অলিয়ঁস ফ্রসেজে’র জ্যাজ সন্ধ্যায় দলবল নিয়ে বাজাবেন রাহিন ভাই- খবরটা সরবরাহ করে রিশাদ। শুক্রবার সকালে পামুকের এক জীবনের উপন্যাস-ভাবনার পথে আমি তখন হাঁটছি, তার মাঝেই সন্ধ্যার আমন্ত্রণটা বড় ভালো লাগে। ঢাকা শহরের জটিল জীবনচক্রের গোলকধাঁধার আরো একটি নতুন গলি কি রাজপথের মোহে আমি সাড়া দিয়ে বসি রিশাদের ডাকে।
আসন স্বল্পতার ভয়ে রিশাদকে টিকেট কেটে নিতে হলো বিকেলেই, কিন্তু আমি আর রেজা এদিকে লাটের ব্যাটা, বাজানো সাড়ে সাতটায় শুরু হবে জেনে তার আগেই ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারলেই আমাদের চলে।
ঘন্টা খানেক আগে যাত্রা শুরু করেও অকুস্থলে যেতে যেতে সাতটা আমার বাজে, কিন্তু মেজাজের বারোটা। চিরকালের সময়ানুবর্তী রিশাদের দ্যাখা নাই, ফোন করে এটাও মনে হলো যে ছোকরা এখনো বাসা থেকেই বেরোয়নি। আর ওদিকে ইউটিউবের আজাইরা জিনিস দেখতে দেখতে কাজের ভান করে অফিস থেকে বেরোতে রেজাও দেরি করছে। সব মিলিয়ে, এসব লেট লতিফের প্রতি মেজাজ এমন গরম হয় যে আমি চোখ পাকিয়ে যাত্রীছাউনিতে বসে চারপাশ দেখি।
একজোড়া দোকানের মাঝে বসে থাকা দোকানদারটি রীতিমতো সব্যসাচী, বামহাতের ভ্যানে সে চানাচুর-মিছরি আর ডানদিকেরটায় মোজা-গেঞ্জি-চিরুণী-আয়না-চাবির রিং বেচে। কখনো ট্রাফিক পুলিশ শালা এসে সেখানে থেকে একটি চিরুণী তুলে নিয়ে নিজের ঘর্মাক্ত চুলে প্রয়োজনীয় অপারেশন করে দোকানির সাথে খোশগল্প জমায়। আশি টাকা রিকশা ভাড়া শুনে খুব হতাশার মুখভঙ্গি করেও প্রেমিকাকে নিয়ে রিকশায় চাপে ভোটকা কিসিমের এক যুবক। ধানমন্ডির গলি থেকে মীরপুর রোডে প্রবেশাধিকার পেতে ব্যস্ত গাড়িদের ফাঁক গলে রাস্তা পেরোয় একজোড়া দুঃসাহসী বুড়ো-বুড়ি। এদিকে তাকালে পিৎজা হাট লেখা লালরঙা নিয়ন বোর্ড, ওদিকে তাকালে কনকর্ডের দালান প্রায় নিঃস্তব্ধ। একের পর এক রিকশা আর গাড়ির চাকা আমার দৃষ্টি লুফে নিয়ে এগিয়ে যায়।
রিশাদ এসে হাজির হয় সোয়া সাতের কিছু পর। আমার বকা থেকে বাঁচতে ছেলেটা সাথে করে নিয়ে এসেছে রুম্পাকে। সাথে এরা কে? রিশাদের আরো দুই কাজিন। আমার ক্ষমাশীলতার শীতল ছায়ায় আসা মাত্রই ছোকরা সাথের বনলতা সেনদের পাঠিয়ে দেয় ভেতরে। থাকে শুধু আধা-অন্ধকার আর রাজপথের ভেতরে ঢোকা গলিতে অল্প এগোলেই মিলে যাওয়া চায়ের দোকান।
চা খেতে খেতে ছোকরা নানা গুলতাপ্পি মারে। জ্যাজ সঙ্গীতে সে যে একজন সমঝদার, ঢাকা শহরের চিকিৎসক সমাজ যে আজকাল তার ওপরে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে- এমন সব বকোয়াজি যথেষ্ট ধৈর্য্য নিয়ে একটিমাত্র শ্রোতাকে শুনতে হয়। তবে আমাকে রক্ষা করতে চায়ের কাপের মাঝপথে এসে পড়ে রেজা। নাইপল-পাঠে মুগ্ধ এই ছোকরা লেট করলেও বেয়াদপ নয়, আমার পরিচ্ছন্ন জুতোজোড়ার প্রশংসা সে বেশ সময় নিয়ে করে। সস্তা এসব কায়দা আমার ওপর কাজ করে না ঠিকই, তবে ছোটলোক নই বলে রেজাকে এক কাপ চা আমি খাওয়াতে ছাড়ি না। আর ঘড়ির কাঁটাও ততক্ষণে সাড়ে সাত ছুইঁ-ছুঁই। আমরা তিনজন তাই ঢুকে যাই অলিয়ঁস ফ্রসেজ চত্বরে।
পুরোনো দিনের সিঁড়ি বেয়ে উঠলে চোখে পড়ে দেয়ালে ঝোলানো সীন নদী কি নটরডেম গির্জা কি আলেক্সান্দার সেতু। এসব ছবির গায়ে নাম লেখার দরকারটা কী? এদের আমি চিনি বহুদিন, বহুকাল হতে। জাঁ ভালভার সাথে আমি সেই সুদূর শৈশবে জার্ডিন দ্যু লুক্সেমবার্গে দৌড়েছি, মাসুদ রানা আমায় নিয়ে গেছে মার্সেই বন্দরের কোনো আঁশটে গন্ধ হোটেলে। পুরানো এসব স্মৃতি ফিরিয়ে আনা এই সন্ধ্যায় জ্যাজের সুর কি তবে আমাদের আজ উপহার দেবে ফরাসী সৌরভের সুবাস?
ভাবতে ভাবতেই ঢুঁকে পড়ি নির্দিষ্ট কক্ষে। লালচে গালিচায় মোড়া কসমোপলিটান আলোতে সুবেশী সব লোকজন হাসে আর কথা বলে। এর মাঝে আমরা তিনজন মন্থর পায়ে এগিয়ে যাই সামনে। অ্যাকেবারে সামনে না বসে একটু পেছনে বসার অভ্যাস আমার চিরকালের, সঙ্গীদের আমি সেভাবেই মন্ত্রণা দেই। পেছনে বসলে বাদকদের বাজে পারফরম্যান্সে সিটি বাজাতে সুবিধা হবে বিবেচনা করে রিশাদও উক্ত প্রস্তাব সহজেই মেনে নেয়।
আজকে বাজনা বাজাবে সী-স কোয়ার্টেট। স্যাক্সোফোনের দায়িত্বে থাকা রাহিন ভাইয়ের সাথে পরিচয় আমাদের আগেই আছে; গিটারিস্ট হিসেবে জিষ্ণু হায়দার, বেসিস্ট অ্যালিস্টার সরকার এবং ড্রামার সামিউল ওয়াহিদের নাম জানা যায় সাথে থাকা লিফলেট হতে। ছোট্ট মঞ্চে বাদকেরা জায়গা নিয়ে খানিক হাত-পা ছুঁড়ে নিলে ফরাসী কলরবে মুখর ঘরটায় লোকজন বেশ আশান্বিত হয়ে ওঠে।
তবুও শুরু করতে খানিক দেরি হয়। অলিয়ঁস ফ্রসেজের নয়া কী কর্মকর্তা (পরিচালক?) সদ্য এই দেশে পা রেখেছে, পামুকের মতো দেখতে এই ব্যাটা যুগপৎ ফরাসী ও ইংরেজিতে খানিক বাগাড়ম্বর করে। এসবের পরে একে-তাকে ধন্যবাদ জানানো, বাধ্যতামূলক হাততালি ইত্যাদি শেষের পরেই কেবল ফুরসত হয় বাজনা শোনার।
গান শোনার সাথে বাজনা শোনার একটা পার্থক্য মনে হয় আছে। অন্যদের হয়ে বলাটা কঠিন, আমার নিজের মনে হয়- গান শুনতে বসলে সুরের সাথে মন রাখা প্রয়োজন হয় কথাতেও, শব্দ ও সুরের টানাপোড়েনে আমাদের ভেতরে কাহিনির জন্ম হতে থাকে তখন। শুধু বাজনা শোনার ক্ষেত্রে বিষয়টা তা থাকে না। কথা দিয়ে কোনো ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে না বলে মনকে এখানে ভাসিয়ে দিতে হয় বল্গাহীন, এক-একটি সুর তখন এক-একটি বোধ বা দৃশ্যকল্পের জন্ম দেয় শ্রোতার মাঝে। আলো কমিয়ে দেয়া প্রেক্ষাগৃহে মঞ্চে আসীন বাদকদের পানে তাকিয়ে তাই ভাবি- নিউ অর্লিন্সের কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের হাতে গড়া জ্যাজ নামের যে সুরের ধারা, একবিংশ শতাব্দীর ঢাকাইয়া বাঙালের মনে সেটা ক্যামন প্রতিক্রিয়া তুলবে?
ব্রাজিলিয়ান একটা জ্যাজ দিয়ে শুরু হতেই চোখ বুজে আমি সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজি। কয়েক মুহুর্ত কেটে যায়। তারপর মনে হয়, শতাব্দী প্রাচীন কোনো সেলুনে বসে আছি। কৃষ্ণাঙ্গ কোনো বারটেন্ডারের সামনে জ্বলছে তেলের বাতি, বাইরে সন্ধ্যা। আর আমি যেন সেথায় একটা জানালার পাশ দখল করে বাইরে তাকিয়ে দেখছি আকাশ। নীলাভ আকাশ তখনো সম্পূর্ণ অন্ধকার নয়, সেখানে আবছা আলো। যতক্ষণ বাজনা শুনলাম, আলোটা মলিন হলো না।
প্রথম পরিবেশনায় এভাবে মুগ্ধ করে বাদকেরা যায় পরের পরিবেশনায়। এটার নাকি তাদের নিজস্ব, নাম -ফেয়ারিটেল। রুপকথা।
এই বাজনাটা অন্যরকম। প্রথমেই বোধ হলো রৌদ্রোজ্জ্বল এক সকালে ঘন নীল কোনো সাগরতীরে ছুটছি তো ছুটছি, কিন্তু ঝাঁপ দেয়াটা আর হয়ে উঠছে না। তাই বলে বালির ওপর দৌড়তে খারাপ লাগে না। কিন্তু অনির্দিষ্টকাল এভাবে দৌড়তে দেয়া আমাদের বাদকদল অনুমোদন করে না। এমনভাবে তারা বাজনার ভোল পালটায়, আউটডোর থেকে মুহুর্তে চলে আসতে হয় কোনো আলোয় ভেসে যাওয়া বলরুমে। দেখতে পাই, লম্বা গাউনের সুন্দরীদের সাথে নেচে চলেছেন রাজপুরুষেরা, রাত বাড়ছে- বাজনা বাড়ছে-ঘর থইথই করছে আনন্দে।
দ্বিতীয় এই সুরটা, ভালো লেগে যায় প্রথমটার চেয়েও। কিন্তু তখনো মুগ্ধতার বাকি ছিলো আমাদের। বাদকদলের মুখপাত্র রাহিন ভাই জানান, এবারের বাজনা তাদের নিজস্ব; নাম ‘উই আর অল আফ্রিকানস’।
বাজনার শুরু থেকেই তাই অপেক্ষা করি, ভাবি-এমন কোনো দৃশ্যের এবার জন্ম হবে, যেখানে প্রখর রোদের নিচে বাওবাব গাছের অরণ্যে আমরা হেঁটে যাবো পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমাহীন কোনো রুপসীর হাত ধরে। কিন্তু আমাদের পথ-প্রদর্শক বাদক দল মুহুর্তে আমাদের চড়িয়ে দেয় কোনো আলাভোলা বাতাসের মহাসড়কে। গাড়িটা কী? আলফা রোমিও, না অ্যাস্টন মার্টিন? তা যা-ই হোক, খোলা জানালের ফাঁক গলে প্রবল বেগে ঢুকছে বাতাস; বাতাসে চুল উড়ে যাচ্ছে আমার সঙ্গিনীর, উদ্দাম স্টেরিওতে বেজে চলেছে ঢাকার অলিয়ঁস ফ্রসেজের দোতলার কোন লালচে অন্ধকার ঘরের সুর, উই আর অল আফ্রিকানস। আমরা আফ্রিকার সন্তান।
আমার বাকি সন্ধ্যার, বাকি রাতের আচ্ছন্নতা; এই একটি সুরে হয়ে ওঠে নিরঙ্কুশ।
ছায়াচ্ছন্ন অডিটোরিয়ামে অনেক কিছুই হয়। সামনের মাঝবয়েসি মহিলাটি কখনো ঘুমে ঢুলে পড়েন, পরক্ষণেই দামড়া সাইজের ট্যাবটা মঞ্চের দিকে তাগ করে ভিডিও করতে করতে ক্রিস নোলানের প্রক্সি দ্যান। আসন স্বল্পতা ঢাকতে চেয়ার বয়ে এনে বসানো হয় দর্শকের দুই কলামের মাঝে, মোবাইল টেপায় ব্যস্ত কোনো দর্শক হয়তো দাঁড়িয়ে বাদকদলের ছবি তোলে, একজন আবার স্কেচ খাতায় বাদকদলের ছবিও আঁকছেন দেখতে পেলাম।
কিন্তু এসবের মাঝেই বাদকদল জন্ম দেয় মহীনের ঘোড়াগুলোর মতো বিবিধ দৃশ্যের। কখনো অর্ণবের সুরের সাথে মনে হয় গভীর রাতে জানালায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছি, কখনো চার্লি পার্কারের সুরে বোধ হয় একদল তরুণী উদ্দাম নেচে চলেছে। কখনো মনে হয় শৈশবে ফিরে গিয়ে নানাবাড়ির সামনে একটা ফুটবলে দুর্বল পায়ে লাথির পর লাথি আমি মেরে যাচ্ছি; কখনো হয়ে উঠি ফেরিস বুয়েলার, দেয়ালের পর দেয়াল টপকে আজ আমি স্কুল পালাবোই।
শুধু সুরের যে একরকম মাদকতা; আমাদের শব্দ সন্ত্রাসে ভরপুর শহরে সে কথা আমি ভুলে ছিলাম বহুদিন। আজ তাই এইসব আমার খুব ভালো লাগে। আসর শেষ হয়, ইতস্ততঃ পথভ্রষ্ট হয়ে বেরিয়ে আমরা তিনজন চোখ বুলাই জ্ঞানকোষের সাত্রে কী আগাথা ক্রিস্টিতে; রাত প্রায় দশটার ধানমন্ডির ফাঁকা অলিতে গলিতে রিকশা আর গাড়ির সন্ধান করতে করতে দেখি অতিরঞ্জিত জ্যোছনা, আমরা উদার হয়ে কফি খেয়ে রিকশা চাপি বাড়ি ফিরবো বলে- কিন্তু ভালো লাগাটা কমে না।
পাহাড়ের আদিবাসী শেষ করে হাত চলে গেছে নোয়াখালীর বেদেপল্লীতে, আমাদের স্কাউটে ভরপুর রাজপথে আজও নিরাপত্তার অচিন বৃক্ষের চারা গাছ খেয়ে ফেলে ছাগলে, মনে হয় প্রতিদিন সেলফির ফাঁক গলে আমাদের হাসি ক্রমশ পড়ে যাচ্ছে রাস্তাঘাটে- খাবার দোকানে। তবু সব ভুলে গিয়ে আমার মাথায় কেবলই ঘুরে ঘুরে আসে লালচে কোনো অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘর, বেজে চলে- উই আর অল আফ্রিকানস।
আমার ভালো লেগেই চলে।
বাতাস এখানে প্রবল বেগে নয় বরং মৃদু, আলফা রোমিও’র ছুটে যাওয়ার বদলে রিকশা আটকে যায় ক্রিসেন্ট রোডের চিপা গলিতে। তবু আজ ঢাকার রাস্তায় বাইকের প্রতাপে মিনমিন করা রিকশায়, স্ট্রিটল্যাম্পের স্লিভলেস আলো গায়ে মেখে, কত দিন-কত রাত ব্যবিলনে হেঁটে বেড়ানো এই আমি জেনে যাই, আজও আমি আফ্রিকার সন্তান।
[১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮]
পার্লিয়া
পড়তে অদ্ভুত আনন্দ হল।
হামিম কামাল
অনুষ্ঠানে না গিয়ে যে ক্ষতি হয়েছিল তার অনেকটাই পুষিয়ে দিলো রঙিন এই লেখা। পেন্নাম!