প্রিয় লেখকের প্রতি পাঠকের প্রেম হয় দুই ঘরানার। এক ধরনের লেখককে পাঠক ভালোবাসে কেবল তাদের লেখার মাধ্যমে। আরেক রকম প্রিয় লেখকের প্রতি ভালোবাসাটা জমে অক্ষরের বাইরে, লেখার প্রতি লেখকের নিবেদনের প্রগাঢ়তা অনুভব করে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আমার কাছে প্রথম ঘরানার লেখক, দ্বিতীয় ধারার লেখক হিসেবে মনে আসে ওরহান পামুকের নাম। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা সতীনাথ ভাদুড়ীর মতো কেউ কেউ একই সাথে আবার দুই নৌকায়ও পা রাখেন।

তো বাংলাদেশের মতো জায়গায়, পাঠকগোষ্ঠীর আয়তন যেখানে যথেষ্ট বড় নয়, সংবাদ মাধ্যম যেখানে ডুবে রয় নিজস্ব বুদবুদে আর প্রকাশনা ব্যবসা দাঁড়িয়ে থাকে নানা ধরনের ফাঁকির ওপর ভিত্তি করে; তেমন এক দেশে বাস করেও মনোরঞ্জনের সাহিত্যের প্রতি উন্নাসিকতা নিয়ে কেবল জীবন ঘষে আগুন বের করে লেখার প্রতি নিবেদন দেখাচ্ছেন বলে, হামিম কামালের প্রতি আমার অনুরাগ দ্বিতীয় ঘরানায় পড়ছে। পরিচয় আছে বলেই লেখক হয়তো রেগে উঠবেন তাকে প্রথম দলে না রাখায়, এবং কেউ কেউ হয়তো ক্ষেপেও উঠবেন ওই ব্যক্তিগত পরিচিতির সূত্রে আমার পছন্দকে দুই নম্বরি মাল ভেবে। কিন্তু যিনি সত্যি সত্যি লিখতে চান, তিনি জানেন,  তার প্রতিটি অক্ষরকেই উল্টেপাল্টে দেখা হবে মহাকালের কাস্টমসে, এবং পকেটে মিথ্যা থাকলে তাকে ফিরে আসতেই হবে সেই দরজা থাকে। বিগ ব্রাদার আর অগণিত স্মার্টফোনের তীব্র তীক্ষ্ণ নজর এড়িয়ে, মিথ্যা বলার ঝুঁকি এই জমানায় তাই, নিতান্ত অদূরদর্শী না হলে নেয়া যায় না।

hamim.jpg

তবে সেসব আলোচনা অন্যদিন, আজ দৃষ্টি নিবন্ধ করি হামিম কামালের ওপরে বরং। আলোচনার আওতাটা নির্দিষ্ট করা যায় তার সোনাইলের বনে গল্পগ্রন্থের দিকে। এই সংকলনের পাণ্ডুলিপির জন্য জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার-২০১৮ পেয়েছে বলেই লেখক খানিক ফাঁপরে পড়ে, কারণ বইপাড়ার মনোযোগী পাঠক এবার আরেকটু মনোযোগী দৃষ্টি ফেলে তার ওপর। মোস্তাফিজ কারিগরের করা প্রচ্ছদে শোভিত হয়ে সোনাইলের বনে যখন মলাটবদ্ধ কাঠামোয় সুলভ হয়ে ওঠে কাগজ প্রকাশনা থেকে, সেটি সংগ্রহ করতে পাঠকের তখন তাই আটকায় না।

বইতে গল্প রয়েছে পাঁচটি। প্রেমিক হিমালয়, কুক্কুট, শেকল, শিল্পী, সোনাইলের বনে। কী আছে গল্পগুলোয়? গল্পের ব্যাপারে বলতে গিয়ে ক্ষেত্রে কাহিনীর ইঙ্গিত দেয়াটাকে ঠিক পছন্দ করে না বলে পাঠক বরং সাধারণভাবে তাকিয়ে দেখে, যে মিশ্রণ অনুপাতে সংকলনটি বেশ সুষম। কাহিনী আর অনুভূতির যোগসাজশে ছোটগল্পের চিরন্তন পরিচিত চিহ্নটি যেমন আছে, আছে হালকা রসের উপস্থিতিও; এবং হামিমের আছে একেবারে নিজের গৃহপালিত একটি ভাষা। পাঠক ভেদে কারো কাছে সেটা পুডল আর কারো কাছে সেটা বুল টেরিয়ার বলে গণ্য হতে পারে; কিন্তু ভাষাটি যে লেখকের সম্পূর্ণ পোষমানানো, তা নিয়ে সন্দেহ চলে না।

কিন্তু এসব স্থূল বৈশিষ্ট্যর আড়ালে, প্রচ্ছন্ন ভাবে বেড়ে ওঠে এই সংকলনের মূল ধারণাটি; দর্শন নিয়ে হামিমের চিন্তা। সময় না থাকলে অপেক্ষাও যে থাকে না, চূড়ান্ত দ্বিমত বা আঘাতের মুহুর্তেও দুটি মানুষের মাঝে কার্যকর থাকে প্রেম, জগতের সমস্ত জীবন আর জড়ের মাঝে বিরাজমান কোনো অদৃশ্য শেকল; এমন সব ভাবনায় তাই সংকলনটার পাতায় পাতায় গড়ে ওঠে একটি দর্শন অরণ্য। আর জানা আছে সকলেরই, অরণ্য হতে পারে যথেষ্ট প্রহেলিকাময়, যদি পথচারী থাকেন অসতর্ক।

প্রচলিত রাজনীতি এসব গল্পে উপেক্ষণীয়, প্রচলিত প্রেমের লুতুপুতু ভাবটাও চোখে আসে কম। হামিম দেখাতে চেয়েছেন যে দর্শনের মাঝেই ফোটানো যায় বিবাদের রাজনীতিকে, প্রেমকেও ব্যাখ্যা করা সম্ভব দর্শনের দৃষ্টি থেকেই। মানুষ এবং জড় বস্তুজগতের অস্তিত্বের যে ঐশ্বরিকতা, সেদিকে বেশ মনোযোগ দিয়ে গল্পকার চেষ্টা করেছেন একটা বিশেষ সত্য বা দর্শনের দিকে পাঠকের মুখ ফেরাতে। চেষ্টাটা সহজ নয়। পাঠকের কখনো কখনো মনে হতে পারে এটাও যে, এই দর্শন বয়ানের জন্য শুষ্কপ্রাণ প্রবন্ধই বরং হতো ভালো। কিন্তু হামিম দেখান, যে লেখক যদি চেষ্টা করেন তবে আঙ্গিকের ভাঙাগড়া করে দর্শনকেই তিনি প্রতিষ্ঠা করতে পারেন গল্পের চেনা রুপে। সংকলনের সেরা গল্প শেকল তাই হয়ে ওঠে অভূতপূর্ব, এবং দর্শন ক্লাসের ভারি প্রফেসরের ভুরু কুঁচকানো ছাড়াই ঢুকে যেতে পারে পাঠকের বুকে। শিল্পী গল্পটিও অবশ্য পড়তে বেশ ছিমছাম। জায়গায় জায়গায় বেশ দীর্ঘ হয়ে না পড়লে, সোনাইলের বনে গল্পটাও ভালোভাবে সংহত থাকতো।

এমন টুকরো সব অসন্তোষের আগাছা কি গুল্ম আর দর্শন বৃক্ষে ভরপুর হয়ে থাকে সোনাইলের বনে। চট করে পড়ে ফেলবার সুখ সে পাঠককে দিতে চায় না, ভাবাতে চায়, ফলে তাতে ঝুঁকিও থাকে। পাঠকের জন্য ঝুঁকিটা নিরাশ হবার, লেখকের জন্য ব্যর্থতার। কিন্তু এটাও তো সত্য, যে নতুন কিছু আবিষ্কারের জন্য পাঠককে ঝুঁকি নিতেই হবে; আর সে লেখকই হয়ে ওঠেন মহৎ, যিনি ঝুঁকি নিতে সাহস করেন।

[মার্চ, ২০১৯]