বিংশ শতাব্দীতে যে কোনো মাস্টারপিসের আয়ূ হবে মাত্র ১৫ মিনিট! – বহু আগে পড়া কোনো ভ্রমণ-গদ্যের পাতা থেকে জ্ঞানীগুণী কোনো সাদা চামড়ার এই উক্তি মনে রেখেছি অনেক বছর হয়ে গেলো; অথচ ভেতরে ভেতরে কথাটা ঠিকই কামড়ায়। মনে হয়, বিংশ গিয়ে একবিংশ এসে পড়েছে এখন, পনেরো মিনিট চক্রহ্রাস হারে তাই পাঁচ মিনিটে নেমে আসার কথা। আসলে এই মনোযোগের স্থায়িত্ব কতো? তিন মিনিট, না তারও কম? আবার, দুঃসহ এই সময়ে কি এখন কবিতা পড়া সাজে?

কঠিন এসব প্রশ্নের উত্তর অজানা। সুহান তো জানেই না, শেফালিও জানে কি না সন্দেহ। ‘শেফালি কি জানে’ বলে প্রশ্ন ছোঁড়া হাসনাত শোয়েব নিজেও জানে বলে মনে হয় না।

রাজীব দত্তের মনে রাখার মতো একটি প্রচ্ছদ হতে উঁকি মারে গোলাফ পুল, প্রয়েড, বালো ভাষা আর জিবভা। কৌতূহল জাগে, কিন্তু বইটি কীসের ঠিক নিশ্চিত হওয়া যায় না। লেখক নিজেই এমন সংশয়ী হয়ে পড়েছে যে এই এক বইকে সে চালিয়ে দেয় কবিতা+বড়গল্প+ ছোটগল্প+ অণুগল্প+ উপন্যাস+ প্রবন্ধ এবং আরও যা যা আপনার মনে হইতে পারে, তার সবকিছুই বলে। ফলে যেটা হয়, প্রাবন্ধিক বা ঔপন্যাসিক বা গল্পকার বা কবি হাসনাত শোয়েবকে শিক্ষা দেয়ার জন্যে সংকলনটা পাঠকের নিজেরই পড়া লাগে।

shef.jpg

প্রথমেই মনে হয় কবিতাগুলো (নাকি গল্প/উপন্যাস/… ) বেশ নতুন ধরনের। নতুন কিছু সাধারণ ভাবে হয়ে থাকে হালকা বিশৃঙ্খলও, কিন্তু শেফালির জ্ঞানের পরিধি জানার জন্য যতই এগোই, মনে হয় বিশৃঙ্খলার মাঝে একটা ভারসাম্যের শৃঙ্খলাও আনাড়িপনা ছাড়াই উপস্থিত। শোয়েবের সিগনেচারটি আজব, এবং অ্যাতো আজব যে মাঝে মাঝে সাধ হয় লোকটাকে প্রাণ ভরে ট্রল করতে; এবং তখনই- এই কবিতা (কী উপন্যাস কী …) স্বতন্ত্র লাগতে থাকে। আস্তে ধীরে তখন স্বাদ নেয়া যায় গুঁড়োদুধ,হাওয়াই চপ্পল ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানবাবা,কর্নেল এবং উলমার বিষয়ক এলিজি কিংবা বিস্কিট রঙের দুপুরে সালমান শাহ’র মৃত্যু। ভালো লাগে এসব টুকরো কথা-

বিজ্ঞাপণের কোনো মোরালিটি নাই। তাই বিজ্ঞাপণ আমার ভালো লাগে।

বইয়ের আরো ভেতরে এগিয়ে গেলে শেফালি হয়তো একটা বিষয় লক্ষ করতে পারে। বাঙালির ছেলে যেমন ইঁচড়ে পাকা হয়ে উঠলেই কাব্য লিখতে শুরু করে ফিফটি সেভেনের ডি ফ্ল্যাটের ক্লাস এইটকে, ঠিক তেমনই সত্য যে এ যুগের যত পাঠক, তারা দর্শক হিসেবে এখন আর বঙ্গীয় দ্বীপে আবদ্ধ নাই। কালিসিংগীর মহাভারতকে অনেকাংশে সরিয়ে পড়ার টেবিল এখন আর.আর.মার্টিনের; রুপনগরের তৌকির আজ ভেগে গেছে নেটফ্লিক্সের ওয়াগনার মাওরা’র ভয়ে। এমন একটি সময়ে দাঁড়িয়ে বেশ আগ্রহোদ্দীপক একটি কাজ করেছেন শোয়েব, বেশ অনায়াসে- বলতে গেলে কোনো সংকোচ ছাড়াই- তিনি কবিতায় তুলে এনেছেন পৃথিবী নামক গ্লোবাল গ্রামের পপ কালচারকে। স্বীকার করি যে একেবারে কবিতা-মূর্খ বলেই বাংলা কবিতায় এই বিষয়টি আগেও কেউ সম্পন্ন করেছেন কি না, তা আমার অজ্ঞাত। ফলে পড়তে ভালো লাগে-

শুনেছি চেক দেশের একটি গাছের নাম হচ্ছে আব্বাস কিয়োরোস্তোমির নামে। এই গাছের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়ালে নিশ্চয়ই কিয়ারোস্তামির নিশ্বাসের শব্দ পাওয়া যাবে। তবে কিয়ারোস্তামি কি এখন গাছ? মানুষ যা ভালোবাসে, মৃত্যুর পর সে সম্ভবত তাই হয়ে যায়।

অথবা নিচের মনোলগটাও-

… রজার ফেদেরার জিতে নিয়েছেন ১৯তম গ্র্যান্ডস্লাম এবং পৃথিবীতে এখন মশা এবং ইঁদুরের চলছে সাম্রাজ্য চলছে। ম্যাজেস্টি, আপনি উঠে বসুন। জানালা খুলে দিলে দেখবেন, এইমাত্র উপবন এক্সপ্রেস শায়েস্তাগঞ্জ অতিক্রম করেছে আর দূর থেকে কেউ একজন চিৎকার করে বলছে, ‘মুম্বাই কা কিং কন, ভিখু মাত্রে!’

স্বদেশি পপ কালচারেও যে শোয়েবের আগ্রহ নাই, তা অবশ্য বলা দুস্কর। কখনো লোকটা মিঁয়া তানসেনকে দিয়ে পলাশী মোড়ে সেতারা বাজায়, কখনো সে ঢাকাইয়া বাঙ্কসির সুবোধকে লাগিয়ে দেয় চায়ের দোকানে। কিন্তু এই করে কি আর অপাপবিদ্ধ থাকা যাবে? মনোজ বাজপেয়ী, জনি ডেপ, মনিকা বেলুচ্চি আর সিলভিয়া প্লাথকে পাতায় পাতায় টেনে এনে শোয়েব বেশ কায়দা করেন। নিউ ইয়র্ক রিভিউতে দুনিয়াজোড়া উপন্যাসের গতিপ্রকৃতি নিয়ে একটা ভালো প্রবন্ধ ফেঁদেছিলেন টিম পার্কস, শোয়েবের লেখা আমায় আর শেফালিকে ভাবায় কবিতার জগতেও সেই পরিবর্তনের চিন্তায়।

আর শেষ পর্যন্ত, একবিংশ শতাব্দীর অনিবার্য বাস্তবতার মতো, শোয়েবের কবিতায় দেখা যাচ্ছে ব্যক্তির একাকীত্ব; কেবলই আত্মহত্যা-প্রবণতা। গলায় দড়ি দিয়ে সুইসাইড করে রুনুদি, গাড়ির লুকিং গ্লাসে নিজের মুখ দেখতে গিয়ে মারা যায় লোকটি, বেত মেরে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ানো শিক্ষক মারা যায় অর্থাভাবে ও ক্যান্সারে; এসব গল্প কেবলই দৃশ্যের জন্ম দেয়। অথচ আমরা মরিনি আজও, আমরা আজও বেঁচে আছি আজকের আগস্টের প্রথম সপ্তাহে, গণতন্ত্রে।

সেন্সরশিপ এখন বদলে গেছে তথ্যের অবিরাম প্রবাহে, গতি বন্ধ করতে চাও তো নানামুখী ছবি শেয়ারে অন্ধ করে দাও মানুষকে। শাহজানোয়ার এখন হাসিতে ধর্মঘট ডাকার প্রতিশ্রুতি দেয়, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রনায়ককে বেশ গালি দেয়া ফেসবুক গ্রুপের উত্তেজিত অ্যাডমিন নিজেই দু’তিনটি বিপরীত মতকে ধাক্কা মেরে ভার্চুয়াল কিছু চর দখল করে আর এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানো ওদিকে বলে যায় যে শহরের দেয়াল হলো মজদুরের প্রিন্টিং প্রেস। একবিংশ শতাব্দীর অ্যাতো সব মুহূর্তের মাস্টারপিসের মাঝে আমরা কোথায় খুঁজবো পরিত্রাণ, আত্মহত্যা ছাড়া?

আত্মহত্যা মূলত এক সুস্বাদু বিস্কুট, যার ক্রিমের লোভেই মানুষ খুনী হয়ে ওঠে- শোয়েবের এই ভাবনায় তাই একই সাথে ঈমান ও অবিশ্বাস, আস্থা ও অনাস্থা, ভালোবাসা ও ঘৃণা এনে আমরা ‘শেফালি কি জানে’ পড়ি। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, সময়ের যে রোগ- হাসনাত শোয়েবের কবিতা (অথবা গল্প/উপন্যাস/…) সেই রোগ ধারণ করে যথাযথ ভাবে। এর চেয়ে বেশি শেফালি ক্যানো, শেফালির বাপেও বলতে পারবে কি না সন্দেহ।