রিয়াল মাদ্রিদের কাছে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে লিভারপুল হেরে বসার পরের বিকালটায় আমি বেরিয়ে পড়ি মেমেন্টো পার্কের দিকে। একলাই, কারণ জাপানি এক রেস্তোঁরায় খানিক আগে দেড় সপ্তাহ পরে ভাতের সান্নিধ্যে এসেছে বলেই হয়তো, আমার সফরসঙ্গী রিফাত আলম শরীর ম্যাজম্যাজের অজুহাত দেয় এবং টার্কিশ বাথ নেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। কিন্তু সফর পরিকল্পনায় বুদাপেস্টের দর্শনীয় স্থান হিসেবে মেমেন্টো পার্ক আমার তালিকায় বেশ উপর দিকেই আছে, সেই জায়গা দেখার সুযোগ আমি কিছুতেই ছাড়বো না।

কিন্তু গুগল ম্যাপ আর হাতের ট্যুরিস্ট গাইডের নির্দেশনা দেখে মেমেন্টো পার্কে যাবার পথ নিয়ে ধাঁধা লাগে আমার, তেমন পরিষ্কার কোনো ধারণা পাওয়াই যায় না। খানিক ভেবে আমি তাই চলে যাই হোস্টেলের গলির মোড়ে। গতকাল থেকেই খেয়াল করেছি, বিভিন্ন বাস কোম্পানির হয়ে আগ্রহী টুরিস্টদের কাছে নানারকম পাস (Pass) আর টিকেট বিক্রি করছে হাস্যজ্বল তরুণ তরুণীরা, কিছু না কিনলেও এদের কাছে তথ্য চেয়ে কেউ ফিরে আসে না। আমি দ্বারস্থ হয়ে যাই ওরকমই একটা তথ্যকেন্দ্রের। মেমেন্টো পার্কে যেতে চাই আমি, কীভাবে যাবো?

একটা অদ্ভূত রকম নিরুৎসাহ দেখা যায় তথ্যকেন্দ্রের ভলান্টিয়ারদের মুখে।

একজন নিজে চেনে না জায়গাটা কোথায়।

মেমেন্টো পার্ক? সে তো বহুদূর! পৌঁছানো তো খুব কঠিন! বলে নিরুৎসাহিত করে এক যুবক। আর ওখানে গিয়ে দেখার মতোই বা কী আছে?

তীব্র রোদের মাঝে গন্তব্যে-যেতে-রাজি-না-হওয়া-রিকশার প্রতি ক্ষোভে চোয়াল শক্ত দশা হয় আমার। বলি, নাহ, মেমেন্টো পার্কে আমাকে যেতেই হবে। একটু দেখোই না, কেউ যাবার রাস্তাটা বলতে পারে কি না।

তথ্যকেন্দ্রের পেছন দিকে আরাম করে মোবাইল ঘাঁটছিলো আরেকটু দামড়া এক তরুণ। কয়েক মিনিটেও আমার নড়নচড়ন নেই দেখে সে এগিয়ে আসে এবার, জানতে চায় ঘটনা কী।

তাকে সব বুঝিয়ে বলে দেই আমরা তিনজন। ছেলেটি খানিক ভাবে, তারপর আমায় জানায় যে অল্প দূরের একটা বাস স্টপেজের বোর্ডে মেমেন্টো পার্কের নামটা সে দেখেছে এক কালে। আমায় সে পথ বাতলায় ওই বাস স্টপেজের।

দুপুর চারটার রোদ পিঠে নিয়ে খানিক চেষ্টার পর আমি খুঁজে পাই বাস স্টপেজটা। হ্যাঁ, মেমেন্টো পার্কের রুটে বাস এখান থেকেই ছাড়ে, তবে দিনে মাত্র দুবার। আজকের দিনের শেষ বাসটা ছেড়ে গেছে ঘন্টা খানেক আগেই। তবে আগ্রহী পর্যটকের জন্য হতাশ হবার কারণ নেই। কারণ, ভেঙে ভেঙেও যাওয়া সম্ভব মেমেন্টো পার্কে। এই স্টপেজ থেকে অল্প দূরেই ট্রামের একটা স্টপেজ রয়েছে, যাত্রা শুরু করা যাবে সেখান থেকেই। আমি হাঁটা দেই নির্দেশনাটা অনুসরণ করে।

নির্দিষ্ট ট্রামে দশ মিনিট যাত্রার পরে নিজেকে আবিষ্কার করা যায় শহরতলীতে। বাস স্টপেজের নির্দেশনাটির ছবি তুলে নেয়া আছে মোবাইলে, সেটা অনুসরণ করায় আমি ইতোমধ্যেই জানি, আশপাশে আরো একটা বাস স্টেশন আছে, মেমেন্টো পার্কে যেতে হলে চাপতে হবে ১০১-বি নম্বর বাসে।

কিন্তু জায়গাটা শহরতলী। ট্রাম থেকে নামা আমার সহযাত্রীরা উধাও হয়ে গেছে আশপাশের বিভিন্ন গলিতে, অল্পক্ষণ পরেই নিজেকে আমি খুঁজে পাই ফাঁকা একটি চত্বরে, একদিকে কীসের যেন উঁচু দেয়াল, অন্যদিকে খুবই দৈন্য দশার কয়েকটা দোকান, কিছু পুরোনো ধূলো জমা গাড়ি। আমি ছাড়া অন্য কোনো মানুষ নেই। ঠ্যাক দেয়ার জন্য পরিবেশটা রীতিমতো আদর্শ বলে আমি পা চালাই একটু জোরে। চত্বরটা একটু পেরিয়ে গেলেই অবশ্য আবার মানুষ। একটি পিচ্চি সম্ভবত তার দাদীর হাত ধরে চলছে, গাড়ি মুছছে এক লোক, তার পাশে দাঁড়িয়ে আরো দুইজন। বাস স্টপেজের নির্দেশনার জন্য আমি এগিয়ে যাই তাদের দিকে।

দুটি পুরুষ এবং একটি মহিলা আমার কথায় এগিয়ে আসে বটে, তবে সাহায্য অ্যাতো সহজে আসে না। এরা কি ইংরেজি জানে না, নাকি আমারই বাঙাল ভাষার ইংরেজি এরা বুঝতে পারে না? অতঃপর আমি তাদের মোবাইলের ছবিটি দেখিয়ে বাসের সন্ধান করি। এবার দাঁত বেরিয়ে আসে মহিলাটির। ভ্রমণক্লান্ত এক ব্যাক্কল পর্যটককে সাহায্য করার উদারতা দেখানোর সুযোগ জীবনে সে বেশি পায়নি বোঝা যায়, সে আমায় জানায় যে সামনে ডানে একটা আন্ডারপাস পড়বে, সেটা দিয়ে বেরোলেই বাস স্টপ। আমি মানুষগুলোর দিকে একটু ভালোমতো লক্ষ করি। পোশাকে এদের অর্থাভাবের চিহ্ন বেশ স্পষ্টই, মূল বুদাপেস্টের তরুণেরা যেমন অবিরাম ইংরেজি উচ্চারণ মারাচ্ছে, তার তুলনায় এদের ইংরেজিটাও বড্ড দুর্বল। এদের একটা আন্তরিক ধন্যবাদ দিয়ে আমি পা চালাই আন্ডারপাসের উদ্দেশ্যে। অ্যাতোক্ষণ ধরে কালো বাঙালি দেখতে তাকিয়ে থাকা পিচ্চিটা খিকখিক করে হাসে।

আন্ডারপাস দিয়ে বেরোলেই অবশ্য মহাখালিকে আবিষ্কার করা যায়। বিশাল এক বাস স্টপেজ, তবে শহরের বাইরে বলেই হয়তো ভিড় একদমই কম। নানারকম বোর্ডের ঘোষণা মিলিয়ে আমি এসে দাঁড়াই দারুণ রোদ্গ্রস্থ ফাঁকা রাস্তার নির্দিষ্ট স্টপেজে। আমি জানি, ১০১-বি নম্বর বাস আসতে ১৫ থেকে ৩০ মিনিট সময় নেবে।

কপালটা ভালো, ৭-৮ মিনিট যেতে না যেতেই হাজিরা দেয় ১০১-বি নম্বর। আমি তড়িঘড়ি করে উঠে পড়ি বাসে, ড্রাইভারকে হাতের মোবাইল দেখিয়ে নিশ্চিত জানতে চাই এই বাহন মেমেন্টো পার্কে যাবে কি না। ড্রাইভার হাসিমুখে বলে, পেছনে গিয়ে বসে পড়ো, আধঘন্টার মতো সময় লাগবে।

আমি আশ্বস্ত হয়ে বসে যাই বাসের অ্যাকেবারে পেছনে। বাস ছেড়ে দেয়। আমাদের চট্টগ্রাম-রাঙামাটি পথের মতোই খানিক পরপর বাঁক, তবে রাস্তাটা সমতল। পথের যেদিকে তাকাও, চারপাশে কোমর পর্যন্ত উঁচু ঘাস ছাড়া আর কিচ্ছু দেখা যায় না। মেমেন্টো পার্ক তবে শহরের বাইরে এমন একটা দুরতিক্রম্য জায়গায় এনে ফেলা হলো?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ব্লকে চলে আসা হাঙেরির ওপর রাশানদের চাপিয়ে দেয়া সমাজতন্ত্র চলেছে ১৯৪৯ থেকে ১৯৮৯-এ বার্লিন দেয়াল ভাঙা পর্যন্ত। বুদাপেস্ট এমনিতেই চমৎকার সব ভাস্কর্যের শহর, সোভিয়েতরা সেই শহরের নানা জায়গায় গড়ে তুলেছিলো তাদের প্রলেতারিয়েত আদর্শে ভরপুর সব স্মারক। মজদুর মেহনতি মানুষ, অথবা সর্বসহা কিন্তু বিপ্লবে প্রেরণাদায়িনী মা, অথবা লেনিন কি স্তালিন কি মার্ক্স। ১৯৮৯’তে ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ হবার পর হাঙেরিয়ানরা সেইসব ভাস্কর্য সরিয়ে নগদে সরিয়ে নেয় তাদের মূল শহর থেকে,  সোভিয়েত সৈন্যরা হাঙেরি ত্যাগ করার পরে পরিত্যাক্ত সব ভাস্কর্যে সমন্বিত জায়গাটাকে একটা উদ্যানই বানিয়ে ফেলা হয়, মেমেন্টো পার্ক। সমাজতন্ত্রের স্মারক দেখতে উন্মুখ হয়ে থাকা আমি তাই বাস কখন পৌঁছবে মেমেন্টো পার্কে, সে অপেক্ষা করে যাই।

গন্তব্যে পৌঁছে বাস থেকে নামতেই সুতীব্র রোদের থাপ্পড় হজম করতে হয়, বেলা এখন পাঁচটার কিছু বেশি, ইউরোপের গ্রীষ্মের সুবিধা নিয়ে সন্ধ্যা নামবে আরো প্রায় ঘণ্টা চারেক পর। ভেবেছিলাম এই ভরবিকালে মেমেন্টো পার্কের স্টপেজে  কেবল আমিই নামবো, কিন্তু আবিষ্কার করি, আরো জনা চারেক লোক আমার সঙ্গী। দেখেই বোঝা যায় এরা একই পরিবারের সদস্য। একজন বয়স্ক লোক, সাথে তিনটি ছেলেমেয়ে, বড় ছেলে এবং মেয়েটি প্রায় আমারই বয়েসি হবে। মেমেন্টো পার্কের দরজার দিকে হাঁটতে হাঁটতে এদের দিকে তাকিয়ে আমি অল্প হাসি, তারাও সাড়া দেয়।

পার্কে ঢুকতে পয়সা লাগে না। প্রবেশ পথে ছোট একটা ঘর, মোটাসোটা একটি মহিলা আমাদের স্বাগত জানিয়ে হাসে, সোভিয়েত যুগের নানারকম স্মারক সে বিক্রি করছে। একটু নজর বুলাই জিনিসগুলোতে। লাল কাস্তে সমন্বিত টুপি, ব্যাজ, লেনিন আর মার্ক্সের নানারকম ভাষণ বা উক্তির পুস্তিকা, পোস্টার; এসব দেখতে দেখতে কানে আসে পাইওনিয়ার কিশোরদের উদ্দীপ্ত করা গান। আগ্রহ না পেয়ে আমি এগিয়ে যাই।

এই দোকান ঘরটির পেছনে একটি ছোট্ট ছাউনি, সেখানে বসার কয়েকটা এলোমেলো চেয়ার। এরপরেই ভাস্কর্য সমন্বিত মেমেন্টো পার্ক। অবাক হয়ে দেখি, আমি এবং সহযাত্রী সেই চারজন ছাড়া পুরো পার্কে আর কেউ নেই।

পার্কে ঢুকতেই গা ঝলসে যায় রোদে। পুরো ইউরোপ ভ্রমণে যা পাইনি, সেই অদ্ভুত ব্যাপারটি লক্ষ করি এই উদ্যানের নির্মাণ পরিকল্পনায়। ভাস্কর্যগুলো দাঁড় করানো একদম নগ্ন সূর্যালোকে।

অদ্ভুত এক উদ্যান। অন্যান্য পার্কে সচরাচর যা থাকে,তার কিছুই এখানে নেই। ভাস্কর্যগুলো বাদে অন্য কোনো ভবন নেই, কোনো গাছ নেই, কোনো আইসক্রিম বিক্রেতা,বসবার বেঞ্চ; কিচ্ছু নেই। শুধু শুন্যতার মাঝে পড়ে আছে পরিত্যক্ত সব ভাস্কর্য পড়ে আছে। রুগ্ন ও ভঙ্গুর সব পাইয়োনিয়ার, কর্তব্য পালন করতে গিয়ে হেঁদিয়ে পড়া সোভিয়েত সৈনিক যে কাউকে আর উদ্দীপ্ত করতে পারছে না,একা হয়ে পড়া লেনিন।

আমি একটু অন্যরকম লাগা মূর্তিদের কাছে যাই, সেটার নিচে লেখা বর্ণনা পড়ি, ছবি তুলি ভালো লাগলে। কিন্তু ভয়ানক একাকী এই পরিবেশে বেশিক্ষণ হাঁটাচলা করবে কে? অবসন্ন লাগে আধঘন্টা পরেই।

memento park.jpg

দারুণ ক্লান্ত হয়ে আমি ফিরে আসে ছাউনিতে, চার সদস্য বিশিষ্ট পরিবারটির বড় দুই ভাই-বোনও এখানে আশ্রয় নিয়েছে। ঘামতে ঘামতে হাতের বোতলটা থেকে পানি খেতে খেতে আমি জানতে চাই তারা কোত্থেকে এসেছে এখানে। উত্তর আসে, সুইডেন।

কিন্তু আমার কৌতূহল অনিঃশেষ। অন্যান্য পর্যটকদের মতো শহরের চমৎকার সব স্থাপনায় না গিয়ে এই ধ্যাদ্ধেরে গোবিন্দপুরে ক্যানো এসেছে এরা, এই মেমেন্টো পার্কে?

ছেলেটি ইংরেজিতে কথা বলতে আটকে গেলে বোনটি তাকে রক্ষা করে। ভাঙা ইংরেজিতে সে বলে, আমার দাদু সোভিয়েত সেনাবাহিনীতে ছিলেন, বুদাপেস্টেও থেকে গেছেন অনেকদিন। এখানে আসবো শুনে দাদু বলেছিলেন জায়গাটা একবার দেখে যেতে।

আমাদের সকল কথা ফুরিয়ে যাই এরপর। আমি আর কিছু বলার উৎসাহ পাই না। দুই ভাইবোন কখন যেন নীরবে উঠে যায় আমার পাশ থেকে। আমি বসে বসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি একঘেঁয়ে, ক্লান্তিকর, কামড় মারা রোদের দিকে।

বেরোতে গিয়ে চোখে পড়ে, ছোট্ট স্যুভেনির শপটার যেদিকে উদ্যান, তার উল্টোদিকেও একটা দালান রয়েছে। ওয়েস্টার্ন সিনেমার র‍্যাঞ্চের মতো একতালা বাড়িটা, কাঠে বানানো। সেটার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সুইডিশ পরিবারের ছোটমেয়েটি এখন বেশ কায়দা করে সেলফি তোলে। এটা আবার কী? জানার জন্য আমি এগিয়ে যাই।

দরজা ঠেলে র‍্যাঞ্চের ভেতরে ঢুকে আবিষ্কার করি, এটা আদতে একটা যাদুঘর। ভেতরে নানা রকম ছবিতে ধরা আছে, ১৯৫৬ সালের অভ্যুত্থানের গল্প। রেড আর্মির শাসনের বিরুদ্ধে পুরো পূর্ব ইউরোপে প্রথম বড় ধরনের অভ্যুত্থান হয়েছিলো এই  বুদাপেস্টেই, ছাত্রদের দাবি দিয়ে আন্দোলন দিয়ে শুরু হলেও খুব দ্রুতই সেটা রুপ নেয় গণআন্দোলনে। পলিট ব্যুরোর লোকজন প্রথমদিকে একটু নতজানু ভাব ধরলেও, হেলমেট পরিহিত জাস্টিস লীগের বদলে শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত সেনাদের নামিয়ে দেয়া হয় আন্দোলন দমনে। ঠিক ছয়দিন পর আড়াই হাজার সাধারণ মানুষের লাশের ওপর দিয়ে আবারো সোভিয়েত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পায় হাঙেরিতে, পরের তিন দশকের জন্য সেটা আর আলগা হয়নি।

মেমেন্টো পার্কের যাদুঘরটিতে সেই আন্দোলনকেই ধরা আছে নানা ছবিতে, আর আছে স্তালিনের বুটজোড়ার একটা ভাস্কর্য। ১৯৫৬ এর আন্দোলনে জনতা যখন উপড়ে ফেলেছিল পার্লামেন্ট ভবনের সামনে রাখা স্তালিনের মূর্তি, সেটার বেদিতে তখন অবশিষ্ট ছিলো কেবল বুটজোড়া। সেই বুটজোড়াকেই আলাদা ভাস্কর্য বানিয়ে ঠাঁই দেয়া হয়েছে এই অন্ধকারাচ্ছন্ন যাদুঘরে। একটা সিনেমাও চলছে অনবরত, লাইফ অফ অ্যান এজেন্ট। ভয় দেখিয়ে, ব্ল্যাকমেইল করে নানা পেশার মানুষকে কীভাবে সোভিয়েত আমলে গুপ্তচর বানিয়ে নজর রাখতে বাধ্য করা হতো তার স্বজনদের ওপর, সেটা নিয়েই নির্মিত একটা ডকুমেন্টারি। খানিকক্ষণ সেটা দেখে আমি বেরিয়ে আসি।

এরপর আবার সেই বাস স্টপেজ, এবার ফিরতি বাসের অপেক্ষা। আবার আমার সাথে সেই চারজনের পরিবারটি। তাদের দিকে তাকিয়ে বলি, ক্যামন দেখলে? দ্যাখার বেশি কিছু তো নেই এখানে।

বড় ছেলেটি সায় দেয়। হ্যাঁ, দ্যাখার বেশি কিছু নেই। একটু থেমে আবার বলে, মনে রাখার মতো কিছু নেই।

ঘটনাহীন ও প্রায় নীরব এক ফিরতি যাত্রার শেষে দানিয়ূবের তীরে একটা বেঞ্চে বসে আমিও আবিষ্কার করি ঘণ্টা দেড়েক পর, সত্যি, মনে রাখার মতো কী-ই বা আছে মেমেন্টো পার্কে? অমন আগ্রহ নিয়ে সমাজতন্ত্রের স্মারক দেখতে ছুটে যাওয়া আমি কিছুই মনে করতে পারি না তীব্র রোদ ছাড়া।

এরপর থেকে যতবার স্মরণ হয়েছে বুদাপেস্টের কথা, মনে পড়েছেই মেমেন্টো পার্ককে। মনে পড়েছে সেখানে যাবার বিঘ্নিত যাত্রা, মনে পড়েছে তীব্র রোদের তাপ। সমাজতন্ত্রের প্রতি এক ধরনের মোহ নিয়ে সেটাকে দেখতে চেষ্টা করেছি বহুবার, এবং মোহ কেটে যাবার পর চেষ্টা করেছি মানুষ কীভাবে আজও অনুবাদ করে সমাজতন্ত্রের শাসনকে, সেটি বোঝার। আজ দিনভর স্তালিন নাটক নিয়ে নানামুখী আলোচনায় মেমেন্টো পার্কের বিকালটি আমার কাছে ধরা দেয় অন্যরকম অনুবাদে।

পর্যটকের মতোই আগ্রহ নিয়ে একদা সমাজতন্ত্রের দিকে ছুটে গেছে মানুষ, পথ চেনা তাদের জন্য সহজ ছিলো না। মোবাইলের পর্দার মতো সহায় ছিলেন মার্ক্স-এঙ্গেলস, কিন্তু অপ্রতুলতা ছিলো নির্দেশবিধির আর বাহনের। তবুও একান্ত গণমানুষের হাত ধরে, একে-তাকে জিজ্ঞেস করে সমাজতন্ত্র পৌঁছে গেছিলো নির্দিষ্ট গন্তব্যে। কিন্তু যাত্রাপথের ঝক্কিটা আগ্রহী মানুষকে করেছে ক্লান্ত, এবং অজস্র স্বপ্নের রোদে পোড়া মূর্তির মাঝে সে আবিষ্কার করেছে তার প্রতিনিধিত্ব এখানে কিছুতেই নেই। শিক্ষার অবকাঠামোগত বিপ্লব বা নারীর অগ্রগতি বা সামন্তবাদ উচ্ছেদের যে স্যুভেনির সে পেয়েছে সমাজতন্ত্রের দোকানে, সেটার আকর্ষণ উবে গেছে স্তালিনের রোদ্রস্নাত বুটজোড়ায়।

বহু জায়গায় সাফল্য হয়তো ছিলো সোভিয়েতের চাপানো সমাজতন্ত্রে, কিন্তু ব্যর্থতা তার গণমানুষকে সম্পৃক্ত না করায়। গনগনে সূর্যের মতো তাদের কামড়ে যাওয়ায়। ব্যাপারটা কাকতালীয় নয় যে আজও যখন মানুষ সমাজতন্ত্রের স্মারক খোঁজার যাত্রাটি মনে করে দ্যাখে ইতিহাসের পাতা উলটে, তীব্র ক্লান্তিকর রোদ ছাড়া কিছুই তখন তার খেয়াল হয় না।

[জুন, ২০১৯]