শেখ সাদী বা এপিজে আবুল কালামের সাথে বেইলি রোডের দেয়ালের চিকা-চিরন্তনীতে জায়গা করে নেওয়া জনৈক রেদোয়ান মাসুদ আমাদের জানান দ্যান, মানুষ যখন প্রকৃত সাফল্যের নিকটে পৌঁছে, তখনই তার ভালোবাসার মানুষটি চলে যায়। কখনো ভিকারুন্নিসা স্কুলের পাশের রাস্তায় ফুচকা খেতে আসেননি বলেই বোধহয়, উক্ত বাণীটিকে ইরানি চলচ্চিত্র পরিচালক আসগার ফারহাদির ঠিক আত্মস্থ করা হয়ে উঠে নাই। রেদোয়ান মাসুদের একশো আশি ডিগ্রি বিপরীতে দাঁড়িয়ে থেকে আসগার ফারহাদি বরং তার ‘এ সেপারেশন’ চলচ্চিত্রটি শুরু করলেন ভালোবাসার মানুষের প্রস্থান থেকে। চিবুকের কাছেও একা কয়েকটি মানুষকে নিয়ে পরবর্তী দুই ঘন্টায় এমনই এক গল্প বললেন ফারহাদি, ফুটবলের টাইব্রেকারের মতো ক্ষণে ক্ষণে দুলে গেলো দর্শকের মন। দুটি পরিবারের গল্প হয়ে উঠলো আধুনিক মানুষের চিরন্তন ট্রাজেডির অপরুপ এক ভাষ্য।
সিনেমার প্রথম সংলাপেই আইনের প্রতিনিধি বিচারক যখন বলে ওঠে, ‘আপনাদের সমস্যাটা ছোট !’; বুঝে নিতে হয়, আমাদের রক্তের ভেতরে খেলা করা ভয়ানক ক্লান্তিকর বিষণ্ণতাটি, বাদবাকি দুনিয়ার কাছে কী ভীষণ ক্ষুদ্র। কিন্তু এই সত্য আবিষ্কার করেও দর্শক কৌতূহলী হয়ে ওঠে ততক্ষণে, কারণ ১৪ বছর একত্রে সংসার করে আসা সিমিন আর নাদের দম্পতি এবার ক্যামেরার মুখোমুখি তাকিয়ে জনৈক বিচারকের কাছে বর্ণনা করছে তাদের সমস্যা। সিমিনকে দেখা যায় বিচ্ছেদ চাইতে, কারণ ইরান ছেড়ে অন্য কোনো দেশে- যেখানে জীবনযাপন আরো সহজ আর নারীর অধিকার অপেক্ষাকৃত নিশ্চিত- যাবার ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে, অথচ তার স্বামী রাজি নয় দেশত্যাগে। আলঝেইমার আক্রান্ত বৃদ্ধ বাবার যত্ন নেবার জন্য কেউ থাকবে না, এই ভাবনা থেকে নাদের দেশেই থাকতে চায়। সিমিন যদি এর জন্য তাকে ছেড়ে যায় তো যায়, এমনটাই নাদেরের মুখভঙ্গি।
জুরির উদ্দেশ্যে সরকারী কৌসুলীর স্বাগত ভাষণ শেষ, দর্শক এবার হয়ে যায় বিচারক; সে ব্যস্ত হয়ে ওঠে দোষটা কার, তা নির্ণয় করতে।
কিন্তু মানুষ দাবা খেলার গুটি নয় বলে সাদাকালো ছকে তাকে আলাদা করা যায় না, ফলে দর্শকও পড়ে যায় ঝামেলায়। বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে ১১ বছরের মেয়ে তিরমে এবং স্বামীকে ছেড়ে সিমিন চলে যায় মায়ের বাড়ি, আর ঝামেলায় পড়ে নাদের। বুড়ো এবং রোগে জর্জর বাবাটাকে দিনভর দেখে রাখা তার মতো ব্যস্ত চাকুরিজীবীর কাজ নয়, সে জন্য দরকার সাহায্য। দৃশ্যপটে তাই আগমন ঘটে গৃহকর্ত্রী রাজিয়ার, ছোট্ট মেয়ে সুমাইয়াকে নিয়ে যে প্রতিদিন ঘণ্টা দেড়েকের পথ পাড়ি দিয়ে নাদেরের বাসায় আসবে এবং দিনভর দেখে রাখবে বুড়োকে। রাজিয়ার স্বামী হোজ্জা সিনেমায় তেহরানের নিম্নবিত্ত মানুষের প্রতিনিধি। পেশায় সে জুতো মেরামতকারী, তবে মাথাগরম লোকটা বর্তমানে বেকার, তদুপরি পাওনাদারের দল তাকে অনবরত তাড়িয়ে যাচ্ছে। স্বামীকে না জানিয়েই গৃহপরিচারিকার চাকরি করতে এসেছে রাজিয়া, এবং দর্শক জেনে যায় নিজের সম্পর্কে এই মহিলা কিছু একটা গোপন রাখতে চাচ্ছে। নাদের-সিমিন দম্পতির বিচ্ছেদকে কেন্দ্রে রেখেই ‘সেপারেশন’ সিনেমাতে, রাজিয়ার আগমনের সাথে ঘটতে শুরু করে একের পর এক নাটকীয় ঘটনা।
জাফর পানাহির সাথে ভাবেগতিকে মিল খুঁজে পাওয়া যাবে, কিন্তু আসগার ফারহাদির দেখার এবং দেখানোর চোখটি অনেকটাই পাশ্চাত্যের। শ্রেণী আর লিঙ্গের বিভেদে ইরানের সমাজ যেভাবে জর্জরিত, সেটার প্রস্থচ্ছেদ করতে প্রয়োজন ছিলো অভিজ্ঞ কোনো সার্জনকে, ইরান সরকারের তীক্ষ্ণ সেন্সরশিপ হয়তো এক্ষেত্রে পরিচালক ফারহাদির সুবিধাই করে দিয়েছে।
নাদেরের স্মৃতিহীন বাপের প্যান্ট বদলের দরকার পড়ছে যখন, ধর্মভীরু রাজিয়া তখন ফোন করছে ধর্মের বিধান বাতলানো কোনো হটলাইনে, জানতে চাইছে ব্যাপারটায় কোনো পাপ হবে কি না। স্কুলের মিস যখন তিরমে’কে পড়ানোর জন্য বাসায় আসছেন, তার সমাদর তখন যথেষ্টই; অথচ গৃহকর্ত্রী রাজিয়ার সাথে ওই সৌজন্যতাটুকু না দেখালেও চলে। শ্রেণী বৈষম্যের এই ব্যাপারটা বিচারকের সামনে চিৎকার করে স্পষ্ট করে দেয় হোজ্জা। নাদের কিংবা সিমিনের মতো ভদ্রলোকের বাচ্চাদের অনুকরণে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে পারে না বলেই যে আইন তার পক্ষে নেই, এ ব্যাপারে হোজ্জা একদম নিশ্চিত। লোকটার রাগের কারণ অবশ্য যথার্থ। গাড়ি-বাড়ি ও বিত্তবৈভবের অধিকারী যে শহুরে নাগরিক শ্রেনী সৃষ্টি হয়েছে দুনিয়া জুড়ে, সিমিন-নাদের দম্পতি তার আদর্শ উদাহরণ। সারা শরীর রাগে কিড়মিড় করলেও এদের গলাটা চড়া হয় না কখনো। ছবি যতই এগোয়, দর্শক তাই ততই বিভ্রান্ত হতে থাকে নাদের-সিমিন অথবা হোজ্জা-রাজিয়া’কে আবিষ্কার করতে গিয়ে। দোষ আসলে কার?
নাদেরের অহমই কি সমস্ত গ্যাঞ্জামের মূলে? নাকি দোষটা আসলে সিমিনের, যে ভয় পায় বৈরী পরিবেশ আর নতুন জীবন শুরু করতে চায় পাশ্চাত্যের কোথাও? হয়তো দোষটা রাজিয়ার, গুঢ় একটি সত্য গোপন করে কাজে আসা, অথবা বুড়ো মানুষটার সাথে ওরকম করা তার উচিৎ হয় না। আবার মনে হয়, হোজ্জাই অপরাধী, অশিক্ষিত আর বদমেজাজী এই ছোটোলোকের বাচ্চা অযথা জট পাকিয়ে তুলছে সমস্ত পরিস্থিতিটার। পরস্পরবিরোধী এসব ভাবনায় আক্রান্ত হতে হতে দর্শক একসময় বুঝে যায়, মানুষ কেবল মুহুর্তের দাস; বিচ্ছেদ বা এরকম কোনো বিশেষ পরিস্থিতি তার সেই অন্ধত্বকে উস্কে দেয় কেবল। ‘সিমিন, সিমিন!’ বলে নাদেরের স্মৃতিহীন বাপ যত মৃদু চিৎকারই করুক, আধুনিক মানুষ তাতে সাড়া দেয় না। অহংকারের কাছে তার হৃদয় ভীষণ অসহায়।
চোখে পড়ার মতো সততা নিয়ে ফারহাদি আমাদের জানিয়ে দ্যান, সৎ থাকতে চাওয়া আমাদের শহুরে সভ্যতায় কতটা কঠিন। মানুষ দেবতা নয় বলেই তার আচরণ সকল সময়ে ক্ষমার যোগ্য নয়। বিপদে পড়লেই তাদের শেষ আশ্রয় হয়ে ওঠে আইন, কিন্তু তারা আবিষ্কার করে যে আইনী ব্যবস্থার মাঝে মানবিকতা বলতে কিছু নাই, আইনের কাছে তার ব্যক্তিগত অসহায়ত্ব মূল্যহীন। আইনের রক্ষকেরা নাদের বা হোজ্জার ব্যক্তিগত অহমের আর্তি শোনে না, কেবল ঠাণ্ডা স্বরে শান্ত হবার উপদেশ মারে। তবে চোখে পড়ার মতো ব্যাপার, এই যে শ্বাসরোধী এক ধরনের বাক্সের মাঝে আটকে গেছে মানুষ, সেটার উপলদ্ধিতে পুরুষের চেয়ে নারীই যেন অধিক সক্ষম।
বিশেষ করে বলতে হবে নাদের-সিমিনের মেয়ে তিরমে’র কথা। চরিত্রটিতে অভিনয় করেছে পরিচালকের কন্যা, এবং সিনেমার যত নাটক- দর্শক সেগুলো মূলতঃ দেখেছে তিরমে’র পাশে দাঁড়িয়েই। ১১ বছরের এই মেয়েটির কাছে তার চারপাশের বড় হয়ে যাওয়া মানুষেরা বড্ড বেশি চায়। অথচ একের পর এক ঘটনায় এই কিশোরীর মনে যে ঝড় চলেছে, সে বিষয়ে তার বাপ-মা থেকে শুরু করে ছবির দর্শক পর্যন্ত সকলেই রয়ে গেছে বড্ড উদাসীন। মেয়েটি যে তার বাপ-মা’য়ের মাঝে সমঝোতার একটি যন্ত্রের বেশি কিছু নয়, বাবার আদেশে পেট্রোল পাম্পের বিক্রেতার সাথে তিরমে’কে তর্ক করতে নামিয়ে দিয়ে পরিচালক ফারহাদি সেই বিষয়টা আমাদের কাছে স্পষ্ট করেন।
২০১২ সালে বিদেশি ভাষার সেরা চলচ্চিত্র বিভাগে অস্কার জিতেছিলো ‘এ সেপারেশন’, আসগার ফারহাদি ওই একই সম্মাননা আবারো পেয়েছেন বছর পাঁচেক পরেও ‘দ্যা সেলসম্যান’ ছবির জন্য। সেই সিনেমাটিও আগেই দেখে ফেলায় নিজের আনাড়ি চোখেও বেশ বুঝতে পারি, কী অদ্ভুত বৈপরীত্য ফারহাদির দুই গল্পের মাঝে। নিতান্তই দুই পরিবারের গল্প, অথচ মাহমুদ কালারির সিনেমাটোগ্রাফি আর হায়েদে সাফিয়ারির সম্পাদনা মিলে দুইটি ঘন্টা রীতিমতো যেন উড়ে যায়, পর্দা থেকে চোখ সরানো যায় না টানটান উত্তেজনার জন্ম দেয়া ঘটনাপ্রবাহে।
পশ্চিমা দেশগুলোর অনুকরণে যে শহুরে সমাজ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্য আর এশিয়ার এদিকটায়, ফ্রেমের পর ফ্রেমে তাদের একটা অসুখী রুপ তুলে এনেছেন ফারহাদি। সিনেমার মূল চরিত্রগুলোকে প্রায়ই ধরা হয়েছে সিঁড়ি, জানালা অথবা দৈনন্দিন জীবনের অন্যান্য সব নিত্য ব্যবহার্য আসবাবপত্রের ফাঁক দিয়ে। নাগরিক জীবনের সাথে তাদের এই যে সংলগ্নতা, সেটাই সিমিন-নাদেরের জীবনযাপনকে করে তুলেছে কঠিনতর। নাদেরের বৃদ্ধ পিতার কনুইয়ের ফাঁক গলে যখন সিমিনকে দেখানো হবে, তখন যেন আসগার ফারহাদি আমাদের মনে করিয়ে দেবেন ক্লাস নাইনের সামাজিক বিজ্ঞান, মানুষ তার নিকটবর্তী প্রতিটি মানুষের সাথে সম্পর্কের এক জটিল জালে আটকানো।
গল্পের শেষে দর্শক এই সত্যই আবিষ্কার করবে পুনরায়। কিশোরী তিরমে যখন বিচারকের মুখোমুখি হবে, মেয়েটির কান্নাভেজা চোখ আমাদের তখন জানাবে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া তার হয়ে গেছে, এবার তাকে উচ্চারণ করতে হবে বেদনাদায়ক কোনো সত্য। সিনেমার দর্শক তখন ফিরে যায় গল্পের নামকরণে। শত চেষ্টাতেও প্রকৃত বিচ্ছেদ অর্জন রয়ে যায় মানুষের অসাধ্য, তবু আমরা নিজস্ব অনুভূতির অস্পষ্ট অনুবাদ দ্বারা সেপারেশনের অর্থ করে তুলি বিচ্ছেদ।
শেষ দৃশ্যে অপেক্ষমান নাদের এবং সিমিন তাই অবস্থান করে প্রথম দৃশ্যের চাইতে যথেষ্ট দূরে। তবে তারা মুক্ত হতে পারলো কি না, সে প্রশ্নটা ধাক্কা মারে অনেকক্ষণ।
[২৯ অক্টোবর, ২০১৮]
Leave a Reply