ব্ল্যাক বুক ঠিক দ্রুত পড়ার মতো উপন্যাস নয়। এমনিতেই ওরহান পামুকের গদ্যের গতি তরতর করে পড়ার মত লাগে না কখনোই, সেটার স্বাদ নিতে এগোতে হয় ধীরে ধীরে। ব্ল্যাক বুকের অধ্যায়গুলো বেশ বড়, কখনো কখনো পাতার পর পাতা চলে যায় একটি অনুচ্ছেদেই, বাক্যেরা জটিল রুপে কেবল প্যাঁচিয়েই চলে বহু জায়গায়। ফলে ব্ল্যাক বুকের ভেতরে ঢুকতে পাঠকের সময় লাগে বেশি। মনোযোগ হারিয়ে অনেকেই চলে যাবে- সেই আশঙ্কাও থাকে।
কিন্তু গোয়েন্দা ঘরানার এই উপন্যাসের হাত যে পাঠক মাঝপথে ছেড়ে দেয়নি, পামুকের অনুসন্ধানে আস্থা রেখে যারা কড়া নেড়ে গেছে উত্তরাধুনিক এই বয়ানের দরজায়, নড়েচড়ে বসার অজস্র উপাদান তারা সংগ্রহ করতে পারে সাড়ে তিনশো পাতা পেরিয়ে যাবার পরে। উপলদ্ধি আর প্রশ্নের সিন্দাবাদি বুড়ো পাঠককে বিচলিত করে তোলে তখন।
উপন্যাসটা শুরু হয় গোয়েন্দা কাহিনির মতোই। কেন্দ্রীয় চরিত্র গালিব একজন আইনজীবী, শৈশব থেকে সে ভালোবেসেছে তার চাচাতো বোন রুয়াকে। এই দুজনকে বাদ দিলে উপন্যাসের তৃতীয় প্রধান চরিত্র জালাল, সম্পর্কে সে রুয়ার বৈমাত্রেয় ভাই, আবার কলাম লেখক হিসেবেও ইস্তানবুলে লোকটা পেয়েছে কিংবদন্তীর খ্যাতি। সত্যি বলতে, ওই লোকটাকে গালিব বেশ হিংসাই করে। কাহিনির শুরু হয় সেদিন, যেদিন গালিবের উদ্দেশ্যে চিরকুট লিখে রুয়া পালিয়ে যায় বাসা থেকে, আবার একই সময়ে উধাও হয় জালালও, তাকে খোঁজা শুরু করে খবরের কাগজের লোকজন। স্ত্রী প্রেমে আচ্ছন্ন গালিব তখন এই দুজনের অন্তর্ধানের রহস্যভেদ করতে শুরু করে অনুসন্ধান, তার ধারণা হয় পত্রিকার পাতায় দিনের পর দিন ধরে লিখে যাওয়া জালালের কলামগুলোতেই আছে নিরুদ্দেশ দুজনের হারিয়ে যাওয়ার ঠিকানা। পরবর্তী আটদিন ধরে তাই ইস্তানবুলের সিনেমা হল, নাইট ক্লাব আর অজস্র অলিগলিতে চলে গালিবের অনুসন্ধান।
নিরুদ্দিষ্ট রুয়ার নামের অর্থ – স্বপ্ন। নিজের আর শহরের সত্যিকারের পরিচয়ের সন্ধানে ছুটে চলা গালিবকে, উত্তরাধুনিক এই উপন্যাসের বর্ণনার জোরে, আমাদের প্রায়ই যেন মনে হয় স্বপ্নের ভেতর হারিয়ে যাওয়া কেউ। নিজের অস্তিত্ব আর পরিচয় নিয়ে ঘাঁটতে ঘাঁটতে একসময় গালিব নিজেকে বসিয়ে নেয় জালালের চরিত্রতেই। এবং, রুয়ার অতি পছন্দের গোয়েন্দা গল্পগুলোর মতোই, ব্ল্যাক বুক উপন্যাসের শেষেও ঘটে একজোড়া খুন। সেগুলোর পেছনে কে আছে, জালালের ভূমিকায় অভিনয় করা গালিবের সাথে টেলিফোনে যে লোক আলাপ করেছে, সেই মানুষটাই কি? ঠিক নিশ্চিত হওয়া যায় না। বরং গালিব যেমন রুয়াকে বলেছিলো, যে সে এমন গোয়েন্দা উপন্যাস পড়তে চায়, যেখানে লেখক নিজেই জানে না খুনি কে; তেমন উপন্যাসের মতোই হয়ে ওঠে ব্ল্যাক বুক। পুরো উপন্যাসে, পামুক এমন সব সূক্ষ খেলা বহুবার দেখিয়েছেন পাঠককে।
গোয়েন্দা কাহিনির আদলকে আশ্রয় করে লেখা এই উপন্যাসের অনেকগুলো অধ্যায় পত্রিকার কলাম আকারে লেখা। রচনারীতির এই নিরীক্ষাকে পাশ কাটিয়ে পাঠক তবু ভাবে যে এই উপন্যাস আসলে কীসের গল্প উচ্চারণ করে? এটা কি গালিবের অসুখী একপেশে ভালোবাসার গল্প? না, সে ধারণা পামুক ভেঙে দেন আরো একবার তার প্রিয় প্রসঙ্গ আর প্রশ্নটাকে উপন্যাসের পাতায় তুলে এনে, যখন উপন্যাস ব্ল্যাক বুক গল্প হয়ে ওঠে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের ঠোকাঠুকির।
ম্যানিকুইন নির্মাতা বুড়ো মানুষটা যখন জালালের লেখা কলামের মধ্য দিয়ে আমাদের জানান দেয় যে এই আধুনিক হয়ে ওঠা ইস্তানবুলে কেউ আর পছন্দ করে না পুরোনো যুগের তুর্কি পোশাক সজ্জিত পুতুল, আমরা তখন আবিষ্কার করি যে এই সংকট কেবল তুরস্কের নয়, পুরো পৃথিবীই যেন আজকে আধুনিক হয়ে উঠতে চাইছে পাশ্চাত্যের দেয়া সংজ্ঞায়, তাদের দেয়া মাপেই সকলে ভালোবাসছে পোশাক থেকে সিনেমা পর্যন্ত সবকিছু। ইস্তানবুলের রোদ আর তুষারপাতের রাস্তা থেকে উঠে আসা গালিব যেন এ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে হঠাৎ করেই হয়ে ওঠে আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগতে থাকা বিশ্বের অজস্র মানুষের প্রতীক।
এবং এই পরিচয়ের প্রশ্নটাকে আরো গভীর স্তরে পামুক নিজেই নিয়ে যান উপন্যাসের শেষ দিকে, যখন গালিব শুরু করে জালালের পরিচয়ে কলাম লেখা। কলাম লিখে নিন্দা ও প্রশংসা দুটোই পেয়েছে জালাল, কিন্তু গালিব যখন প্রবেশ করতে চায় তার এই আত্মীয়ের অস্তিত্বের ভেতরে, সে তখন দেখতে পায় জালাল নিজেও তার লেখার জন্য ঋণী হয়ে আছে নানা উৎসের কাছে। তবে গালিবের পরিচয় এখন তাহলে কী? সে কি জালাল, না অন্য কেউ? আশ্চর্য এই প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে উপন্যাসের পাঠক আবিষ্কার করে, যে পৃথিবীর সমস্ত কিছুর মতোই সেও মৌলিক নয়। যে লেখা আমরা পড়ি, যে তৈজস আমরা ব্যবহার করি, যে নারীকে আমরা ভালবাসি; আমাদের প্রত্যেকের আত্মপরিচয় বিলীন হয়ে গেছে সেসবের মাঝে।
ধাক্কা মারা এসব প্রশ্নের সাথে উপন্যাস ব্ল্যাক বুক তুলে ধরে তুরস্কের ইসলামী সাহিত্যের ঐতিহ্য। অন্য অনেক মুসলিম দেশের মতোই পাশ্চাত্যের শিক্ষায় শিক্ষিত তুর্কি জনগোষ্ঠী যখন সরে এসেছে তাদের পূর্বসুরীদের তৈরি করা সংস্কৃতির পথটা থেকে, পামুক তখন ফরিদউদ্দিন আতর, শামসেত তাবরিজি বা রুমী থেকে কৌতূহল জাগানো সব ঘটনা দিয়ে পাঠককে আকৃষ্ট করতে চেয়েছেন ইসলামের বিভিন্ন মতবাদ বা পুরাণের দিকে। আবার সূফীতত্ত্ব বা হুরুফিজমের মতো মতবাদ থেকে বিভিন্ন প্রতীক টেনেও ইস্তানবুলের বুকে হন্য হয়ে ঘোরা গালিবকে দু’দণ্ড শান্তি দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন তিনি।
গোয়েন্দা কাহিনির মোড়ক নয়, বর্ণনার অভিনব শক্তি আর অননুকরণীয় ভাষার সৌন্দর্য্যেও নয়; ব্ল্যাক বুক উপন্যাসকে পাঠক মনে রাখবে কেবল ঐ প্রতীকেরই জন্য। পুরোটা উপন্যাস জুড়ে পামুক ছড়িয়ে রেখেছেন অজস্র অসমাপ্ত গল্প, বহু প্রতীক, অনেক অনুচ্চারিত ইঙ্গিত। রুয়ার প্রাক্তন স্বামী যেমন স্পষ্ট করে বলে যে সিনেমা হলো তুর্কিদের ইতিহাস ভুলিয়ে দেবার জন্য পশ্চিমা ষড়যন্ত্র বিশেষ, তখন পাঠকের মনে হয় এই ঘটনা কোনো প্রতীক। আবার উপন্যাসের শেষ ভাগে যখন আবিষ্কৃত হয় যে জালালও ক্রমশ হারিয়ে ফেলেছে তার স্মৃতি, তখনো পাঠকের মনে হয় যে এই বিস্মৃতি আসলে সামষ্টিক; পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে সম্পূর্ণ প্রাচ্যেরই নিজেকে হারিয়ে ফেলার প্রতীক। উপন্যাসের কোনো অধ্যায়ে ম্যানিকুইন দেখতে গালিব চলে যায় সেই অন্ধকার পাতালঘরে, আবার পরের অধ্যায়েই হয়তো সে উঠে আসে ইস্তানবুলের উঁচু কোনো মিনার চূড়ায় আর সান্নিধ্য পায় এমন এক রমণীর, যে সারাজীবন তাকে চেয়েছে। এই বৈপরীত্য, এই আরোহন-অবরোহন; আমাদের ফিরে ফিরে মনে করায় পাতাল থেকে দান্তের স্বর্গ গমনের কাহিনি। আর প্রতীকী এসব যাত্রায়, ইস্তানবুলের অন্ধকার সব পতিতালয় থেকে ফিটফাট সব নাইট ক্লাবের আলো আঁধারিতে, গালিবের সাথে সাথে পাঠক প্রত্যক্ষ করে অন্য এক শহর আর জীবনকে। যে শহর আমাদের তবু আমাদের নয়, যে জীবন আমাদের তবু তা যেন অন্য কোনো ভুবনের।
এক-একটা প্রাসাদোপম বাড়ির মতো পামুকের প্রতিটি উপন্যাসকে চট করে আলাদা মনে হয় না অন্য দশটা জমিদার বাড়ি কি রাজনিবাসের পাশে। কিন্তু একত্র করে ওপর থেকে তাকালে পামুকের উপন্যাসের পুরো জগৎটা যখন দৃষ্টিসীমায় আসে, রুপ আর প্রাচুর্য তখন চোখে রীতিমতো সানলাইট ব্যাটারি লাগানো টর্চ মারে। আর আগ্রহী পাঠক আবিষ্কার করতে পারে, ব্ল্যাক বুক সেই উপন্যাস, যেখানে ওরহান পামুক খুঁজে পেয়েছেন তার নিজের জগত সৃষ্টির চাবিকাঠি।
[১৬ জুলাই, ২০১৯]
সময়নিউজ
nice