তখনো রেডিওকে বলা হয় ট্রানজিস্টার, তখনো গ্রাম্য বাজারের সন্ধ্যা ক্ষণে ক্ষণে বলিউড কী টালিগঞ্জের গানে রঙিন হতে দেরি, তখনো এগারো বছরের শৈশব মেলায় গিয়ে অবাক হয়ে আবিষ্কার করতে পারে যে মানুষ খেতে পারে ইয়া দামড়া সাইজের তলোয়ার। এমন একটা সময়কে পেছনে রেখেই জামাল আর লক্ষ্মীর দুরন্ত ছোটাছুটি নিয়ে শুরু হলো ‘মাটির প্রজার দেশে’

তবে কি আরো এক জোড়া অপু-দূর্গা দেখা হবে পর্দায়? অথবা আসমা-আনু? সিটে বসে সেই ভাবনাটা বের করার জায়গা পাওয়া গেলো না। কারণ ততক্ষণে লক্ষ্মীকে নিয়ে তৎপর হয়ে উঠেছে তার পিতা, মেয়েকে সম্প্রদান করতে পারলেই লোকটা বাঁচে। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে বাস ড্রাইভারের সাথে, লক্ষ্মীর নিজের হবু জামাইটিও ছেলে হিসেবে অতুলনীয়। তালুকদার বংশের ছেলে, ভাত খেতে বসলে ডিম থাকা ছোকরার জন্য রীতিমতো অপরিহার্য। ফলে আয়োজিত উৎসবে এক পলকের জন্য মুরগির রক্তাক্ত কাটা গলা দেখতেই দেখতেই দর্শক জেনে যায়, জামালকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করছে লক্ষ্মী। এবারও মেয়েটির মেলায় যাওয়া হবে না।

পরের দৃশ্যে বেহারার কাঁধে পালকি সওয়ার হয়েল লক্ষী জামাইয়ের বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয়, দূর থেকে তাকে অনুসরণ করে জামাল। হঠাৎ নববধূ বেরিয়ে এসে শস্যক্ষেত্রের মাঝে ছুট লাগায়। মৃদু হয়ে অ্যাতোক্ষণ যে সুর বাজছিলো কাহিনির পেছনে, মুহুর্তের জন্য তার মাঝে ভোগী জমিদারের কণ্ঠের উত্তাপ পাওয়া যায় এবার। কিন্তু যেহেতু গুপি বাঘা প্রোডাকশনের এই প্রযোজনাটি বাস্তবকে অগ্রাহ্য করতে চায়নি বলেই মনে হয়েছে, পালিয়ে লক্ষ্মী তাই যেতে পারে না খুব দূর।

শুরুতে গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়া লক্ষ্মীর মা অথবা জব্বার তালুকদারেরা এরপর মিলিয়ে গেলেও সিনেমা এগিয়ে যায়, সেটার মূল কেন্দ্র হয়ে ওঠে কিশোর জামালের রাগী জগৎ। সমস্ত সিনেমা জুড়ে ছেলেটার এই রাগী আচরণের মস্ত দাপট। কখনো সে মায়ের সমস্ত কাজ লণ্ডভণ্ড করে, কখনো সাইকেলের দোকানের হাফবেলা চাকরির মুখে লাথি মেরে পুকুরে ঢিল ছোঁড়ে। একদা জামাল এনজিও চালিত স্কুলে পড়েছে ক্লাস টু পর্যন্ত, কিন্তু বাড়ি বাড়ি কাজ করা কামের ছেমড়ির পোলা হয়েও তার খুব শখ আবার স্কুলে ভতি হয়। জামালের এই স্কুল ভর্তি এবং তার মায়ের অতীতকে কেন্দ্র করেই সিনেমা এগোয় পরিণতির দিকে।

শিকাগো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবির পুরস্কার জিতে নেওয়া ‘মাটির প্রজার দেশে’ নিয়ে আগ্রহের কমতি ছিলো না, তালি মারার উপলক্ষের জন্য হাতজোড়াও প্রস্তুতি ছিলো। কিন্তু জোতদারের ঘরে আগুন লাগানোর জন্য প্রস্তুত মজদুরের হাতের মশালের লালচে আলোয় যেমন শেষ হতো আবহমান বাংলার মে দিবসের বিশেষ নাটকের, তেমনই কিছু আক্ষেপ রয়ে গেলো। তবে আক্ষেপের বিপরীতে ব্যালেন্স মারাতে, না বললেই চলে না- এমন প্রসঙ্গও নিতান্ত কম নয়।

এদের মাঝে সবচাইতে উল্লেখ্য এলাকার মসজিদের হুজুর রাজ্জাক। সিনেমার ভেতরে লক্ষীর নামকরণ হুমকি পাচ্ছে আয়েশা হয়ে যেতে, সিনেমার বাইরে আজ ব্রিটেন জুড়ে অনলাইনে ঘুরে বেড়াচ্ছে মুসলমানদের পেটানোর বিদ্বেষ- এমন একটি পরিবেশে দাঁড়িয়ে রাজ্জাক চরিত্রটি দর্শকদের খানিক হাওয়া খাওয়ায়। মানুষকে সে মানুষ বলেই দেখতে শিখেছে- ফেসবুক কাঁপিয়ে সত্য পকেটে নিয়ে ঘোরার কায়দাটি তার এখনও অচেনা।

বলতে হবে জামালের চরিত্রে ভুরু কুঁচকে থাকা অভিনেতা অনিন্দ্যর কথাও। তবে এর চেয়েও তৃপ্তিদায়ক ছিলো সিনেমাটোগ্রাফার রামশ্রেয়াস রাও আর অ্যান্ড্রু ওয়েসম্যানের হাতের কাজ। মায়ের সাথে সোহাগে-অভিমানে কী লক্ষ্মীর সাথে খেলায় মেতে জামালের চোখজোড়া যে অবিশ্রান্ত রঙের সন্ধান করে গেছে, লাগসই ভাবে সেটাকে তুলে এনেছে ক্যামেরা। আকাশ ও পর্দা দখল করে থাকা বিশালাকার গাছটির নিচে মায়ের সাথে জামালের ছোটাছুটি দেখে ইচ্ছে হয় গভীরভাবে অচল মানুষ হয়ে উঠবার, জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা বহন করতে তখন বড় নিরুৎসাহ জাগে।

সিনেমার সমাজত্ত্ত্ব কী রাজনীতি নিয়ে বলাটা অন্য কারো জন্যেই থাক। অতিমূল্যায়নের অথবা দাপুটে সব অ্যাকশান সিনেমার বিপরীতে দাঁড়িয়ে হারানো সুদিনের নস্টালজিয়া আনতে লড়ে যাওয়া নিঃসঙ্গ শেরপার তকমা আঁটানোর চেষ্টাও করা বৃথা। দুয়েকটা দৃশ্যন্তর, বা একমাত্রিক সব চরিত্র অথবা সংলাপের এলিয়ে পড়ার কথাও অনুল্লেখ্য রাখা যায়। শেষ করতে চাই আসলে বিজন ইমতিয়াজের পরিচালনায় ‘মাটির প্রজার দেশে’র নিরুদ্বেগ বর্ণনাটার কথা বলেই। আগত গ্রীষ্মের অনতি-ভ্যাপসা ঢাকা শহরেও, সিনেমাটা কাল শীতের দিনে জ্বাল দেয়া ক্ষণিকের মিষ্টি রোদ হয়ে চমৎকার পিঠ ভিজিয়ে দিলো।

[এপ্রিল, ২০১৮]