ছোটগল্পের নিজস্ব একটা ব্যাকরণ আছে। উপন্যাস যেখানে বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে পাঠকের মনে ঢুকে পা চালায়, ছোটগল্পকে সেখানে হতে হয় এ কালের টি-টোয়েন্টি; চমক বা খোঁচা বা কিল খেতে না পারলে পাঠক বেশ দ্রুত বিস্মৃত হন এমনকি গত কালের পাঠ। কিন্তু এটাও সত্য যে ভালো ছোটগল্পের সাথে সাক্ষাত পাঠকের খুব সহজেই হয় না। আর পোষ মানানো গল্প, যারা আঘাত করতে খুব একটা উৎসাহী নয়- তাদের সাথে আলাপ করেও শান্তি নেই। আশরাফ জুয়েলের রাষ্ট্রধারণার বিরুদ্ধে মামলা ও বিবিধ গল্প নামের সংকলনটি নিয়ে তাই, মনে হলো কিছু কথা বলে ফেলা যায়।
আমার ওপর বন্ধু রিশাদের চিরকালের ক্ষোভ, যে কারণে ছোকরা একদিন গল্পকারের রাগে তপ্ত এক ডজন গল্পের সংকলনটি আড্ডার ছলে হাতে দিয়ে বলে, ‘পড়ে দ্যাখো, ক্যামন লাগলো জানিয়ো।’
রিশাদের আদেশ শিরোধার্য বলে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আজ পড়ে ফেললাম সংকলনটা। মনে হলো, আমাদের অজস্র অভিযোগ বয়ে নিয়ে রাগী ও অসুখী স্বরে গল্পকার আশরাফ জুয়েল ধুয়ে দিচ্ছেন রাষ্ট্রকে। কখনো বকায়, কখনো গালিতে।
মাসুক হেলালের করা প্রচ্ছদ থেকে চেয়ে রয় এলোমেলো, রঙিন, ছিন্নবিচ্ছিন্ন কিছু মানব অঙ্গ। কিন্তু এসব ছেঁড়াফাটা মানুষের মামলা কি আদালত গ্রহণ করবে? বিশেষত আসামী যখন স্বয়ং রাষ্ট্র? সমস্যাটা গুরুতর। এবং সে কারণেই বুঝি আশরাফ জুয়েল শব্দ নিয়ে বেশ কেরদানি করেন। অভিযোগমালা তার বেশ স্পষ্টই, কিন্তু পটভূমি সাজাতে গল্পকার কখনো পরাবাস্তবে যান, আবার কখনো বেছে নেন নিরেট বাস্তবকে। তবে পেছনে যাই থাকুক, ক্রমাগত নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে পাঠককে এক ধরনের দৌড়ের ওপর রেখে দেন জুয়েল। কখনো উপন্যাস বা নভেলার মতো ছোটছোট অধ্যায়ে ভাগ করে, কখনো গালভরা সব উদ্ধৃতি দিয়ে, কখনো ক্রিস্টোফার নোলানের চলচ্চিত্রের মতো সামনে- পেছনে উভয়দিক থেকেই গল্প চালিয়ে গল্পকার পাঠকের কাছ থেকে দাবি করেন অখণ্ড মনোযোগ।
নিরীক্ষার এই যে নিয়ত দৌড়তে থাকা ভঙ্গী, সেটা কোথাও জিরোয় না বলে মাঝে মধ্যেই হাঁপাতে থাকে, কাশতে কাশতে পাঠক তখন ভুরুটা খানিক কোঁচকায়। একজন ভাত ব্যবসায়ীর সঙ্গে ঘটে যাওয়া কিছু খণ্ড দৃশ্য– গল্পটা, বইয়ের যাত্রায় এমনই একটা স্টপেজ। তবে এবং সন্দেহাতীতভাবে ঘটে যাওয়া কিছু তিক্ততা আর রাষ্ট্র হবি? ঋদ্ধি– গল্পদ্বয় মিলে মিশে আবার বেশ একটা আবহ তৈরি করে, এদের যৌথ স্টপেজে দাঁড়ালে রাত্রিকালীন বাসজার্নির বিরতিতে চমৎকার এক কাপ চা’য়ের স্বাদে মনটা ভরে ওঠে।
বেশ কিছু কারণেই মনে রাখা যায় মামলাবাজ আশরাফ জুয়েলকে। পুরুষের শুক্রাণুর মতো ঝরে পড়ছে অনেক মুকুল, অথবা দিনগুলো কেটে যাচ্ছে ভাতের ফ্যানের মতো– এরকম সব কাব্যগন্ধী বাক্যের উপস্থিতি তার গল্পে বলতে গেলে থইথই করে। আর থাকে, যেমনটা আগেও বলেছি, লুতুপুতু প্রেম-পীরিতিকে লাই না দেওয়া একটা রাগত স্বর। বিবর্ণ পৃথিবীর আলোকোজ্জ্বল প্রান্তর বাদ দিলে, সংকলনের প্রতিটি গল্পেই গল্পকারের কোনো না কোনো অভিযোগ দেখা যায়। কখনো পুলিশ, কখনো পুরুষ, কখনো রাজনীতিক, কখনো সস্তা গুণ্ডা, কখনো টিভি নায়িকা- শাহবাগ চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে কারো চোদ্দো গুষ্টিকেই আশরাফ জুয়েল ছাড়েননি। অবশ্য আমাদের মানবতার পুরস্কার জেতা এবং হাত-পা বাঁধা সময়ে এই ক্ষোভগুলো ফোটে খুব ভালো। মালয়েশিয়ার নিখোঁজ বিমান থেকে স্বদেশের বাস দুর্ঘটনা, তৎপর আইএস থেকে নির্বাচনী তৎপরতা- এসব তুলে এনে গল্পকার আমাদের অসুখী সময়টার প্রতি নিজ মনোযোগ নিশ্চিত করেছেন।
এবং অবশ্যই বলতে হবে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার প্রসঙ্গে। যখনই এই অস্ত্রটি গল্পকার ব্যবহার করেছেন, তার গলার স্বরটা যথেষ্ট জোরালো হয়ে গেছে তখন। জোরালো গলাটা মনে রাখার মতো হয়ে উঠেছে জাড়-এ, শেষে ছোটগল্পের চিরন্তন সেই চমক নিয়ে হাজির হওয়া এই গল্পটা বহু বহুদিন মনে থাকবে। অনেকদিন মনে রাখার মতো হয়ে উঠতে চেয়েছিলো রাষ্ট্রধারণার বিরুদ্ধে বিবিধ মামলা গল্পটিও, কিন্তু লেখকের ব্যক্তিগত সংলগ্নতার কারণেই হয়তো, গল্পটা চট করে শেষ হয়ে গেলো যেন। বেশ ভালো লেগেছে সংকলনের প্রথম ভুক্তি, গল্পটি অসমর্থিত।
এক ডজন গল্পের মাঝে, ঘুরে ফিরে এসেছে নারী নির্যাতনের বিষয়টি। হ্যাশট্যাগ মি-টু যুগের সাথে গল্পকারের এই পর্যবেক্ষণ যথাযথ, সন্দেহ নেই, কিন্তু ক্যানো যেন কোনো গল্পেই থাপ্পড়টা জোরালো হলো না। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সেই কীটনাশকের কীর্তি গল্পটির মতো ভার ঠিকই চেপে বসেছিলো পাঠকের বুকে, তবে ধারের অভাব রয়ে গেলো।
লক্ষ করি, আরেকটা প্রসঙ্গে বেশ জোর দিয়েছেন জুয়েল। রাষ্ট্র আর দেশ-কে আলাদা সত্ত্বা হিসেবে উপস্থাপন করায়। গল্পগুলোতে রাষ্ট্র বারবার এসেছে পিতার মতো হয়ে, বদরাগী কোনো ব্যাটাছেলে হয়ে, অসৎ কোনো লুটেরা চেয়ারম্যান হয়ে। পক্ষান্তরে দেশ হয়েছে প্রেমিকা, যার সাথে শত বিপত্তির মাঝেও প্রেম করা যায়, অনেক গ্যাঞ্জামের মাঝেও কবিতা লেখা যায়। কিছুতেই আর অবাক না হওয়ার মতো পল্টিবাজি রাজনীতির যুগে, স্টেটসম্যান আর পলিটিশিয়ানের পার্থক্য স্পষ্ট করে দিতে এই চিৎকারটা আবশ্যক ছিলো।
ভাবি, গল্পগুলো নিয়ে শেষ পর্যন্ত কী উত্তর দেয়া যায় বন্ধু রিশাদকে। আমি কি জানাবো যে এই গল্পগুলো আমাদের অক্ষমতার? বলবো, যে পথের মোড়ে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে কয়েক কিলোবাইটের বিপ্লব করবার এ যুগের স্ন্যাপশট হয়ে রইলো গল্পগুলো?
পরক্ষণেই মনে হয়, বাড়তি কথা বলে লাভ নেই। স্বদেশ এবং সমকালের মাটি কোপানো লোকের সংখ্যা এমনিতেই হাতে গোণা। আশরাফ জুয়েল যদি সে কাজে আরো নিয়োজিত হয়ে পড়েন, তবে তার হয়ে সংবেদনশীল পাঠক নিজ থেকেই আদালতে হাজিরা মারতে চলে আসবেন আশা করি। আসতে না চাইলে, ব্যক্তি স্বাধীনতার এই যুগে কাউকে কানে ধরে নিয়ে আসা যায় না।
[ ৪ নভেম্বর, ২০১৮]
Leave a Reply