তপ্ত দুপুরে রোদ ঠেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভূ-গর্ভস্থ স্বাধীনতা যাদুঘরের প্রবেশমুখে যখন দাঁড়ানো যায়, মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র দেখানোর প্রশংসনীয় উদ্যোগটির প্রচারের প্রতি অনুরাগ তখন অনেকটা কমে। প্রচারটা কিন্তু এরা আরেকটু ঠিকঠাক করতে পারতো। সিনেমা দেখাতে পারো কিন্তু লোকজনকে জানাতে পারো না? তো, ঢাকঢোল একটু কম পেটানোতে যা হয়, টিকেটের স্বল্প মূল্য সত্ত্বেও সিনেমা শুরুর আগ মুহুর্তে দর্শকের সংখ্যা থেকে যায় হাতে গোণা। ঝিরঝির ও ঝামেলা করা প্রজেক্টরের সুবাদে পর্দায় ইমপ্রেস টেলিফিল্মের নাম ভেসে আসার আগে দর্শকের তাই অখণ্ড অবসর, বড় পর্দায় শামীম আখতারের সিনেমা রীনা ব্রাউনদেখার সম্ভাবনায় মাথার ভেতরে শাহবাগ থেকে রোদ মাড়িয়ে আসার বিক্ষোভ অনেকটা কমে।

দীর্ঘদিন আগে শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনকে নিয়ে শিলালিপি নামের চলচ্চিত্র বানিয়েছিলেন শামীম আখতার, জানতে পাই। মুক্তিযুদ্ধকে নতুন করে কী আঙ্গিকে তিনি উপস্থাপন করলেন রীনা ব্রাউন সিনেমায়, সেটা জানার তাই আগ্রহ ছিলো। সেই আগ্রহের অধিকাংশ ইট-সিমেন্ট যোগান দেয় সিনেমার নামকরণটাই। রীনা ব্রাউন। সেই রীনা ব্রাউন, তারাশংকরের উপন্যাস থেকে বাংলা সিনেমার পর্দায় এসেও যে অমলিন; সেই রীনা ব্রাউন- যার চরিত্রে অভিনয় করে সুচিত্রা সেন হয়ে ওঠেন আমাদের সারাটা জীবনের দীর্ঘশ্বাস; সেই রীনা ব্রাউন- যার অ্যাংলো ক্রিশ্চিয়ান পনিটেইল বাংলার একটি দশকের তরুণপ্রাণের কাছে রবার্তো ব্যাজ্জিওর চাইতেও স্বর্গীয়, সেই রীনা ব্রাউনকে আশ্রয় করে পর্দায় কী গল্প বলতে চাইলেন শামীম আখতার?

rb.jpg

পোস্টারঃ   IMDB-এর সৌজন্যে

বাহ্যিক দিক থেকে গল্পটি বেশ সাদামাটা। প্রতিদিনের জীবনযাপনে ক্লান্ত মধ্যবয়েসের অনেকটাই পেরিয়ে আসা এক মুক্তিযোদ্ধা এখনো আটকে রয়েছেন তার যৌবনের ভালোবাসার স্মৃতিতে। স্মৃতির সেই রীনা ব্রাউন একদিন হঠাৎ ফিরে এলে দুজনের আলাপে দর্শক আবিষ্কার করতে পারে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক বিক্ষুদ্ধ সময়। বিদ্রোহী উনসত্তর থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তি। অথচ এই উত্তাল ঘূর্ণির গাড্ডাতেও প্রেম এসেছিলো দুটি তরুণ হৃদয়ে। সংকট এই যে দারা নামের ছেলেটি মুসলমান, আর প্রেমের অন্যপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা স্যান্দ্রা নামের মেয়েটি ছিলো ধর্মে অ্যাংলো ক্রিশ্চিয়ান। তবু স্যান্দ্রাকে তার প্রেমিক পড়তে শেখায় বাংলা কবিতা, জানায় ইতিহাসের কী ভয়ানক পালাবদল চলছে দুনিয়ার এই প্রান্তে, আর ডাকে- রীনা ব্রাউন বলে। সব মিছিল ঘরে ফেরে একদিন, ফুরায় যুদ্ধদিনের লেনদেন; কিন্তু অন্ধকার ঘরে মুখোমুখি বসবার রীনা ব্রাউন আর থাকে না।

হেঁড়ে গলায় কথা বলা উন্নাসিক দর্শকের উপদ্রব বাদ দিলেও,স্বাধীনতা যাদুঘরের ভূ-গর্ভস্থ মিলনায়তনে সংলাপগুলো শান্তিমতো উপভোগ করা যায় না মৃদুভাষী সাউন্ড সিস্টেমের কারণে। চলমান ছবির রিলও মাঝে মাঝে ল্যাংড়া হয়ে পড়ে কয়েক মুহুর্তের জন্য। এছাড়া দর্শকের স্বল্পতা তো পীড়িত করেই। তবু সিনেমা-মূর্খ হয়ে, এবং হয়তো মূর্খ বলেই, ভালো লাগে ডকুমেন্টারি আদলে উত্তাল দিনের পালাবদল দেখানোটা, ভালো লাগে বদ্ধ ঘরে রাজনীতি সচেতন যুবকদের ভারি গলায় দেশপ্রেমের দীক্ষাগ্রহণ। সত্যজিৎ রায়ের সীমাবদ্ধ সিনেমার বরুণ চন্দের উপস্থিতির সাথে বাড়তি হিসেবে থাকে নামচরিত্রে প্রমা পাবণীর স্বচ্ছন্দ অভিনয়, মাহফুজ রিজভীও কাজ করেছে অনাড়ষ্ট।

কিন্তু হালখাতার হিসেব দূরে সরিয়ে রেখে, আমার মনে হয়, রীনা ব্রাউন চলচ্চিত্রটি মনে রাখতে হবে পরিচালকের সদিচ্ছার জন্য। বোধ হয়েছে, একটি বিশেষ দিকে আলো ফেলতে চেয়েছিলেন শামীম আখতার, স্পটলাইটের তলায় আনতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের অ্যাংলো ক্রিশ্চিয়ান সম্প্রদায়কে।

ফেলুদার আর্কিস-মার্কিস গল্পে, শংকরের চৌরঙ্গীতে অথবা অঞ্জন দত্তের পাড়ায় রিকশায় চড়ে দুলে দুলে চলে যাওয়া মেরি অ্যানরা খুব দুর্লভ না হলেও, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আরও অনেক কিছুর মতোই ক্যানো জানি উপেক্ষা করা হয়েছে রীনা ব্রাউনদের। শহিদুল জহিরের মুখের দিকে দেখি ছাড়া এ মুহুর্তে মনে আসছে না তেমন কিছুই। অথচ পুরোন ঢাকায় আর চট্টগ্রামের রাস্তায় খানিক হেঁটে বেড়ালেই আবিষ্কার করা যায়, আমাদের মতোই সমানতালে এই দেশটির ধূলা পায়ে মেখেছিলেন তারা। ফলে, যুদ্ধের মতো প্রকান্ড মানবিক বিপর্যয়ের কালেও মানুষের ব্যক্তি পরিসরের যে চিরকালীন ওলটপালট, সেটির স্যাম্পল হিসেবে অ্যাংলো ক্রিশ্চিয়ান এক পরিবারকে পর্দায় তুলে আনায় যথেষ্ট আগ্রহী আমি হয়ে উঠেছিলাম। সিনেমাটা হতে পারতো সদ্য স্বাধীন নতুন বাংলাদেশ কী করে রীনা ব্রাউনদের দূরে ঠেলে দিলো ধীরে ধীরে, সেটি আবিষ্কারের গল্প। কিন্তু পরিচালক সে পথে খুব একটা গেলেন না। আমাদের অনুভূতিপ্রবণের চেয়ে অনুভূতি জর্জর মনে তিনি কেবল মৃদু ফুলটোক্কা দিলেন। স্মরণ করিয়ে দিলেন, রীনা ব্রাউনরাও বাংলা কবিতার সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে কখনো বলেছিলো, ভালোবাসা মানে স্বাধীনতা।

কিন্তু খেয়াল রাখা দরকারঃ আমাদের বেহাল সড়কের দিনে, আমাদের নিরঙ্কুশ মতপ্রকাশের দিনে, আমাদের টুকরো ব্যক্তি হয়ে যাওয়ার বাস্তবতায়- ফুল খেলবার বিলাসিতা বেশিক্ষণ জ্বালাতে পারে না ভেতরের তুষ; জোরালো থাপ্পড় ছাড়া আমাদের মনোযোগ আকৃষ্ট হয় না কোনো দিকে। সিনেমা শেষে স্বাধীনতা যাদুঘরের ইতস্তত পদাচারণায় তাই, রীনা ব্রাউন কীভাবে যেন ঝাপসা হয়ে আসে। মৃদু এই খচখচানি নিয়েই দর্শক তখন পুনরায় বেরিয়ে পড়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শেষ বিকালে। যেমনটা হয়, সুচিত্রা-রীনা ব্রাউন-লাক্স সুন্দরীতে মিলেমিশে সেখানে তখন কেবল অস্বস্তি আর অস্বস্তি।

[১২ আগস্ট, ২০১৮]