সিসলিতে- সারাটা জীবন যে জেলায় আমি কাটিয়েছি, যে তিনতলা বাড়িতে আমার দাদী কাটিয়েছেন জীবনের চল্লিশটা বছর, ঠিক তার উল্টোদিকের এক আদালতে আগামী শুক্রবার আমাকে দাঁড়াতে হবে আদালতের কাঠগড়ায়। আমার অপরাধ, তুর্কী জাতীয়তাবাদের অনুভূতিতে প্রকাশ্যে আঘাত করা। সরকারি কৌসুলি আমার তিন বছরের জেল চাইবেন। হয়তো আমার দুশ্চিন্তা করা উচিৎ; কারণ এই আদালতেই, একই অপরাধের দায়ে আর্মেনিয়ান-তুর্কি সাংবাদিক হারান্ত দিঙ্ককে দাঁড়াতে হয়েছিলো, এবং সংবিধানের ৩০১ নম্বর ধারায় তিনি দোষী প্রমাণিত হয়েছিলেন। কিন্তু আমি আশাবাদী। উকিলের মতো আমিও মনে করি যে আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগটা দুর্বল, মনে হয় না আমার জেলে যেতে হবে।

তবে আমার বিচারকে ঘিরে যে নাটকীয়তা দেখা যাচ্ছে, তাতে আমি বেশ বিব্রত বোধ করছি। খুব ভালোমতো জানি, যে জীবনের বিভিন্ন সময়ে আমি ইস্তাম্বুলের যে সব বন্ধুর কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করেছি, তাদের জীবনের একটা বড় অংশই হারিয়ে গেছে কঠোর জিজ্ঞাসাবাদের মুখে, মামলার হয়রানিতে আর জেলের ভেতরে; শুধুমাত্র বইয়ের কারণে, শুধুমাত্র কিছু একটা লেখার কারণে। মামলা অথবা জেলের ভাত না খেলে এখানে লেখকদের কোনো দাম নেই, অথচ উঠতে-বসতে সালাম দেয়া হয় পাশাদের, ধর্মগুরুদের, পুলিশদের। এমন একটা দেশে বাস করে আমি তাই, আদালতের ডাক পেয়ে মোটেও বিস্মিত নই। বন্ধুরা যখন আজকাল হাসিমুখে বলে যে অ্যাতোদিনে আমি একজন সত্যিকারের তুর্কি লেখক হতে পেরেছি, আমি তাদের ঠাট্টাটা বুঝতে পারি। কিন্তু ব্যাপার হলো, যে কথা বলায় আমি আজ বিপদে পড়েছি, সেটা উচ্চারণের সময় এই বিরল সম্মান অর্জন আমার উদ্দেশ্য ছিলো না।

২০০৫ সালে, সুইস এক সংবাদপত্রে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আমি বলেছিলাম, এই তুরস্কে এক লাখ ত্রিশ হাজার কুর্দিকে হত্যা করা হয়েছে। অভিযোগ করেছিলাম, যে ওই প্রসঙ্গে এখানে কথা বলাও নিষিদ্ধ একটা ব্যাপার।  দুনিয়ার সমস্ত ইতিহাসবিদরা জানেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় প্রচুর অটোমান আর্মেনীয়কে এখান থেকে উৎখাত করা হয়েছে, এবং পথ মধ্যেই এদের অনেককে হত্যা করা হয়। তুরস্কের মুখপাত্ররা, যারা মূলত কূটনীতিক, মৃতের সংখ্যাকে আজও ইতিহাসবিদদের দাবিকৃত পরিমাণের চেয়ে কমিয়ে বলেন। বলেন যে এই হত্যাযজ্ঞ জেনোসাইড নয়- কারণ এটা পরিকল্পিত ভাবে হয়নি। এবং বলেন, যুদ্ধে আর্মেনিয়রাও প্রচুর মুসলিমকে মেরেছে।

গত সেপ্টেম্বরে, রাষ্ট্রের বাধা সত্ত্বেও, ইস্তাম্বুলের তিনটি স্বনাম-খ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়, যৌথভাবে আয়োজিত এক সম্মেলনে এমন কিছু বক্তাকে আমন্ত্রণ জানায়, যারা এই প্রসঙ্গে সরকারি ভাষ্যের বিপরীতে দাঁড়াতে ভয় পাননি। সংবিধানের ৩০১ নাম্বার ধারা মাথায় নিয়েও, নব্বই বছরে এই প্রথমবারের মতো বিষয়টা নিয়ে জনসমক্ষে আলোচনা হলো।

অটোমান আর্মেনিয়ানদের সাথে কী ঘটেছে, তুরস্কের জনগণের কাছ থেকে তা চেপে রাখতে রাষ্ট্র যেহেতু খুব উদগ্রীব, আমার কথায় তাই যথেষ্ট আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছে। আমার বিপক্ষে অনেকগুলো পত্রিকা সরব হয়েছে, তাদের ডানপন্থী (যাদের সকলেই ইসলামিস্ট নয়) কলাম লেখকরা আমাকে সারাজীবনের জন্য চুপ করবার উপদেশ মারছেন; উগ্র-জাতীয়তাবাদীরা আবার আমার বিশ্বাসঘাতকতায় ক্ষুণ্ণ হয়ে মিটিং-মিছিল শুরু করে দিয়েছেন, আমার বই পোড়ানো হয়েছে প্রকাশ্যে। আমার স্নো উপন্যাসের নায়ক কা-এর মতো আমি আবিষ্কার করেছি, রাজনৈতিক মতের কারণে প্রিয় শহর ছাড়তে কী রকম লাগে। বিতর্কের আগুন নতুন করে উস্কে দিতে চাইনি বলে, এমনকী এ বিষয়ে কিছু শুনতেও চাইনি বলে, আমি চুপ করে ছিলাম। এক ধরনের লজ্জা আমাকে অধিকার করেছে, আর মানুষের- এমনকী নিজের লেখার থেকেও আমি পালিয়ে ছিলাম। এরপর জনৈক প্রাদেশিক গভর্নর আমার বই পোড়ানোর হুকুম দিলেন, আমি সিসলিতে ফেরার পর সরকার বাদী হয়ে আমার বিপক্ষে মামলা করলো, এবং আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম আন্তর্জাতিক মনোযোগের আওতায়।

কেবল ব্যক্তিগত বিদ্বেষের কারণে আমার নিন্দা কেউ করছে না, তাদের বিরোধিতা কেবল আমার দিকেই প্রকাশ পায়নি, আমি জানি যে সমস্যাটা নিয়ে কথা হচ্ছে, তুরস্কের ভেতরে-বাইরে সর্বত্রই সেটা আলোচনার দাবি রাখে। আমি বিশ্বাস করি, ইতিহাসের কলুষিত অধ্যায় নিয়ে আলোচনা করলেই কোনো জাতির ‘সম্মান’-এর হানি হয় না, সম্মানের হানি হয় সেটার ওপর আলোচনায় নিষেধাজ্ঞা জারি করলে। আমি এও মনে করি, যে অটোমান আর্মেনিয়ানদের নিয়ে আলোচনা করায় যে নিষেধাজ্ঞা, সেটি তুরস্কের বাকস্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপের সমান, এই দুটো বিষয় পরষ্পরের খুব ঘনিষ্ঠ। যারা সহৃদয় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ, কিন্তু এমন সময়ও গেছে, যখন মনে হয়েছে আমার দেশ আর বাকি দুনিয়ার মাঝখানে আমি আটকা পড়ে গেছি।

কিন্তু যে দেশটি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে প্রবেশ কবার জন্য সরকারিভাবে আবেদন করেছে, ব্যাখ্যা করাটা কঠিন, যে ঠিক কী কারণে তারা এমন একজন লেখককে জেলে ঢোকাতে চাইছে, যার লেখা বই ইউরোপে বেশ পরিচিত। এবং এই খেলাটা তারা খেলছে, (যেমনটা কনরাড বলেছিলেন) পশ্চিমা চোখের সামনে। ঈর্ষা, অসহনশীলতা বা জ্ঞানের অভাব বলে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া যায় না। আবার আরো কিছু প্রশ্নও থাকে। জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলগুলো যখন আমায় নিয়মিত মেরে ফেলবার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে, সে অবস্থায় দাঁড়িয়ে আমি কোন মুখে বলবো, যে তুর্কি লোকজন পাশ্চাত্যের মতো শীতল নয়, তারা কোনো ধরনের গণহত্যা করতেই পারে না?  যে রাষ্ট্র প্রতিনিয়ত তার লেখকদের একের পর এক বিচার করছে, জেলে দিচ্ছে; অর্থাৎ নিজের এক ধরনের ভীতিকর রুপ দুনিয়া জুড়ে তুলে ধরছে, সে কোন যুক্তিতে অভিযোগ করবে যে তার অটোমান ইতিহাসের বিরুদ্ধে ইচ্ছা করে সবাই মিথ্যা অভিযোগ করছে? আমার পরিচিত এক অধ্যাপক ছিলেন, তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো তুরস্কের সংখ্যালঘুদের নিয়ে একটা প্রতিবেদন তৈরি করতে। তিনি সেই রিপোর্ট প্রস্তুত করেছিলেন, এবং সেটা রাষ্ট্রকে খুশি করতে পারেনি বলে তাকে যেতে হয়েছিলো জেলে। অথবা, এই লেখা যখন আমি শুরু করেছিলাম এবং এখন যে বাক্যটা লিখছি, এই সময়ের মধ্যে ৩০১ নম্বর ধারায় পড়ে আরো পাঁচজন লেখক আর সাংবাদিকের গ্রেপ্তার হবার সংবাদ এসেছে। এসব যখন দেখি, তখন ভাবি, যে ফ্লবের বা নারভাল, যারা ওরিয়েন্টালিজম-এর অন্যতম দুই প্রবক্তা, তারা নিশ্চয়ই এসব কাণ্ডকে অদ্ভুতুড়ে বলে আখ্যা দিতেন।

এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। যে নাটক আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমার মনে হয়, তা কেবল তুরস্কের কাছেই উদ্ভট বা ব্যাখ্যাতীত নয়, বরং আধুনিক পৃথিবী নতুন করে আমাদের কিছু একটা বলতে চাচ্ছে। এবং মনোযোগ যেমন-ই হোক, এই বক্তব্য আমাদের শুনতেই হবে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা ভারত আর চীনের অভূতপূর্ব একরকমের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেখেছি, এবং দুটো দেশেই মধ্যবিত্তের সম্প্রসারণ হয়েছে খুব দ্রুত। তবে, এই পরিবর্তনের পেছনে দায়ী যে মানুষগুলো, উপন্যাসের পাতায় এদের ব্যক্তিগত জীবন দেখার আগে আমার মনে হয় না যে তাদের আমরা পুরোপুরি বুঝতে পারবো। যে- নামেই এদের ডাকেন, প্রাচ্যের বুর্জোয়া বা সমৃদ্ধ আমলাতন্ত্র,  এই মানুষগুলো আমার দেশের পশ্চিমা-রীতি অনুসরণকারীদের মতোই, নিজেদের নবলদ্ধ টাকা আর ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য দুটো পরষ্পরবিরোধী কাজ করে। প্রথমত, নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধির যৌক্তিকতা দেখাতে সে পাশ্চাত্যের ভাবভঙ্গী অনুকরণ শুরু করে, এরপর পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজ দেশের মানুষের মাঝে সেটা প্রচলন করার চেষ্টা করে। কিন্তু মানুষ যখন তাদের পুরোনো ঐতিহ্য থেকে সরে যাবার জন্য কথা শোনায়, এই লোকগুলো তখন অসহনশীল আর উগ্রতা ভরা একটা জাতীয়তাবাদের প্রচার করে। বাইরে থেকে একজন পর্যবেক্ষক এই ঘটনাগুলোকে অদ্ভুতুড়ে বলতে পারেন, কিন্তু এই দ্বন্দ্ব আসলে দেশের মানুষের এক ধরনের আকাঙ্খার প্রকাশ, রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি মিলে মিশে যেটার জন্ম দিয়েছে। একদিকে আছে বিশ্ব অর্থনীতির বাইরে অবস্থানের স্থবিরতা, অন্যদিকে উগ্র জাতীয়তাবাদের উন্মেষ যেটা ভাবে প্রকৃত গণতন্ত্র আর চিন্তার স্বাধীনতা আসলে পশ্চিমা অস্ত্র।

প্রাচ্যের এই নির্মম ও খুনে প্রকৃতির মধ্যবিত্ত শাসকশ্রেণির ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ঔপনিবেশিক যুগে প্রথম যারা নাড়াচাড়া করেছেন, তাদের মাঝে অন্যতম হলে ভি এস নাইপল। জাপানি লেখক কেনজাবুরো ওয়ে’র সাথে যখন কোরিয়ায় আমার আলাপ হয়, শুনেছি, যে তার দেশের সেনাবাহিনী কোরিয়া আর চীন আক্রমণের সময় যে জঘন্য অপরাধগুলো করেছিলো- এই নিয়ে টোকিয়োতে খোলামেলা আলোচনা হবার প্রস্তাব দিয়ে তিনিও উগ্র জাতীয়তাবাদীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছিলেন। চেচেন আর অন্যান্য সংলঘু, কিংবা অধিকারকামী সংস্থাদের বিরুদ্ধে রাশিয়া যে সহনশীলতার অভাব দেখিয়েছে, বাকস্বাধীনতার ওপরে ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা যা করেছে, চীন যা করছে উইঘুরদের জাতিগতভাবে নির্মূল করতে গিয়ে-   সব কিছুর মূলেই ওই দ্বন্দ।

ভবিষ্যতের ঔপন্যাসিক যখন এই নবসৃষ্ট ধনিকশ্রেণির ব্যক্তিজীবন নিয়ে লিখবেন, কোনো সন্দেহ নেই, মতপ্রকাশের বিষয়টা তাদের রাষ্ট্র যেভাবে সীমিত করছে, সেটির বিপরীতে পাশ্চাত্যকে তারা পাশে চাইবে। কিন্তু ইরাক যুদ্ধ আর সিআইএ’র গোপন কারাগারের বিষয়ে একালের যত প্রতিবেদন, তুরস্কে পাশ্চাত্যের বিশ্বাসযোগ্যতা তারা অ্যাতোই নামিয়ে দিয়েছে যে দুনিয়ার এই অংশে পশ্চিমা গণতন্ত্রের হয়ে দুটো কথা বলা- আমার মতো লোকদের জন্যে হয়ে গেছে কঠিন থেকে কঠিনতর।

[অরহান পামুকের Other Colors গ্রন্থ থেকে, On trial নামের মুক্তগদ্যের অনুবাদ]