লোকটার সাথে আমার পরিচয় আজ অনেক দিন হয়। সে-ই কবে চন্দনা মার্ডারের রহস্যে প্রদোষ মিত্র আর লালমোহন গাঙ্গুলি গিয়ে পড়লেন বারাসতের এক বাড়িতে, আর তোপসেকে সরিয়ে দিয়ে হরিপদবাবুর গাড়ির চতুর্থ যাত্রীটি হয়ে পড়লাম আমি।
শুরুটা তখন থেকে, শেষ আজও হলো না।
স্মৃতি এক আশ্চর্য আলমারি। কাপড় টানতে গিয়ে দেখা যায় বেরিয়ে পড়েছে জমিয়ে রাখা উপলক্ষের টি-শার্ট, পিকনিকের ছাপ্পড় মারা সব গেঞ্জি। ফেলুদার সাথে আমার সম্পর্ক ঠিক তাই।
নিউমার্কেটের প্রবল ঈদের ভিড়ে ঢাকাইয়া পাবলিক পকেট বাঁচাতে হিমশিম, আমি দেখি লালমোহন বাবু তপেশকে বোঝাচ্ছেন যে হগ সাহেবের বাজারে একটা লোক গভীর রাতে সমস্ত বন্ধ দোকানের মাঝে আটকা পড়ে গেলে হবেটা কী। গভীর রাতে কখনো যদি অঞ্জন দত্ত আমার ঘরে আটকা পড়ে রিকশা চাপা মেরি অ্যানকে খোঁজেন, চোখে ভাসে নোনা দেয়ালের যিশু-ব্লু ফক্স হোটেলের সেই বাজিয়ে, যার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বাপ লাগিয়ে দেবে আর্কিস না হলে মার্কিস সাহেবের প্যাঁচ। ট্রাম্প পেটানো আড্ডায় কুরসিক বন্ধু যদি মনোভুলে স্থাপন করে ফেলে কোনো ধাঁধাঁ এবং ভুলেও যদি সেটির উত্তর খুঁজে পাই কোনো পথে, তাচ্ছিল্যের হাসি শেষে ভাবি, ক্যাপ্টেন স্পার্কের সাথে শশীবাবুর সিং-বিকাশবাবুর রেডিও সলভ্ করে এসেছি ভাই। তুই গড়পারের ছেলে, আমায় আর আটকাবি কী করে?
সেই ফেলুদা, রুমটেকে যার সাথে দেখতে যাই লামা ড্যান্স; সেই ফেলুদা, অফব্রেক বল করতে যে কলেজ-কালে একবার ঘুরে এসেছিলো লখনৌতে; সেই ফেলুদা, চন্দননগরের জোড়াখুনের মামলাটা ছাড়া যাকে আজতক ব্যর্থ হতে দেখিনি কোনো কিছুতেই- অনলাইনের পর্দায় তার নতুন আগমনের খবরে আমি তাই বেশ নড়েচড়ে বসি। বিষয় ফেলুদা হলে এই স্বল্প আয়াসেই আমি পাড়ি দিয়ে ফেলতে পারি দেড়যুগের দীর্ঘ পথ, আমার আর ক্লাস এইটের মাঝে পার্থক্য মুহুর্তে ঘুচে যায়।
আর আড্ডা টাইমসের একবিংশ শতাব্দীর ফেলুদার ট্রেলারটাও বেশ আগ্রহ জাগানিয়া। আইফোনে বা শরীরচর্চায় ব্যস্ত বেশ স্মার্ট পরমব্রত সেখানে ফেলু মিত্তির, মোটরবাইকে চেপে তার গুলি করার দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছিলো একেবারে খাঁটি কোডোপাইরিন মার্কা ছবি হবে। নিদেনপক্ষে জেট বাহাদুরের সমতুল্য। তো বায়োস্কোপ লাইভ অ্যাপের সুবাদে আজ দুপুরটা কাটলো সেই সিরিজের প্রথম গল্পটি দেখেই। জটায়ূকে টেনে এনে বলতে হয়, ‘একটা পিকিউলিয়ার ফিলিং হচ্ছে ভাই তপেশ!’
যে বিষয়টা বলতে গলা সবচাইতে নিশপিশ করে, তা হলো স্বাদবদল। মানিকবাবুর ক্যামেরা ও কূলের উত্তরাধিকার বহন করে নেয়া সন্দ্বীপ রায়ের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে এই সিরিজ ফেলুদার লিগ্যাসিতে একটা অন্য মাত্রা আনলো। আর কারো কথা বলাটা দুস্কর, কিন্তু পরিবর্তনকে স্বাগত না জানিয়ে আমি পারি না।
এই ফেলুদার পর্যবেক্ষণ, চিন্তাসূত্র কী ফোন বা কম্পিউটার পর্দার বাংলা টেক্সট- বিবিসির শার্লক সিরিজের অনুকরণের ছায়াটা বেশ গাঢ়। সেটা হোক। এটাও মনে রাখতে হবে যে বেকারস্ট্রিটে নাম্বারহীন কোনো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ফেলুদাই স্পষ্ট উচ্চারন করেছিলো, ‘গুরু,তুমি ছিলে বলেই আমরা আছি।’
সিরিজের প্রথম গল্পটি সেই আদি ও অকৃত্রিম বামন সমৃদ্ধ শেয়াল দেবতা রহস্য। অপেক্ষাকৃত সাদামাটা গল্প, গ্রে ম্যাটারের প্রয়োগ সেখানে সামান্যই। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এই সাদামাটা রহস্য নিয়েই মাথা ঘামাতে ফেলু মিত্তিরকে গুঁজে দেয়া যেন জোর করেই। জোরাজুরির ব্যাপারটা এখানেই থেমে গেলে চলতো, তবে গলফ হোটেলের সূত্র আর সুদর্শনা সাংবাদিকের সাথে ফেলু ভাইয়ের প্রথম সাক্ষাতে তা আবারো মনে পড়ে যায়।
ইন্টারনেটের এ যুগে সিধুজ্যাঠা লোকটা এখনো বেঁচে আছে জেনে স্বস্তি পাই,ব্যাটা দীর্ঘায়ূ হোক- কিন্তু রাত জেগে চার্মিনার খেয়ে ফেসবুক আর স্কাইপ মারানো ফেলু মিত্তিরের তাকে এখনো ক্যানো প্রয়োজন হয় ডিকোড করতে? আবার ঢাকার অদ্ভূত এক বাক্যচর্চা উপেক্ষা করলেও সিঙারা ক্যানো এখানে সমুচা হয়ে যায়? খটকা, খটকা।
খটকাটা আরো ঘনীভূত হয় অভিনয়টা দেখলে পরে, একেবারে অম্বর সেন অন্তর্ধান কেস। কিন্তু এ দোষ অভিনেতাদের হবে কেনো? চিত্রনাট্যে পরমব্রত আর ডলি জহুর ছাড়া চরিত্রগুলো নিজেরাই খুব শক্ত হতে পারলো না। তবে আবহ সঙ্গীতটা সত্যি ভারি ভালো লাগলো, দেড়যুগ পাড়ি দেয়াটা খুব মসৃণ হয় সুরটা কানে আসলেই।
আর, ওই সিঙারা-সমুচা বাদ দিলে নয়া ফেলুদার নিবেদন বেশ ভালোই লাগে। লোকটা স্টারে কাচ্চি সাঁটায়, পাঠক সমাবেশে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর রোজনামচা ঘাঁটে, শাহবাগের জাগরণের বিষয়তেও সে বেশ জ্ঞাত বলে মনে হলো।
কিন্তু এই নিবেদনও যথেষ্ট বলে মনে না’ও হতে পারে। তোপসের ভিডিও ব্লগিং কি তারই মতো শোচনীয় ক্লাস এইটকে টানতে পারছে এখনো? ফেলু মিত্তিরের হাতে এখন উবার আছে, তবে দর্শকের মুঠোয়ও কিন্তু ঢুঁকে গেছে কিংস ল্যান্ডিং। ঝকঝকে সিনেমাটোগ্রাফি আর ম্যাকবুকের শুভ্রতায় কি ঢাকা পড়ে সংলাপ আর গল্পের কমজোর? মনে রাখা দরকার, কাস্টিং আর নামের জোরে জেট-বাহাদুর চলবে শুনে জটায়ূ পর্যন্ত ধাক্কা খেয়েছিলেন।
মোফাটের শার্লকের সাথে তুলনাটা এসেই পড়ে বারবার। নিজের অজ্ঞানতায় সন্দেহ পূর্ণমাত্রাতে রেখেই আমার ধারণা হয়, যে এ শতাব্দীর হালচাল আর ডয়েলের শার্লক- দুটোকে আয়ত্ত্ব করে মাঠে নেমেছে বলেই কাম্বারব্যাচ হয়ে উঠেছেন টিভির পর্দায় হোমসকে অবিকল তুলে আনা জেরেমি ব্রেটের দুর্দান্ত এক প্রতিপক্ষ। এদিকে আমাদের নতুন ফেলুদা, চাকচিক্যের কঠিন কাজটি করে ফেলেছে সহজেই। কিন্তু মানিকের প্রদোষকে এরা এখনো ঠিক গিলে উঠতে পারলো কি?
আমার বুদ্ধির গোড়ায় চার্মিনারের ধোঁয়া না পড়াতেই বোধহয়,উত্তর পাই না। তবে আশাও ছাড়ছি না। ফি-বছর পূজোয় একটা করে নাটক নামানো পুলক ঘোষাল তো বি-কম ফেল ছিলো।
[১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭]
Leave a Reply