“…আমি সে চক্ষু দেখিতে দেখিতে অন্যমনস্ক হই, এর বেশি আর বুঝাইতে পারি না। “
-বিষবৃক্ষ [বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়]

প্রতিটা সন্ধ্যায়-এখানে- শুরু হয় নতুন দিন।

সাধারণতঃ মানুষের দিনের শুরু হয় ভোরে। পরীক্ষার্থী ছাত্র আর সদ্য দম্পতির জন্যে দিনের আরম্ভ দেরীতে হতে পারে কিছুটা, পত্রিকা হকার আর মসজিদগামী কিছু মানুষের আবার দিনের শুরু হয় খুব ভোরে। বাবা বলতেন- ঈশ্বর বেহেশতের দরজা খুলে রাখেন ঠিক সূর্যোদয়ের মুহুর্তে। বেহেশতের বাতাসে দিন শুরুর লোভে অবশ্য খুব বেশি মানুষ ভোরে ওঠে না আজকাল, আবার ছাত্রদের প্রতিদিন পরীক্ষা থাকে না। শহরের দিনের শুরুও তাই বদলে বদলে যায়। কিন্তু বাড়িভাড়া নেবার আগে তো সন্ধ্যায় কখনো এদিকটায় আসিনি, নয়নতারা হাউজিং সোসাইটির চার নম্বর বাড়ির তেতলার ফ্ল্যাট ৩/ডি বাসায় উঠবার আগে তাই আমি জানতামই না ঘটনাটা।

আমি আগে যেখানটায় থাকতাম, সেই শাঁখারিবাজারের ভাড়া বাসাটার সন্ধ্যাটা ভিন্ন মনে হতো না কখনো। কারণ সেই বাড়িতে রোদ ঢুঁকতো না কখনো, অসূর্যম্পশ্যা ঘর ছিলো আমার। সেই একই টিউব লাইট, শ্যাওলা পড়া দেয়ালে টিকটিকি, পাশে রুস্তমের দোকানে ডালপুরি বানানো লেগেই আছে। রিকশার গ্যারেজ ছিলো একটা গলিতে, দুইটা সেলুন, জয়তুন লন্ড্রি আর হেদায়েত রেস্তোরাঁ। রেস্তোরাঁ শব্দটা জাতে ফরাসি আর হেদায়েতের বাড়ি কুমিল্লা। ক্যাশবাক্সে হেদায়েত আর হিন্দী গান, বাংলা গানের ভিড়ে গলিতে সন্ধ্যাটা টুপ করে ঝরে যেতো নিউটনের আপেলের মতো। সপ্তাহে তিনদিন তো পড়াতেই যেতাম রামপুরা- আকবর দিল্লীর সম্রাট ছিলেন, সার্কের সদরদপ্তর কাঠমান্ডু আর তিন কোণের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রী।

নয়নতারা হাউজিং সোসাইটিতে বাসা নেবার পর অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম এই এলাকায় লোকে সান্ধ্যকালীন অন্ধত্বে ভোগে। …চলতি ভাষায় সন্ধ্যা রাতের অন্ধত্বকে রাতকানা বলা হয় কি? আমি ঠিক জানি না, তবে মনে হয় এটা রাতকানা রোগ হলেও হতে পারে। আমার ধারণা ছিলো টিভিতে জনস্বাস্থ্যের বিজ্ঞাপণ আর মলাঢেলার বিপ্লবে এই সাময়িক অন্ধত্ব বিদায় নিয়েছে দুনিয়া থেকে। অথচ এটা দেখি বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে- মানে, অন্ততঃ এই নয়নতারা হাউজিং সোসাইটিতে। সন্ধ্যা হলেই সোসাইটি বাসিন্দাদের অনেকেই দেখি হাতড়ে হাতড়ে চলাফেরা করে। সাদা লাঠির মানুষ।

প্রথমদিন বুঝতে পারিনি ব্যাপারটা। ভেবেছিলাম রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির লোকজন পদযাত্রা করেছে, কর্ণিয়া চায় বা এইরকম মহৎ কোন কাজ। দ্বিতীয়দিন একই ঘটনা দেখে একটু খটকা অবশ্য লাগে আমার, তৃতীয়দিনও দেখি, এমন কি চতুর্থদিনেও। এক হপ্তা পরে ঘটনাটা বুঝে যাই আমি। সোসাইটির লোকেরা সন্ধ্যায় অন্ধ হয়ে যায়। ৩/এফ ফ্ল্যাটের হায়দার সাহেবের কথাই বলি। দারুণ স্বাস্থ্যসচেতন ভদ্রলোক, দেখা হলেই মুখে ডায়েট আর ক্যালরি ছাড়া আলাপ নেই, রোজ সকালে ছাদে গিয়ে জগিং করেন। এক কথায় রাতকানা’র মতো সাধারণ রোগে পাবে তাকে- এটা ঠিক বিশ্বাস করার নয়। অথচ হায়দার সাহেব যখন অফিস থেকে ফেরেন, প্রতিদিন সাতটা পনেরো থেকে পয়ঁত্রিশের মাঝে, হাতে থাকে সাদা লাঠি। অবাক করার মতোই ঘটনা।

ঈঙ্গিতে-ইশারায় ঘটনাটা আমি জানতে চাইলাম হায়দার সাহেবের স্ত্রীর কাছে। মোটাসোটা হায়দার গিন্নী গোলগাল মুখে অবাক হয়ে পালটা প্রশ্ন করেন- ‘কোন ঘটনা?’

আমি এদিক-ওদিক করে প্রশ্ন করতে চাই তাকে, ‘মানে, প্রতিদিন সন্ধ্যায় যে ঘটে না … ওই ব্যাপারটা আর কি! মানে, বুঝলেন না- ওই যে সাদা লাঠির ব্যাপারটা…’

মিসেস হায়দারকে এই বিষয়ে সম্পূর্ণ অন্ধ দেখায়, বেচারী কিছুই জানেন না হায়দার সাহেবের সাদালাঠির বিষয়ে। ‘কী যে বলো না তুমি ছেলে! ও আবার সাদালাঠি ব্যহার করবে কেন? ওর কি চোখে সমস্যা আছে নাকি? … কী সব যে বলো!’

মিসেস হায়দারের বিস্ময় অকৃত্রিম, তিনি জানেন না। তিনি অন্ধকারে, যে আঁধার হয়তো নয়নতারা হাউজিং সোসাইটিতে সন্ধ্যার সারিবদ্ধ সাদালাঠিযুক্ত স্বাস্থ্যসচেতন সাহেবদের সৃষ্ট সমন্বিত শব্দের চাইতেও গাঢ়। আমার সন্দেহ হয় হায়দার সাহেব আসলে হয়তো সস্তা গোয়েন্দা নভেলের নাটুকে দ্বৈত জীবনযাপন করছেন। আমি জানি এই চিন্তা বাড়াবাড়ি, তবে হায়দার সাহেব তার অন্ধ জীবনযাপনে একা- আমি নিশ্চিত।

হায়দার সাহেব কিন্তু একা নন। ৪/বি এর বারি চাচা, ৩/এ এর মৃণালদা, ২/সি এর তারেক সাহেব থেকে শুরু করে মিসেস চৌধুরী এমনকি বাংলা কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে পড়া মিঠুন ছেলেটা পর্যন্ত সাদা লাঠি রাখে সাথে। সন্ধ্যা হলেই ঠক ঠক আওয়াজে সোসাইটি মাথায় তোলে সান্ধ্যভ্রমণকারীরা। হাঁটবার সময় তাদের বড় বিষণ্ণ দেখায়।

তবে ঠিক আমার ফ্ল্যাটের উলটো দিকের বারান্দার ইয়াজুদ্দিন সাহেব, যিনি অন্ধ- দিনেরাতে চব্বিশ ঘন্টার- তাকে কিন্তু বিষণ্ণ দেখায় না। লোডশেডিং হলে বারান্দায় বসলে বাতাস পাই, প্রায়ই আসি।

সান্ধ্যভ্রমণকারী, অফিস ফেরত হায়দার সাহেব, স্যারের পড়া করে বাসায় আসা মিঠুনেরা ঠকঠক করে বেড়ায় নীচে- ইয়াজুদ্দিন সাহেব মনে হয় খুব আমোদ পান এতে। তার চোখ- যা কাজ করে না- হাসে। তিন ফুট ব্যবধানের পদশব্দে তিনি আমার উপস্থিতি বুঝতে পারেন নিশ্চয়ই। এরপর আলাপ শুরু করে দেন ওখানেই, ‘কি ভাই, কেমন আছেন? … হ্যাঁ ভাই- আমিও আছি কোনরকম আপনাদের দোয়ায়। … কী, নীচের দিকে দেখছেন তো? … আরে ভাই কীভাবে হলো তা আপনিও বুঝে যাবেন সময় হলে। এখনো তো বয়স অল্প আপনার। সময় তো পেরিয়ে যায় নি… কী বলেন, এঁ? … ’ এরপরে হাসতে থাকেন ইয়াজুদ্দিন পাগলের মতো। মানুষটাকে ভালো লাগে।

আমার ভালো লাগলেও বাকি দু’জনের ভিন্ন মনোভাব। জসিমের আর ইজাজের। নয়নতারা হাউজিং সোসাইটির চার নম্বর বাড়ির তেতলার ফ্ল্যাট ৩/ডি বাসায় আমরা থাকি তিনজন। আমি, জসিম আর ইজাজ। বাসাটা বড় নয়, কিন্তু মেস বা শাঁখারিবাজারের একরুমের খাঁচার চাইতে এটাকে অনেক আপন মনে হয় আমাদের। কেমন আপন একটা আবহাওয়া, কেমন নিরিবিলি, কেমন নিরাপদ। যখন তখন পানি চলে যাবে না কলে, বাড়িওয়ালা ভাড়া বাড়াতে তাগাদা দেবে না ইচ্ছা মাফিক, ছাদে ওঠা নিষেধ নয় সাঁঝের বেলায়। আমাদের মনে হয় শাঁখারিবাজার বা মেসবাড়ি কতদূরের ঘটনা। মনে হয়, আমরা সম্রাট আকবর- সমস্ত ঝামেলার ঊর্ধ্বে।

তবে ঝামেলা কিন্তু আসেই, খবরের কাগজের মতোই নিয়মিত সেটা। শুনতে পাই জসিমের চোখে সমস্যা হচ্ছে নাকি ইদানীং, সন্ধ্যা হলেই এঘর থেকে ওঘর যেতে হোঁচট খাচ্ছে সে সমানে। জসিম আজকাল নিয়ম করে সন্ধ্যাবেলায় নয়নতারা হাউজিং সোসাইটিকে গালি দেয়। জসিম বলে, সে জানতো এরকম কিছুই একটা ঘটবে। তার বেলাতেই কেবল আল্লাহ কোন সুখ বেশিদিন সহ্য করেন না। সন্ধ্যায় আঁধার দুনিয়া আর তিনফুট ব্যবধানের বারান্দায় ইয়াজুদ্দিন সাহেবের হাসির শব্দে জসিম তাই ক্ষেপে ওঠে। ‘… শুয়োরের বাচ্চা হাসে ক্যান? হাসি বেশি হইসে হারামজাদার?… আন্ধা মানুষ নিয়া হাসাহাসি… কুত্তার বাচ্চায় গলার নলি ছিঁড়া ফ্যালামু কইলাম- ওরে থামবার ক…’।

দিন এইভাবেই কাটে। সকালে ক্লাস, বিকালে টিউশনি বা বারান্দায় বাতাস, সাদা লাঠির মিছিল, জসিমের তপ্ত গালিগালাজ বা ইয়াজুদ্দিনের হাসি। আমি আর ইজাজ ভাবি- কেবল না ভেবে বলি একে অপরকে- নয়নতারা হাউজিং সোসাইটিতে বাসা বলেই তো জসিমকে সাদা লাঠির দলে ভিড়িয়ে দেয়া যায় না, এটা বিজ্ঞানসম্মতও আচরণও নয় ঠিক। বরং তাকে ডাক্তার দেখানো উচিৎ আমাদের। রাতকানা আবার কোন অতিপ্রাকৃত রোগ নাকি? ডাক্তার দেখালেই সেরে যাবে এইসব…

ডাঃ মোস্তাফিজুর রহমান পান্থপথে বসেন, মোড়ের চেম্বার- সাজানো গোছানো – বারোশো ফি- রিসিপশনিস্ট আর কম্পাউন্ডারের চোখজোড়া সুস্থ- চশমা লাগে না। আমরা রিকশা নিয়ে যাই তিনজনে বাদ মাগরিব। একপাশে উপরে নীচে আমি আর ইজাজ, অন্যপাশে জসিম আর তার নতুন কেনা সাদা লাঠি। রিকশাওয়ালা প্যাডেল মারার ফাঁকে ঘুরে ঘুরে সহানুভূতির নজর দেয়- সেটার জন্যে আলাদা ভাড়া দাবি করে না সে।

ডাঃ মোস্তাফিজুর রহমান জসিমকে দেখে হতাশ হন। ক্লান্তস্বরে কেবল বলেন, ‘আপনার বাসা নয়নতারা হাউজিং সোসাইটিতে? তাহলে তো ভাই আমি আপনাকে কোন সাহায্য করতে পারবো না…’

তিনি আমাদের নিয়ে আসেন ওয়েটিং রুমে। হাত তুলে দেখান, ‘ ওই দেখেন, ওই লাল গেঞ্জির জওয়ান পোলাটা থেকে ওইদিকে কালো কোটওয়ালা মানুষটা- এরা সবাই নয়নতারা হাউজিং সোসাইটিতে। এনারাও অন্ধ হয়ে যান সন্ধ্যাবেলায়। এনাদেরও সাদালাঠি। আপনার নাম কি বললেন… জসিম? জসিম সাহেব, আপনি ওনাদের সাথে বসেন। আপনি ওনাদের জিজ্ঞাসা করে দেখেন ওনাদের কী খাইলে ভালো লাগে। আর পারলে বাইরে থেকে বেড়ায়ে-টেরায়ে আইসেন। বুঝেনই তো, দুনিয়া আর কয়দিনের…’

অনেক সান্ধ্য-অন্ধ চোখে দেখে আমরা বাসায় ফিরে আসি। জসিমকে খুব ক্লান্ত লাগে, সে নিজের ভবিতব্য মেনে নেয় নিশ্চয়ই- না মেনে পারে না। তবে আমি আর ইজাজ বড় বিব্রত বোধ করি। এতোগুলো অন্ধের অন্ধত্বের কারণ খুঁজে না পাওয়ায় নিজেদেরই কেমন তালকানা বোধ হতে থাকে। আমার মনে হয় আমাদের একটু খোঁজখবর নেয়া উচিৎ।

আমি একটু সার্চ করে দেখি ইন্টারনেটে।

সার্চ ইঞ্জিন অন্ধ নয়, বরং মুহুর্তেই স্ক্রিনে একগাদা অন্ধত্বের খবর আমার চোখ ঢেকে দেয়। আমি সবিস্ময়ে দেখি নয়নতারা কলোনীতে নয় শুধু, পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে গেছে সান্ধ্যকালীন অন্ধত্ব। একবিংশ শতাব্দীর মহামারী নাকি এটা- ছড়িয়ে পড়ছে খুবই দ্রূত। বিশেষজ্ঞেরা অনবহিত একদম, ভাইরাস হতে পারে- বা ইনফেকশান। তবে ছোঁয়াচে রোগ এটা। রক্তবাহী না পানিবাহী, কে জানে। গত ছয় মাসে ছড়িয়ে পড়া অজ্ঞাত অন্ধত্বে আক্রান্ত এখন দুইশো কোটি মানুষ।

রুস্তমের ডালপুরির দোকানে আর হেদায়েতের রেঁস্তোরায় যাই আমি অনেকদিন পর। দেখি ডালপুরি খেতে অনেক অন্ধ লোকেও আসে আর হেদায়েতের রেঁস্তোরায় সকালের পেপার বিকালে যখন হাত ঘুরে ঘুরে হলুদ হয়ে গেছে- সেখানে তখন পড়ি মহামারীর খবর। কী আশ্চর্য, রাজবাড়ি বা রাজশাহী কোথাও বাদ যায়নি রোগের প্রকোপ। আরো আশ্চর্য হলো রোগীর স্বজনেরা যারা মিসেস হায়দারের মতো মলাঢেলা মাছ বেশি করে রান্না করে না। রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলে।

টুইটারে তরুণীদের টুইটে জানা যায় জনপ্রিয় সিনেমা তারকা সরফরাজ খানকেও নাকি নিকেতন আবাসিক এলাকায় সন্ধ্যার পরে এলোমেলো হাঁটতে দেখা গেছে। আলোচনার ঝড়। শিল্পপতির কন্যা মিসেস খান অবশ্য নাকচ করে দিলেন এমন সমস্ত রটনা। সরফরাজ খান সম্পূর্ণ সুস্থ নাকি, টুইটার ভুল বলেছে। নয়নতারা হাউজিং সোসাইটির বিষয় বিবেচনা করে ঢাকাবাসী টুইটার ব্যবহারকারীদের আচরণে অবশ্য আমার তা মনে হয় না।

আমি চোখকান খোলা রেখে চলি এখন রাস্তায়। যদি চোখে না দেখে মাড়িয়ে দেই কোনো অন্ধকে, যদি অন্ধ কেউ ভুল করে এসে পড়ে আমার ওপর…

অন্ধের পৃথিবীতে আলো চোখের মানুষেরা অদৃশ্য মানবের মতোই অস্পৃশ্য।

ফেসবুকে লগইন করলে আজকাল মন খারাপ হয়। সবাই কেমন প্রোফাইল পিকচারে সাদা লাঠিওয়ালা ছবি ঝোলাচ্ছে দেখো। আর অন্ধ বুদ্ধুগুলোর বন্ধুগুলোও কেমন যেন। সাদা লাঠি গ্রাহ্য না করেই সস্তা মনভোলানো প্রশংসা। ‘দোস্তো, তোমারে যা লাগতাসে না!’, ‘ ও মাই গড, সিম্মি- তুমি এতো কিউট!’…

খুব বাজে লাগে এসব আদেখলাপনা দেখে। আরো খারাপ লাগে যখন দেখি আমারই ক্লাসের দুই সহপাঠী অন্ধ। কী আশ্চর্য! ঘূর্ণাক্ষরেও এতোদিন বুঝিনি ওদের অসুখ। কেমন গটগট করে হেঁটে ক্লাসে আসে ওরা। কেমন আমাদেরই ফটোকপি করে নেয়া মনির ভাইয়ের দোকানের গুটিগুটি অক্ষরের লেকচার শিট পড়ে ফেলে… ওরাও নাকি অন্ধ!

পরদিন ক্লাসে গিয়ে আমি সরাসরি প্রশ্ন করি ওদেরকে। ‘এই তোমরা নাকি অন্ধ? কই, দুইজনেই তো পড়তে পারো চশমা ছাড়াই, তোমরা তাইলে নিজেদের অন্ধ বলো ক্যান?’

আমার কথা শুনে অন্ধদ্বয় উত্তর দেয় না কোন। অন্ধ একটা নীরবতা নামে ক্লাসরুমে। শুধু একটা মেয়ে খিলখিল করে হেসে ফেলে আমার প্রশ্নে।

এই মেয়েটাকে আগে দেখেছি আমি, লক্ষ্য করিনি। ওর নাম মিলি। মিলি হাসতে হাসতেই বলে, ‘ এই বোকা ছেলেটা কী বলে! এই দুইজন নাকি অন্ধ! এই ছেলে, তুমি এইরকম আজব প্রশ্ন করো কেনো?!’

আমি আর কিছু বলতে পারি না। স্যার চলে আসে ক্লাসে। আমরা বসে বসে ক্লাসনোট তুলি খাতায়। আড়চোখে খেয়াল করি, চোখহীন দুইজনেও সমানে হাত চালাচ্ছে লিখতে গিয়ে।

সেদিন ছুটির পরেই ঘটে দুনিয়ার সবচেয়ে আশ্চর্য ঘটনা। ক্লাস শেষে বেরিয়ে যাবার সময় মিলি মেয়েটা কেমন এক স্বরে আমাকে বলে,‘ এই ছেলে, এই বোকা ছেলে ! চলো আমার সাথে। তোমাকে মধুর ক্যান্টিনে কফি খাওয়াবো। ..কি হইলো চলো ! কী আশ্চর্য, আরে এই বোকা ছেলে কোত্থেকে আসছে্‌?’…

এরপরে আমার গল্পটা পালটে যায়। আমি জানি গল্পটা অনেক চমৎকার হয়। কিন্তু জসিম আর ইজাজ সেটা পছন্দ করে না। আপনারাও গল্পটা পছন্দ করেন না। বলেন যে সিনেমা- নাটক-বইতে-লোকমুখে এরকম গল্প দেখেছেন-পড়েছেন-শুনেছেন। একদিন তো সবকিছুই গল্প হয়ে যায়।…

এরপর অনেকদিন কেটে গেছে। আমি এখনো নয়নতারা হাউজিং সোসাইটিতে থাকি। ঠিকানা পাল্টে তিন নম্বর বাড়ির চারতলার ফ্ল্যাট ৪/ডি হয়েছে। সঙ্গীও বদলেছে। জসিম আর ইজাজ স্বপরিবারে এই ঢাকারই অন্য কোথাও থাকে। আমিও থাকি স্ত্রী নিয়ে। তবে আমার স্ত্রীর নাম মিলি নয়। তবে তাতে কিছু যায় আসে না, আমি তার জন্যেও যথেষ্ট মায়া বোধ করি।

সোসাইটির পুরোনো বাসিন্দাদের অনেকে নেই। কেউ কেউ থেকে গেছে। হায়দার সাহেব, মৃণালদা নেই। বুড়ো বারি চাচা আছেন, মিথুন নামের ছেলেটা আছে। আছেন ইয়াজুদ্দিন সাহেব।

ইয়াজুদ্দিন সাহেবের মতন মানুষ খুব অল্প দেখি সোসাইটিতে। শুক্রবার জুম্মার সময় সবাই সোসাইটির মসজিদে গেলে সেখানে তাদের দেখা যায়। তারা দিনেও সাদালাঠি ব্যবহার করেন। ইয়াজুদ্দিন সাহেব, আকরাম ভাই, মিন্টু সাহেব, সোহেল চাচা। সাঁঝ পেরোলে অন্ধ বনে যাওয়া লোকেদের চাইতে এই ক্ষুদ্র দলটিকে আমার অনেক হাসিখুশি মনে হয়। কেনো, কে জানে।

হাসিখুশি থাকা কঠিন ব্যাপার। প্রতি সন্ধ্যায় ড্রয়িংরুমে বসে একত্রে টিভি দেখার সময় আমার স্ত্রী এই বিষয়ে অভিযোগ করে। তার মতে আমি হাসতেই জানি না নাকি। আমি মুখে কষ্ট করে একটা হাসি টেনে এনে চ্যানেল পাল্টাই। রিমোটটা হাতে নেবার সময় সাবধান থাকি। আমার সাদা লাঠিটা দেখে ফেললে সমস্যা।

মিলিকে হারিয়ে নয়নহীন জীবনযাপনে সাদা লাঠি নিয়ে অভিনয় করতে, নয়নতারা হাউজিং সোসাইটিতে আমার খুব কষ্ট করতে হয় না।

[জানুয়ারি, ২০১৩]