ্জওয়াচ সেরে নিয়ে পরের বছরগুলোয় বিগ ব্যাং থিওরি’কে আমি তাই অনুসরণ করে গেছি বার্ষিক নিয়মে। আমার বয়স বেড়েছে, বয়স বেড়েছে বিগ ব্যাং থিওরির’ও।

বিজ্ঞানের একপাল গবেষক দিয়ে ভর্তি যে সিরিজ, সেটার মুখ্য চরিত্ররাও তাই বিজ্ঞানের সূত্র মেনেই অভিযোজিত হয়েছে। সুন্দরী পেনি, ভদ্রগোছের লেওনার্ড, ফিচকে বদমাশ রাজেশ, মেয়ে পটাতে মরিয়া হাওয়ার্ড আর মহা আঁতেল শেলডন তো বদলেছেই; সাথে বদলেছে পরে যোগ দেয়া ছোটোখাটো বার্নাডেট আর বিদূষী অ্যামি। হাওয়ার্ড আর বার্নাডেটের জীবন থেকে হাওয়ার্ড-মাতা সরে গিয়ে জায়গা নিয়েছে মাইকেল আর হ্যালি, শেষ দিকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে স্টুয়ার্টের চরিত্রটাও।

অন্য সমস্ত লম্বা দৌড়ের টিভি ধারাবাহিকের মতোই, জীবনের দ্বিতীয়ার্ধে দিকে বহুবার খেই হারিয়েছে বিগ ব্যাং থিওরি; তবে শেষ পর্যন্ত শেষ পর্বটাও দেখে ফেলার পরে আগ্রহী দর্শকের সেটা মনে থাকে না আর, বরং মন খারাপ ভাবটাই জমে বেশি। টিভি সিরিজের সংস্কৃতি যখন দুনিয়া ব্যাপী বদলে যাচ্ছে বছরে বছরে পাড়ি দিচ্ছে, ঢুকে যাচ্ছে অকল্পনীয় সব চিত্রনাট্য আর খরুচে গ্রাফিক্সের দুনিয়ায়; সেই জমানায় কোনো পুরোনো ধাঁচের ইনডোর সেট মুখর সিটকমের প্রায় এক দশক একত্রে কাটানোটা ভীষণ অসম্ভবের। কাজেই বিগ ব্যাং থিওরি’র মতো অন্য কোনো ধারাবাহিকের সাথে এমন সংলগ্নতা তৈরি হবে, সেই ভাবনা আমার মনে একটুও ঠাঁই পায় না। কী যেন কীসের লাগি মন বিষণ্ণ হয়েই চলে।

ইন্টারনেট জগতের অজস্র মেমে’র মাঝে প্রায়ই ঘুরে ফিরে হোমপেজে আসতে দেখা যায় একটাকে, কোনো দীর্ঘদিনের সঙ্গী টিভি সিরিজ শেষ হলে তরুণ দর্শক নাকি পড়ে যায় অস্তিত্বের সংকটে। ‘জীবনে কী হবে!’ জাতীয় প্রশ্ন তাকে খুবই ভারাক্রান্ত করে রাখে তখন। হাসিঠাট্টা সরিয়ে রেখে, প্রশ্নটাকে কিন্তু সত্যিই একটু গুরুত্ব দেয়া চলে। ক্যানো এক-একটা টিভি ধারাবাহিকের শেষে দর্শকের এমন অনুভূতি হয়?

কোথাও পড়েছিলাম, যখন কোনো কিছুর পেছনে মানুষ সময় ব্যয় করে, সেই বস্তুর/শখের/কাজের যথার্থতা কি শ্রেষ্ঠত্বের পেছনে অবচেতনেই শয়ে যুক্তি দাঁড় করাতে থাকে। নিজেকে তার বোঝানোর প্রয়োজন হয়, যে নিতান্ত অপ্রয়োজনে সে সময়টা নষ্ট করেনি। তা টিভি সিরিজের বেলায়ও যে দর্শকেরা এমন করবে, সেটা আর আশ্চর্য কী? যে ধারাবাহিক দীর্ঘদিন তার সঙ্গী ছিলো ড্রয়িংরুমের স্মার্ট টিভি পর্দায়, অথবা একাকী অন্ধকার ঘরের ল্যাপটপে, অথবা যাত্রাপথে ট্যাবে কিংবা ফোনে; সেই সিরিজকে যে দর্শক মহৎ ধরে নেবে এবং ফলে জীবন থেকে মহান কিছুর প্রস্থানে সে যে দুঃখ পাবে, এমন অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছতেও সময় লাগার কথা নয়।

কিন্তু তবু, বিগ ব্যাং থিওরি’র প্রস্থান মুহুর্তে দুঃখিত হয়ে ওঠার পর মনে হয়, আরেকটু খুঁটিয়ে দেখা দরকার কীভাবে একটা টিভি সিরিজ আমাদের জীবনে গুরুত্বপুর্ণ হয়ে ওঠে।

মনে হয়, একটা কারণ টিভি সিরিজের ক্ষেত্রে ডিটেইলিং-এর সুবিধা। যত দীর্ঘ হয় কোনো ধারাবাহিক, তার ক্ষেত্রে সূক্ষ ডিটেইলিং ততই বাড়ে। ফলে, ক্রমাগত বেড়ে চলে চরিত্রগুলোর প্রতি দর্শকের মনোযোগ আর সংলগ্নতা। তৃতীয় সিজনে এসে আমরা যেমন এলিভেটরের নষ্ট হবার বয়ান পেয়ে আরেকটু ভালোবেসে ফেলি অতীত দিনের শেলডন কি লেওনার্ডকে, শেষ পর্বে এসে সেই এলিভেটরকেই পুনরায় সচল হতে দেখে চক্র পূরণের একটা পুর্নতার অনুভূতিও হয় আমাদের। শেলডনের কণ্ঠে টেক্সাসের, অথবা পেনির গলায় নেব্রাস্কার আঞ্চলিক টান প্রথমে আমাদের হয়তো কিছুই বলে না; অথচ পরের দিকে এ  চরিত্রগুলোর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের গলায়ও যখন একই সুর আসে, টিভির পর্দা ছাপিয়ে দর্শকের কাছে আরেকটু বাস্তব হয়ে ওঠে ব্যাপারটা তখন।

টিভি ধারাবাহিকের সাথে দর্শকের বাঁধনে জড়িয়ে যাবার আরেকটা কারণ হলো কৃতজ্ঞতাবোধ। দীর্ঘ একটা সময় ধরে চলেছে যে সিরিজ, দর্শককে লম্বা সময় ধরে সে আমোদিতও করে গেছে। গেইম অফ থ্রোনস বা ব্রেকিং ব্যাড-এর মতো সুনির্মিত কাহিনির সিরিজের চাইতে এদিক থেকে বরং বিগ ব্যাং থিওরি’র মতো হালকা চালের সিটকমগুলোই বেশি সুবিধা পায়। বাইরের পৃথিবীতে যখন সরকারি কর্মকর্তা নাসা যাচ্ছে, পিটুনি খাচ্ছে স্কুল ছাত্র আর ক্রমাগত বঞ্চিত হচ্ছে যোগ্যরা; এদিকে টিভি পর্দায় তখন স্পেস শাটলে গিয়েও মায়ের আঁচলের গিট্টুতে দম বন্ধ হয়ে আসছে হাওয়ার্ডের, পাখির সাথে লড়াইয়ে এঁটে উঠতে পারছে না শেলডন, আর সমস্ত দুই নাম্বারিকে হারিয়ে নোবেল যাচ্ছে এমির যোগ্যতম হাতেই। বাস্তব থেকে বিগ ব্যাং থিওরি দর্শককে নিয়ে যাচ্ছে অনেক দূরে, তাকে হাসাচ্ছে, ভুলিয়ে দিচ্ছে ব্যক্তিগত অপ্রাপ্তি; সেই কৃতজ্ঞতাবোধের কারণেও টিভি ধারাবাহিককে ভালো না বেসে উপায় নেই দর্শকের।

আর, জোরালোভাবে অনুধাবন করি, কোনো টিভি সিরিজের বিদায়ে নয়, আমরা আসলে বিষাদ অনুভব করি সেই টিভি সিরিজের রাজত্বকালের স্মৃতির জন্য। এক দশক আগে যে কিশোর শুরু করেছিলো কোনো সিরিজ দেখা, আজ সে দাঁড়িয়ে আছে যৌবনের অনেকগুলো প্রশ্ন নিয়ে। যে তরুণী চোখ রেখেছিলো টিভি ধারাবাহিকের প্রথম দৃশ্যে, আজ শেষ দৃশ্যের প্রচার মুহুর্তে পৃথিবীর অনেক অন্যায্য আঘাত তাকে করে তুলেছে অন্য কোন মানুষ। মাঝ যৌবনের দর্শক এখন মধ্যবয়েসের এদিক-ওদিক চলে গেছেন মনের রঙ হারিয়ে। কোনো টিভি ধারাবাহিকের শেষ দৃশ্য আসলে নিয়মিত দর্শকের কাছে জীবনের ফুটবল মাঠের হুইসেল; একদিকে সে বিগত নব্বই মিনিটের ফলাফল মনে করায়, অন্যদিকে সতর্ক বাণী দেয় ছাড়ে, যে সময় ফুরিয়ে আসছে। টিভি সিরিজের বিদায়ে বিষণ্ণতাটা হাজারগুণে বাড়িয়ে তোলে স্মৃতির জন্য মানুষের ওই চিরন্তন আকুলতাই।

প্রতিটি ভালো টিভি-ধারাবাহিকই তাই দর্শকের কাছে এক যাত্রা, যার সূচনা বিন্দুতে বিগ ব্যাং থিওরির প্রথম পর্বের মতোই থাকে পাশের ফ্ল্যাটের মোহময় সুন্দরী পেনির হাতছানি। আর দীর্ঘ একটা সময় যদি দর্শক সত্যিই থাকে কাহিনির পাশে, নিজের সংকটকে ভুলে গিয়ে যদি সত্যিই লেওনার্ড কি রাজ কি হাওয়ার্ডের মতো পছন্দের চরিত্রগুলোর সংকটকে সে আপন করে নেয়; তবে শেষ পর্বে গিয়ে তার জন্য থাকে শেলডন কুপারের মতোই আত্মউপলদ্ধি। আমরা তা-ই, যে ছাঁচে আমাদের বন্ধুরা আমাদের গড়ে নেয়। এবং বন্ধু তারাই, যারা নিঃস্বার্থ ভাবে অনেক কথা আর অনেক স্মৃতি দিয়ে যায় আমাদের।

কিন্তু মনে রাখা দরকার যে পৃথিবীটার সাথে সাথে ছোটো হয়ে গেছি আমরাও, আমাদের জগত তাই মাঠের কি আড্ডার বাইরে অনেকাংশেই চলে এসেছে নানারকম বোকাবাক্সের পর্দায়। একবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগের ভিজ্যুয়াল মিডিয়া ভারাক্রান্ত সময়ে দাঁড়িয়ে, বন্ধুর সংজ্ঞাটা কিন্তু খেটে যায় টিভি সিরিজদের জন্যেও। কেবল সময়ের বিনিময়ে তারা আমাদের দিয়েছে বহু কথা, বহু স্মৃতি; বন্ধুর মতোই।

আর বন্ধুর প্রয়াণে দুঃখ বোধ করা মানুষেরই ধর্ম। নিজে যতই হোক অনুল্লেখ্য আর মৃদু মানুষই হই আমরা, একবিংশ শতাব্দীর অজস্র বিষাদের সমুদ্রে পছন্দের টিভি-সিরিজের বিদায়ে কয়েক কিলোবাইট দুঃখের শিশির দান করতে, আমাদের তাই আটকায় না।

[আগস্ট, ২০১৯]