তাজউদ্দীনের সাথে ছেলেবেলায় আমার ঠিক পরিচয় হয়নি। বিপরীত শব্দ আর পাটিগণিতের ফাঁক গলে সুদূর শৈশব থেকে আবছা হয়ে কখনো কখনো তিনি উঁকি মারেন সামাজিক বিজ্ঞান বইতে, তার জন্য বরাদ্দ হয়ে রয় কিছু নীরস দাপ্তরিক শব্দ বড়জোর, নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হলেন তাজউদ্দীন আহমদ। ফলে, তাজউদ্দীন কখনো আমাদের হয়ে ওঠেন না। শৈশবের- তখনো সহনীয় যানজটের-ঢাকায় একটি ল্যাম্পপোস্টের বেশি কিছু তিনি নন; তিনি তখনো মাস্টারের নিয়মমাফিক প্রশ্নপত্রের জবাবে উগড়ে আসা উত্তরে, মুক্তিযুদ্ধের একটি অব্যয় মাত্র।
ভাবি- সেই তাজউদ্দীন আজ কোথায়? ক্যামন আছেন তিনি?
আমার কৈশোরেও তাজউদ্দীন নির্বাসনে রয়ে যান। উইলস কাপের জ্যাক ক্যালিস, সত্যজিতের ফেলুদা কিংবা বাংলাদেশ টেলিভিশনের দুর্ধর্ষ সব টিভি নাটক যতটা কাছের; উনিশশো একাত্তরে কলকাতার থিয়েটার রোডের দোতলা বাড়িতে বর্ষণমুখর রাতের শেষে চিন্তামগ্ন তাজউদ্দীন আমাদের কৈশোরেও ততটাই দূরে। মার্চ-এপ্রিল অথবা জুলাই, অথবা নভেম্বরের একটা আয়োজন করা পত্রিকার পাতায় একটা নামের বেশি কিছু তিনি তখনো হতে পারেননি। তাজউদ্দীন, একটা কুয়াশার আড়ালে- প্রায় অনুপস্থিত সম্ভ্রমে ঢেকে থাকা একটা নাম কেবল।
সেই তাজউদ্দীন এখন কোথায়? বাংলাদেশে তাকে পাওয়া যায় তো?
প্রকৃত প্রস্তাবে জেনে গেছি, এই লোকটিকে আবিষ্কার করার কাজটা বেশ দুরুহ।
তাজউদ্দীনকে আবিষ্কার করতে এবিং, মিসৌরির বাইরের কেউ কখনো তিনটি বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়নি। তাকে খুঁজে পেতে যেতে হয় ইতিহাসের কাদা সরিয়ে একাত্তরের মূলধারায়। প্রশাসনিক আদেশের থাপ্পড়ে রাস্তা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ঘর্মাক্ত মুখের কিশোরীদের পক্ষে তাজউদ্দীনকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তাজউদ্দীনকে খুঁজে পেতে হয় স্বেচ্ছায়, তাজউদ্দীনকে খুঁজে পায় পাবলিক লাইব্রেরির মলিন বইয়ের তাকে কোনো পাগলাটে গবেষকের অভিসন্দর্ভ নাড়াচাড়া করা উদ্যোমী। আর আমরা জানি, এই সময়ে অধিকার বাস্তবের পর্দা দাপিয়ে বেড়ানো মুন্না ভাইয়ের, এই যুগ হ্যাশট্যাগে ভরিয়ে তোলা ব্যক্তিগত তুচ্ছতম আনন্দ উদযাপনের। এই কাল অ্যাতো সূক্ষ সব উন্নয়নের, এখানে তাজউদ্দীন চিরটা কাল হয়ে থাকবেন শিলিগুঁড়ির ভাষণের পূর্ব-মুহুর্তের মতো কোণঠাসা।
তবুও, মগজের মাঝে জায়গাজমি দখল করে রাখা স্মার্টফোনদের পাশ কাটিয়ে, সংবাদ দিকপালদের সৃষ্ট স্বেচ্ছাচারী ধোঁয়াশার মাঝে টর্চলাইট মেরে, যে কিশোর-যে তরুণ একবার ঠিক করতে চায় কম্পাসের কাঁটা; ইতিহাসের সাগরতলে যে খুঁজতে চায় লাল-সবুজের একটি আস্ত আটলান্টিস নগরী, তাজউদ্দীন তার জন্য আদর্শ এক শেরপা।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে খতিয়ে দেখতে গেলে আবিষ্কার করা যায় এমন একটি মানুষকে, যিনি পৃথিবীর অন্য কোনো দ্রাঘিমাংশেও হাতঘড়িতে বাংলাদেশের সময় ধরে রেখে নিজেকে আড়াল করে ইতিহাস লিখতে চেয়েছিলেন সহকর্মীদের নিয়ে; নড়বড়ে এক কাঠমঞ্চে যিনি গঠন করেছিলেন বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীন সরকার, যিনি-সময়ে সময়ে শেখ মুজিবের ছবি নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ভেঙ্গে পড়তেন লাজুক কিশোরীর মতো অথচ বাংলাদেশের শত্রুদের সামনে শুধু ফাইল হাতেই ছিলেন ভীষণ নটোরিয়াস।
কিন্তু এসব মানুষকে মনে রেখে লাভ কি? ঢাকা শহরের পথঘাট আজকাল অনেক বেশি দুর্দান্ত। কখনো ভুল করে যদি তাজউদ্দীন আজও একবার বেরিয়ে পড়েন তার সেই বাইসাইকেল সঙ্গী করে, দেখবেন- ক্যামন অচেনা ঠেকছে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা কী কমলাপুর কী সদরঘাট।
পথে নামলে তাজউদ্দীন দেখবেন, ‘আমি রাজাকার’ প্ল্যাকার্ড বুকে ইতিহাসের মুখে প্রস্রাব ছাড়ছে এ যুগের শিক্ষার্থী। তাজউদ্দীন দেখবেন, দেশের পুলিশ ইদানিং এমনকী সিনেমার মতো শেষ দৃশ্যেও আসছে না, ফলে নিতান্ত বাধ্য হয়েই পুরোনো যুগের হাতুড়ি দিয়ে আইন রক্ষা করতে হচ্ছে নিরুপায় ছাত্রদের। তাজউদ্দীন আবিষ্কার করবেন, তাকে আহত করলে চাপাতি ধেয়ে আসে না স্বাধীন বাংলাদেশে, তাকে রক্ষা করার জন্য কোনো আইনের ধারা নেই। তিনি দেখবেন, ইতিহাস থেকে নিজেকে আড়াল করবার যে প্রবণতা তিনি দেখিয়ে গেছেন, সেই ভুলের ফাঁক গলে জ্ঞানের ভারে টলমল সব কী-বোর্ড যোদ্ধা তাকে ধুয়ে যাচ্ছে অনলাইনে কী টিভি-পর্দায়। তাজউদ্দীন তখন রাগ করবেন, মনের দুঃখে হয়তো ছুটে যাবেন রেসকোর্সের আশেপাশে একটি তর্জনী উঁচানো মানুষের দিকে। কিন্তু তাজউদ্দীন খুঁজে পাবেন এখন আঙুল কেবল শিক্ষকের দিকেই তাক করা হয়।
সরকারি অফিসের দেয়ালে সৌম্য হাসি নিয়ে তাকিয়ে থাকা শেখ মুজিবুর রহমানের দিকে তাকিয়ে তাজউদ্দীন তখন আরো একবার ভাববেন, ব্যাপারগুলো চেপে যাওয়াই ভালো, মুজিব ভাই এসব কথা শুনলে কষ্ট পাবেন।
আজ এদেশে যাত্রাদলের বিবেকের পার্টে অভিনয় করছে চাটুকার, আজ এখানে সকলের কাছে প্রিয় মুখেরা শুধু জ্য্যোছনার কথাই বলে- জননীর কাছে কেউ আসে না। এখানে, এই বাংলাদেশে, ইতিহাসের কাছে বাণিজ্যিক মনে গমন করা মানুষ আসলে মাংসরান্ধনকালীন ঘ্রাণই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। অগণিত র্যাম্বো আর হাতুড়ি হাতে ঘোরা জাস্টিস লিগের দাপুটে থরের পাশে, ছোটোখাটো স্টেটসম্যান তাজউদ্দীন আজ বাংলাদেশে কোথায়?
তিনি কি আজ স্মৃতির কোনো বকুল গাছকে অনেক পেছনে ফেলে ছায়াচ্ছন্ন বারান্দায় বসে থাকা কোনো ফেরারি বুলবুল শুধু?
এ প্রশ্ন সকলের। লেখার টেবিলে ছিটিয়ে থাকা যত গ্রন্থ, ড্রয়িংরুমের যত শাহাবুদ্দীনের ছবি, রেললাইনের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা সব সাবিনা ইয়াসমিন, ইতিহাসের পাতায় যত কামরুল হাসান- সবাই জানতে চায়, তাজউদ্দীন এখন কোথায়? নাটক সরণির যত পায়ের আওয়াজ, হিমুর যত ময়ূরাক্ষী নদীতীর, ঢাকার রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা যত কষ্টসহিষ্ণু আইজুদ্দিন, হাড্ডি খিজিরের যত রিকশার প্যাডেল – সকলের প্রশ্ন, কোথায় গেলেন তাজউদ্দীন?
লোকটার সন্ধান দিতে আমাদের চারপাশে একটু নজর বোলাতে হবে।
মফস্বলী যে তরুণ পাঠচক্রের ছায়ায় আরো দশজনকে বাতাস দিচ্ছে আর রাজনীতিকে জেনেছে সত্যি করে মানুষের ভালো করার রাস্তা হিসেবে, তাজউদ্দীন সেখানে আছেন। ইতিহাসের বইতে নজর রাখা আত্মপ্রত্যায়ী কোনো তরুণীর টানটান চোয়াল আর খেলার মাঠে সংস্কার জয় করা কিশোরীর হাসিতে রয়ে গেছেন তাজউদ্দীন। সেলফি-দ্যুতি এড়িয়ে চলা উস্কোখুস্কো চুলের যে যুবক নিতান্ত সস্তা শার্টে পড়িয়ে যাচ্ছে পথশিশুকে আর রক্তের সন্ধানে তোলপাড় করছে হাসপাতালের অলিগলি, তাজউদ্দীনকে খুঁজে পাওয়া যাবে সেখানেও।
তাজউদ্দীন এভাবেই আছেন। আর যতদিন তাজউদ্দীন থাকবেন, বাংলাদেশের আয়ূ তার চেয়ে অ্যাতোটুকু বেশি নয়।
[২৩ জুলাই, ২০১৮]
প্রিয় পাঠক,
কয়েক বছর ধরে একক শ্রমে গড়ে তোলা এই ওয়েবসাইটকে আমি চেষ্টা করেছি অগণিত বাংলাভাষী ওয়েবপোর্টালের মাঝে স্বতন্ত্র করে তুলতে। নানা স্বাদের এসব লেখা নির্মাণে আমাকে বিনিয়োগ করতে হয়েছে যথেষ্ট সময় আর শ্রম। এছাড়াও, পাঠক, আপনি এসব লেখা পড়তে পারছেন কোনো ধরনের বিজ্ঞাপণের উৎপাত ছাড়াই।
কাজেই প্রিয় পাঠক, স্বেচ্ছাশ্রমের এই ওয়েবসাইট চালু রাখতে প্রয়োজন হচ্ছে আপনার প্রণোদনার। আমরা চাইঃ এই সাইটের কোনো লেখা যদি আনন্দ দেয় আপনাকে, কিংবা আপনার উপকারে আসে- সেক্ষেত্রে ০১৭১৭ ৯৫৩০৮৭ (Personal) নাম্বারে বিকাশ (bKash) করে আপনি প্রণোদনা দিয়ে আমাদের উৎসাহিত করবেন।
আপনার সামান্য উৎসাহ বাংলাভাষী অন্তর্জালকে করে তুলতে পারে আরও আকর্ষণীয় লেখায় সমৃদ্ধ!
Hasan Mahmud
যাঁর অনন্য অন্তর্দৃষ্টিতে ছিল জাতির ও জাতির পিতার স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন, যাঁর অনন্য দুরদৃষ্টিতে ছিল ভবিষ্যতের দিকনির্দেশ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উত্তাল সাইক্লোনের মধ্যে যিনি সুদক্ষ হাতে আমাদের ভাঙ্গা নাওটাকে কূলে ভিড়িয়েছিলেন, বাংলার সেই অপরূপ তাজ, তাজউদ্দিনের প্রতি সুগভীর শ্রদ্ধায় বার বার “বাংলার কথা কই” ….(My book on history of Bengal)
Sharmin Ahmad
Heart felt writing. Thanks Hasan Mahmud bhai.
OnlyZitu
Hope young generation will find the Statesman-great leader-wise Tajuddin Ahmad…
Sharmin Ahmad
Shuhan Rizwan Superb!! once again you have captivated us- the readers by your brilliant write up on Tajuddin Ahmad. Your story comes alive in the boldness of your thought, keen observation, honest description and creative interplay between the bygone era and the present.