গল্পটা প্রতি চার বছরে ফিরে ফিরে আসে। লোকটা নাকি একমাসের জন্য বাড়ির দরজা বন্ধ করে রাখে, বাইরে ঝোলানো নোটিশ উঁচুস্বরে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের জানায়- “খেলা দেখার জন্য বন্ধ “। আর এই একটা মাস নিজের প্রিয় চেয়ারে বসে লোকটা কেবল টিভি দ্যাখে আর সেটা নিয়ে লিখে যায়।

লোকটা এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানো, খেলাটা ফুটবল, উপলক্ষটা বিশ্বকাপ।

রাশিয়া বিশ্বকাপ-২০১৮’তে আমেরিকা ছিলো না, ইতালিও ছিলো না। সেই সাথে ছিলেন না গ্যালিয়ানোও। ফুসফুসের ক্যান্সারে মানুষটা চিরবিদায় নিয়েছেন আরো বছর তিনেক আগেই, তবে আমার কাছে তার নবজন্ম হলো এই রাশিয়া বিশ্বকাপ থেকেই।

গড়পড়তা মানুষের চাইতে সৃষ্টিশীল মানুষেরা একটা সুবিধা বেশি পায়। মৃত্যুর পরেও তাদের সৃষ্টির সাথে পরিচিত হয়ে, নতুন করে তাদের সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে লোকজন। উরুগুয়ের লেখক-সাংবাদিক এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানো এই সুবিধাটা পুরোমাত্রায় গ্রহণ করে তাই, আমার পছন্দের লেখক তালিকায় ঢুঁকে গেলেন কনুই মেরে। মানুষটা জানেন, লিখতেও পারেন। আর তার অনাড়ষ্ট লেখা কখনো রুঢ় থাপ্পড় দিয়ে পাঠককে সচকিত করে, কখনো লজ্জা দেয়, আর কখনো পড়া থামিয়ে কেবল স্থির হয়ে ভাবতে বসে যেতে হয়।

গ্যালিয়ানোর লেখক জীবন নিয়ে বলবার ম্যালা কিছু একজন পাঠকের আছে। তবু যে বিশ্বকাপ প্রসঙ্গ দিয়ে এই লেখাটা শুরু, তার কারণ গ্যালিয়ানোর সাড়া জাগানো বই – সকার ইন সান এন্ড শ্যাডো। এ কথা সত্য, যে হুগো শাভেজ ২০০৯ সালে বারাক ওবামা’কে উপহার দিয়ে যে বইটাকে রাতারাতি তুলে এনেছিলেন অ্যামাজনের বেস্টসেলার তালিকার দ্বিতীয় স্থানে, সেই ওপেন ভেইনস অফ লাতিন আমেরিকা-কেও গ্যালিয়ানোর সবচেয়ে বিখ্যাত বই বলা যায়। কিন্তু লাতিন আমেরিকার ইতিহাসের ওপর অমন বিস্তৃত কাজের পরেও, অত্যুক্তি হবে না যদি বলি, যে দুনিয়া জোড়া আমপাঠকের কাছে গ্যালিয়ানো আসলে পৌঁছে গেছেন আলো-ছায়ার ফুটবল এঁকেই। সকার ইন সান এন্ড শ্যাডো,  ক্রীড়াপ্রেমী কি বইপাগল- উভয় দলের কাছেই গ্যালিয়ানোকে করে তুলেছে ফুটবলের রাজকবি। আর সেই বই দিয়েই আমার সাথে লোকটার পরিচয়

ক্রীড়াসাহিত্যের আগ্রহী অথচ মূর্খ পাঠক হয়েও টের পাই, গ্যালিয়ানোর এই আলোছায়ার যুগলবন্দী এক রকমের অভূতপূর্ব। দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতায় যুক্ত ছিলেন গ্যালিয়ানো। ফলে, দেখার চোখ লোকটার সাংবাদিকের। অথচ মানুষটার হৃদয় হচ্ছে কবির। যখন তিনি লেখেন, গদ্যের চেয়েও সেটার বেশি মিল পাওয়া যায় ঘন-ঘন-উদ্ধৃতি-মারার-জন্য-আদর্শ কবিতা পঙক্তির সাথে। সকার ইন সান এন্ড শ্যাডো’র পাতায় পাতায় ঘুরে বেড়িয়ে তাই, খুব আকর্ষক লাগে মানুষটার লেখার ধরন। যেমন, ফুটবল খেলোয়াড়ের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে গ্যালিয়ানো সেখানে লিখেছেন এরকম-

খেলোয়াড়

তার জন্য একদিকে থাকে স্বর্গীয় অমরত্ব, অন্যদিকে অপেক্ষমান পাতালের শেষ সীমা।

প্রতিবেশীরা তাকে হিংসা করে। শালার কপালটা কী, প্রতিদিনের অফিস-যন্ত্রণা না সয়ে ব্যাটা কি না টাকা পায় খেলার জন্যে !

অন্যদিকে, মাথার ঘাম মাটিতে ফেললেও ব্যর্থতা বা রোগাক্রান্ত হবার সুযোগ তার নেই।

তার নাম আসে পত্রিকায়, রেডিওতে, টিভিতে ; মেয়েরা তাকে ঘিরে ধরে আর ছোটরা হতে চায় তার মতো হতে। শৈশবে সে বস্তির গলিতে খেলাটা শুরু করেছিলো সময় কাটাতে, অথচ আজ তাকে প্রতিদিন মাঠে নামা লাগে জেতার চাকরি নিয়ে।

ব্যবসায়ীরা তাকে কেনে-বেচে, ধার দেয় ; এবং টাকাপয়সা আর নাম কামাবে বলে ওসবে তার অনুমোদনও থাকে। যত সে জেতে, তার টাকাপয়সাও তত বাড়ে। আর বাড়ে শাস্তি। সেনাবাহিনীর মতো ছকে বাঁধা জীবনে আটকে গিয়ে তাকে প্রতিদিন পোহাতে হয় প্র্যাকটিস-এর সাজা আর ব্যাথানাশক অষুধের ধকল।

বড় খেলার আগে তাকে আটকানো হয় এক কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে , যেখানে সে স্বেচ্ছাশ্রম দেয়, চিবিয়ে খায় বিস্বাদ খাবার, আর ঘুমায় একলা।

অন্য পেশায় যা-ই হোক, ফুটবলার বুড়িয়ে যেতে পারে মাত্র তিরিশেই। ক্লান্ত পা জোড়া তখন আর সাড়া দিতে চায় না। গ্যালারি থেকে চিৎকার ভেসে আসে, ‘ গোলকির হাত বাইন্ধা দিলেও এই খানকির পোলায় গোল দিতে পারবো না! ’

অথবা এমনও হতে পারে, যে ত্রিশের আগেই তার কোনো লিগামেন্ট ছিঁড়ে নিয়েছে দুর্ভাগ্য, কিংবা তার হাড্ডি বুটের আঘাতে এমনই ভেঙেছে যে সেটা আর জোড়াই লাগবে না। তখন একদিন হঠাৎ করেই লোকটার হুঁশ হবে যে নিজের সারাটা জীবন সে বাজি রেখেছিলো একটা টেক্কার ওপরেই। টাকাপয়সা চলে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে তার খ্যাতি। আর খ্যাতি এমনই এক ঢ্যামনা মাগী, যাবার আগে কোনো চিরকুট পর্যন্ত শালী রেখে যায়নি।

ফুটবলারের, বলা ভালো আধুনিক যুগে যারা হয়ে পড়েছে ফুটবল-শ্রমিক, এমন কৌতুকী অথচ বিষাদমাখা বর্ণনা দেয়া যথেষ্ট কঠিন ব্যাপার। একটু সাহস করে বলে ফেলা যায়, শক্ত কলমের সাথে গ্যালিয়ানোর মতো খেলাটাকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতে না জানলে – এমন লেখাটা অসম্ভবই।

আর ফুটবলকে, গ্যালিয়ানো ভালোবেসেছেন সত্যিই। জানিয়েছিলেন এক লেখায়, শৈশব থেকেই খেলাটার প্রতি যে আবেগ তিনি ধারণ করেন- পা দিয়ে সেটাকে অনুবাদের সামর্থ্য তার ছিলো না। ফলে পরিণত বয়েসে তিনি চেষ্টা করেছেন হাতের কলম দিয়েই। অসামান্য রসবোধ আর তীর্যক বাক্যবাণে সেই চেষ্টা শতভাগ সফল। আলোচ্য বইটি থেকে বিবিধ ফুটবলীয় প্রসঙ্গে গ্যালিয়ানোর কয়েকটা মন্তব্য তুলে দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে কিছুটাঃ

  • যখনই কোনো খেলোয়াড় অপরাধ করে, শাস্তিটা পায় গোলকিপার।
  • ম্যানেজারের কাজ হলো খেলোয়াড়দের সৃষ্টিশীলতা থামানো, স্বাধীনতা খর্ব করে তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো।
  • আর ফুটবল এমনই এক ধর্ম, যেখানে কেউ নাস্তিক নয়।

চমকপ্রদ ছিলো ম্যারাডোনা প্রসঙ্গে গ্যালিয়ানো শুরুটাঃ

যতক্ষণ খেলেছে, সে জিতে গেছে। তবে পেশাব করা মাত্রই সে হেরে গেলো।

বিচিত্র সব মন্তব্যে আর পর্যবেক্ষণে, এভাবেই গ্যালিয়ানো বারবার চমকে দিয়েছেন পাঠককে!

আলো-ছায়ার ফুটবলে যত ভেতরে যাই, গ্যালিয়ানোর নিজস্ব দ্যুতির আরো একটা দিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে তত। লোকটার ইতিহাস প্রেম। ফুটবলের ইতিহাস ধরেও টান মেরেছেন গ্যালিয়ানো। কিন্তু এ ক্যামন ইতিহাস? আমাদের চেনাজানা ক্লাসরুমে-বইয়ের পাতায়-মৌখিক আলাপে ইতিহাসের যে রুপ, সেটাকে দুমড়ে দিয়ে গ্যালিয়ানো অতীতটাকে এক আস্ত নতুন চেহারা দিয়েছেন। যেমন ধরা যাক, ১৯৫৮ বিশ্বকাপের বর্ণনা। পৃথিবীর যাবতীয় হালচালকে জড়িয়ে এনে ওই বিশ্বকাপ নিয়ে গ্যালিয়ানো শুরু করেছেন এভাবে-

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন সদ্য আকাশে ছুঁড়েছে নতুন এক উপগ্রহ, জিনিসটা চায় পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে। মাঝপথে আসতেই মার্কিন এই উপগ্রহ দেখা পেলো সোভিয়েতের ছাপ্পড় মারা স্পুটনিকের, অথচ দুজনেই মুখ ঘুরিয়ে রইলো অন্যদিকে।

আকাশ দখলে ব্যস্ত পরাশক্তিদের অমন তুমুল ব্যস্ত সময়ে, মর্ত্যেও চলছে যুদ্ধ। লেবাননে গৃহযুদ্ধ, আলজেরিয়া পুড়ছে। আগুনের আঁচ পাচ্ছে ফ্রান্স, কিন্তু ছয় ফুটিয়া চার্লস ডি গল সেখানে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন পরিত্রাণের। বাতিস্তার বিরুদ্ধে ডাকা ফিদেল ক্যাস্ত্রোর ধর্মঘট ব্যর্থ হচ্ছে কিউবায়, কিন্তু আরো একটি ধর্মঘট তখন ভেনেজুয়েলায় টলোমলো করে দিচ্ছে আরেক স্বৈরশাসক পেরেজ হিমেনেজ’এর গদি। রিচার্ড নিক্সন লাতিন আমেরিকা ঘুরতে এসে পাথর খাচ্ছেন, প্রকাশ হচ্ছে হোসে মারিয়া আরগুয়েদাজের ডিপ রিভার আর কার্লোস ফুয়েন্তেসের হোয়ের দা এয়ার ইজ ক্লিয়ার ।

গণতন্ত্রকামী আরো অজস্র বিপ্লবীর সাথে ইমরে নেগি গুলি খাচ্ছেন হাঙ্গেরিতে, ওদিকে কালো যাদু আর জল্লাদে ভর করে ক্ষমতা টিকিয়ে থাকা পাপা ডক’ও একই সময়ে হাইতির প্রাসাদে বসে গুলি চালাচ্ছেন গণতন্ত্রকামীদের ওপর। রোমের নতুন পোপ তখন তেইশতম জন, ইংল্যান্ডের ভবিষ্যত রাজা হবেন প্রিন্স চার্লস, পুতুলদের নতুন রাণী বার্বি। ফুটবল সাম্রাজ্যের সিংহাসন তখন মাত্র দখল করছেন জোয়াও হাভেলাঞ্জ, আর মাঠের খেলা শাসন করছে সতেরো বছর বয়েসের এক বৃদ্ধ। পেলে নামের এই ছেলেটা, তখন পৃথিবীর সম্রাট।

কেবল ১৯৫৮ নয়, সমস্ত বিশ্বকাপের বছরগুলোতে চলমান পৃথিবীর এক রকমের সারাংশ তৈরি করেছেন গ্যালিয়ানো, পরে সেটাকে সেতুবন্ধ করেছেন ফুটবলের সাথে। সুন্দর ফুটবলের একনিষ্ঠ প্রেমিক গ্যালিয়ানো তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করেছেন আনন্দ-নির্ভর থেকে খেলাটার ফলাফল-নির্ভর হয়ে পড়া; আর দ্রোন বিমানের মতো এক বিক্ষণপ্রান্ত তৈরি করে চেষ্টা করেছেন পৃথিবীর ইতিহাসের সাথে এর কোনো সংযোগ আছে কি না, তা খুঁজে বের করতে।

গ্যালিয়ানোর এই বই আমায় অ্যাতোই আপ্লুত করে, যে তার অন্যান্য লেখা সম্পর্কেও একটা তুমুল আগ্রহ আমায় অধিকার করে নেয়। আন্তর্জালের সুবাদে মুহুর্তে হাতের মুঠোয় ই-বুক আনতে দেরি হয় না। আর এরপর চলে আমার ব্যক্তিগত গ্যালিয়ানো অভিযান।

2850.jpg

এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানো (ছবি সৌজন্যেঃ দা গার্ডিয়ান)

আবিষ্কার করি, কালো যাদুকরের মতো শক্তিশালী লেখক এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানো। ক্ষমতা তার অ্যাতো বেশি, যে আমাদের চেনা দুনিয়ার ইতিহাসকে পদদলিত করে লোকটা একটা অন্য পৃথিবী প্রতিষ্ঠা করেছেন সাদাকালোতে। তুলে এনেছেন, ইতিহাসের অচেনা একটা ধারা।

সেই ইতিহাস, চিরকালের শোষিতদের ইতিহাস।

পৃথিবীর সমস্ত মহাদেশের বঞ্চিত মানুষের জন্য ইতিহাসের মিনমিন করা গলাটা মানুষটার হাত ধরে পেয়েছে নতুন এক স্বর। প্রাকৃতজনের অবস্থান যেখানেই হোক- আমেরিকার দুই মহাদেশ, ইউরোপ, আফ্রিকা কিংবা এশিয়া- গ্যালিয়ানো বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন, যে ক্ষমতাসীনেরা কীভাবে স্বার্থোদ্ধারের জন্য ইতিহাসকে লিখেছে নিজেদের ফরমায়েশ অনুসারে। গ্যালিয়ানোর বলা ইতিহাস তাই চেনা বয়ানের বাইরে একদম নতুন, ঝাঁঝালো ও প্যাঁক-কাদার গন্ধে ভরপুর।

সেদিকে যাবার আগে, আরো কিছু কথা বলে নেয়া দরকার গ্যালিয়ানোর লেখক জীবনের প্রাথমিক দিক সম্পর্কে। সোভিয়েতের দেখানো রাস্তায় সমাজতন্ত্রের দিকে লাতিন আমেরিকার রাষ্ট্রগুলোর হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে এগোনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঠিক মেনে নেয় নি। তাদের মদদে সত্তরের দশকে বেশ কিছু লাতিন দেশেই উত্থান ঘটে স্বৈরতন্ত্রের। গ্যালিয়ানোর দেশ উরুগুয়েতে নয় কেবল, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-চিলি-বলিভিয়াতেও ওই কয়েকটি বছরে চলে জনগণকে বলপূর্বক দমিয়ে রাখা। গুম হয়ে যাওয়া, বিনা বিচারে জেল, আটকে রেখে নির্যাতন- দক্ষিণ আমেরিকা জনপদে এই দৃশ্য সেই দশকে ছিলো অতীব সাধারণ। এমন একটা সময়ে প্রকাশ পায় গ্যালিয়ানোর প্রথম বই, ওপেন ভেইনস অফ লাতিন আমেরিকা। রাতারাতি খ্যাতি এনে দেয়া এই বইতে মহাদেশটির রাজনীতিক গতিপ্রকৃতি নিয়ে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন গ্যালিয়ানো, পরবর্তী বছরগুলোতে মিলে গেছে তার অনেকটাই।

উরুগুয়েতে জলপাই-পন্থার আগমনের পরেই তাই জেল খাটতে হয় মানুষটাকে, এরপর তিনি পালিয়ে গেছিলেন আর্জেন্টিনায়। নিজ নিজ দেশে স্বৈরশাসনের জ্বালায়, অমন নির্বাসনের পথে তখন হাঁটছিলেন লাতিন আমেরিকার অনেকগুলো দেশের নাগরিক। এই যে মহাদেশটার অধিবাসীদের এক ধরনের উন্মূলতা, গ্যালিয়ানোকে বিষয়টা খুব স্পর্শ করেছিলো। গভীর আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেছিলেন, লাতিন আমেরিকা আমার মাথার ভেতরে খুব যন্ত্রণা করে। কিন্তু এখানকার মানুষ দ্রুত সব কিছু ভুলে যায়। অতীত ভুলে যাওয়ার এই রোগ আমার প্রিয় এই জায়গাটাকে অ্যাকেবারে শেষ করে দিয়েছে !

বিস্মৃতির এই জ্বালা বোধহয় জাগিয়ে তুলেছিলো এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানোর ভেতরের লেখকটাকে। ততদিনে তার ওপেন ভেইনস অফ লাতিন আমেরিকা নিজ দেশেই সামরিক শাসক কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়ে গেছে, শরণার্থী জীবনের দিনলিপি নিয়ে তিনি লিখে ফেলেছেন ডেইজ এন্ড নাইটস অফ লাভ এন্ড ওয়ার; ঠিক এমন সময়েই আর্জেন্টিনায়’ও হলো সেনা অভ্যুত্থান। গাট্টি বোঁচকা নিয়ে গ্যালিয়ানো পালালেন স্পেনে, আর সেখান থেকেই লিখলেন তার সবচেয়ে বৃহদাকার কাজ- আমেরিকা মহাদেশের ইতিহাস নিয়ে তিন খণ্ডের ট্রিলজি, মেমোরি অফ ফায়ার। একটা আস্ত মহাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, পুরাণ- নতুন ভাষা পেলো এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানোর টুকরো টুকরো তথ্যমালায়।

অবশ্য এই কাজের জন্য তার চেয়ে উপযুক্ত কেউ ছিলো না। দীর্ঘকাল পথে পথে ঘুরে গ্যালিয়ানো শুনেছেন আদিবাসী থেকে গেরিলা যোদ্ধা, শিল্পী থেকে ডাকাত- সকলের কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট থেকে পাদ্রীর। পাহাড়ে খেয়েছেন সাপের ছোবল, অরণ্যে আক্রান্ত হয়েছেন কালাজ্বরে। লাতিন আমেরিকা নিয়ে লেখার অধিকার তার চাইতে বেশি আর রাখেটা কে?

এই মহাদেশ আমার কানে কানে অনেক কিছু বলে ! গ্যালিয়ানো বললেন। বললেন, ইতিহাস আসলে কখনো আমাদের বিদায় বলে না। সে বলে, আবার দেখা হবে !

উরুগুয়েতে যখন ফিরলেন গ্যালিয়ানো, ততদিনে স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটেছে। কিন্তু উন্নয়নের গণতন্ত্রের প্রতাপ যুগে যুগে চলে এসেছে সব দেশেই, এবং এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানোও সব রকমের অনাচারের বিপক্ষে ঘাউড়া।

একই সাথে, নিজের লেখাতেও গ্যালিয়ানো হয়ে উঠলেন আশ্চর্য মিতব্যয়ী। যে কৌশলে তিনি লিখেছিলেন মেমোরি অফ ফায়ার, এবারের বই মিররসঃ স্টোরিস অফ অলমোস্ট এভরিওয়ান-এ তিনি দেখালেন সেই স্বল্পবাক থাকবার শিল্পের চূড়ান্ত উৎকর্ষ । শতাধিক ছোটো ছোটো গল্পে, আয়তনে যার কোনোটাই এক থেকে দেড় পৃষ্ঠার বেশি নয়, মানব ইতিহাসের দারুণ এক বিবর্তন তুলে ধরলেন গ্যালিয়ানো। বাদ দিলেন না ক্লিওপেট্রা থেকে পাবলো পিকাসো’র কাউকেই।

কিন্তু, আগেও যেমনটা বলা হয়েছে, গ্যালিয়ানোর ইতিহাস আমাদের কোমলমতি ক্লাসরুমের জন্য প্রস্তুতকৃত মিহি কোনো দানা নয়। এককালের সমৃদ্ধ লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য আর এশিয়াকে লুটপাট করে ইউরোপ আর আমেরিকা যে সভ্যতা গড়ে তুলেছে; দেখতে পাই, পদে পদে সেটাকে আক্রমণ করে গ্যালিয়ানো জানালেন- রাজা, তোমার কাপড় নাই।

গ্যালিয়ানোর এই ঘাড়ত্যাড়া রসবোধের উদাহরণ দিতে মিররস থেকে দুয়েকটা গল্পের উদাহরণ টানা যাক।

একটি ফটোগ্রাফঃ বিজয় নিশান

বার্লিন, ১৯৪৫।
জার্মান শক্তিকে পদদলিত করে রাইখস্ট্যাগের চূড়ায় সোভিয়েত পতাকা ওড়ালো দুই সৈনিক। ইয়েভগেনি খালদেই-এর এই ফটোগ্রাফ এমন একটি জাতির বিজয় মুহূর্তকে বন্দী করেছে, বিশ্বযুদ্ধে যাদের হারাতে হয়েছে সবচেয়ে বেশি। বার্তা সংস্থা TASS অবশ্য বিশ্বজুড়ে এই ছবিটা ছড়ানোর আগে ছোট্ট একটা সংশোধন করলো। একজোড়া হাতঘড়ি পরে থাকা রাশিয়ান সেনাটির হাতে এখন দেখা যায় কেবল একটি ঘড়ি। কারণ, প্রলেতারিয়েতের পক্ষে থাকা যোদ্ধা কখনো প্রতিপক্ষের মৃতদেহ থেকে কিছু হাতায় না।

অথবা, এই গল্পটা-

আলি

সে ছিলো প্রজাপতি আর মৌমাছি। নাচি নাচি যেতে যেতেই সে হুল ফোটাতো।
১৯৬৭’তে মোহাম্মদ আলি, জন্মগত ভাবে যে ক্যাসিয়াস ক্লে , সামরিক পোষাক গায়ে চড়াতে অস্বীকার করলো।
‘ ভিয়েতনামের সাথে আমার কী শত্রুতা? ওইখানে কেউ আমাকে কখনো নিগার ডাকে নাই! ’

তারা তাকে বললো বিশ্বাসঘাতক, দিলো পাঁচ বছরের জেল, নিষিদ্ধ করলো বক্সিং থেকে। তারা কেড়ে নিলো বিশ্বসেরার খেতাবটাও।
আর এই শাস্তিটাই হয়ে গেলো আলির প্রাপ্তি। মুকুট কেড়ে নিয়ে , তারা তাকে বানিয়ে দিলো সম্রাট।
বহু বছর পর, একদল কলেজপড়ুয়া যখন তাকে অনুরোধ করেছিলো কিছু বলতে ; আলি তাদের শুনিয়েছিলো ইতিহাসের ক্ষুদ্রতম কবিতাটাঃ
‘ আমি, আমরা ! ’

কবির মতো শব্দচয়ন আর সাংবাদিকতার এই অপূর্ব ভঙ্গিমায়- গ্যালিয়ানো এভাবেই ইতিহাস আওড়েছেন। এখানে অবশ্য বড় ধন্যবাদ প্রাপ্য গ্যালিয়ানোর বইগুলোর ইংরেজি অনুবাদক মার্ক ফ্রাইড আর সেড্রিক বেলফ্রাগের’ও। সরাসরি, অথচ হেঁয়ালিতে ভরা গ্যালিয়ানোর এই গদ্যরীতির অনুকরণ করতেও শব্দের প্রতি তীব্র নিবেদন থাকা প্রয়োজন, অনুবাদকদের সেটা ছিলো।

দুনিয়াকে কঠিনভাবে দেখেননি গ্যালিয়ানো। তার কথা খুব সরল, স্বৈরশাসন আর পরাশক্তিদের অর্থনৈতিক লোভই পৃথিবীটাকে শেষ করে দিচ্ছে। পুরো সিস্টেমটাই বড়লোকের বাচ্চাদের আরো শক্তিশালী করে দরিদ্রদের করছে বিপন্ন। পৃথিবী নিয়ে আশাবাদী হবার মতো কিছু আছে কি না জানতে চাইলে হেসে তিনি বলেন, সকাল আটটা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত আমার বেশ নিরাশ লাগে, তবে একটার পর থেকে বিকাল পর্যন্ত কিন্তু আবার আমি আশাবাদী!

গ্যালিয়ানোর আরেক আলোচিত বই, চিলড্রেন অফ দ্যা ডেইজ’ও সাক্ষ্য দেয় তার ইতিহাস প্রেমের। বছরের প্রতিটি দিনের ইতিহাসকে এই বইতে লেখক খোদাই করেছেন ভিন্ন কালিতে। তবে মানুষটি যেহেতু এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানো, পৃথিবীর যাবতীয় সাম্রাজ্যবাদীদের ওপর যার চিরকালের আক্রোশ, বাঁকা কথার অভ্যাসটা তিনি পরিত্যাগ করেননি এখানেও। উদাহরণে বলা যায় পহেলা জুলাইয়ের ভুক্তিটার কথা-

কমলো আরো এক সন্ত্রাসী

২০০৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার ঠিক করে যে বিপজ্জনক সন্ত্রাসীদের তালিকা থেকে নেলসন ম্যান্ডেলার নাম এবার মুছে ফেলা যায়। দুনিয়ার সবচেয়ে সমাদৃত আফ্রিকানটি গত ৬০ বছর ধরে এই তালিকায় ছিলেন।

চুয়াত্তর বছরের জীবনের শেষ পর্যন্ত, গ্যালিয়ানো এভাবেই আচ্ছন্ন ছিলেন মানুষের সামগ্রিক অতীত নিয়ে। আরেকটু নির্দিষ্ট করে বললে সামষ্টিক স্মৃতি নিয়ে। উরুগুয়ের মানুষ, আর্জেন্টিনার মানুষ কিংবা এই ভারতীয় উপমহাদেশবাসী যে তাদের ইতিহাস ভুলে যাচ্ছে; ভুলে যাচ্ছে তাদের ওপর সামরিক জান্তার অকথ্য অত্যাচার আর উপনিবেশ কায়েম করা লকলকে জিহবার ইংরেজ কি ইউরোপিয়ানদের; গ্যালিয়ানো এই বিস্মৃতিপরায়ণতা মানতে পারেননি। আমাদের সামষ্টিক ভুলে যাওয়া যে সাদা চামড়ার প্রচার করা ইতিহাসের উপজাত; সেই অমোঘ সত্য চরণে চরণে তুলে ধরে গ্যালিয়ানো কাঠঠোকরার মতো ঠুয়া মেরে যান পাঠকের করোটিতে।

মানুষের চিরন্তন লড়াই হলো প্রকৃতপক্ষে তার স্মৃতির সাথে বিস্মৃতির লড়াই, কুন্ডেরা বলেছিলেন; আর গ্যালিয়ানো বলেন-আমার চেয়েও গভীরভাবে আমায় জানে – আমার স্মৃতি। যা কিছু ধরে রাখার, স্মৃতি তা হারায় না।

একবিংশ শতাব্দীর ঢাকা শহরে এসে আজ তাই, এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানোর বাড়ানো হাতের দিকে চাইলে অপরাধবোধে মনটা অস্থির হয়ে ওঠে। মায়ানমারের জেনারেলের অমানবিকতায় আঘাত পেয়ে দিব্যি হাসি ছুঁড়ে দেওয়া যায় ধূপখোলা মাঠে, এদিকটা আজকাল শান্ত, শেষ দেখে নেবার পর থেকে পুরিয়া বেচতে আসা তরুণদের সরবরাহ কম। মগজ গড়িয়ে পড়া ফুটপাথের দিকে এখনো কেউ হয়তো তাকায় বিষণ্ণ চোখে, কিন্তু আরো বড় দুসংবাদ হলো উল্টোদিকে স্বপন মামার চায়ের দোকানে গুড় শেষ হয়ে গেছে। এবং ভুলে গেলে চলে না, যে গুম না হয়ে আটক থাকার নির্মলানন্দ গ্যালিয়ানো শেষবার প্রত্যক্ষ করেছিলেন আর্জেন্টিনায়, এরপরে দুনিয়ার কোত্থাও, কক্ষনো স্বৈরতন্ত্র আসেনি।

ভীতু কাপুরুষ সুবোধ আর সহমত ভাইয়ের গ্রাফিতি মারা দেয়ালে তাকালে তাই, আজও শুনতে পাই গ্যালিয়ানো ফিসফিস করে বলছেন – দেয়াল হলো শোষিত মানুষের প্রকাশক।

কিন্তু মজদুরের এই প্রিন্টিং প্রেসে আমাদের হয়ে কে লিখবেন? আমাদের কি এমন লেখক নেই, যিনি এইসব যুদ্ধ আর ভালোবাসার দিনরাত্রি তুলে ধরবেন অকপটে? আমরা কি এমন সাংবাদিক পেয়েছি, যিনি রাজার সামনে আয়না ধরে মনে করিয়ে দেবেন ইতিহাস গান ধরে ফিরে আসার জন্যেই?

কোথায় আমাদের গ্যালিয়ানো, যিনি স্বেচ্ছাচারীর দেয়াল ভাঙতে শোষিত মানুষের হয়ে গ্রাফিতি আঁকবেন?

[১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮]