সম্ভবত মুরাকামিই বলেছেন কথাটা। যতই কাছাকাছি হোক দুটো মানুষ, কোনো ক্রমে যদি একজন প্রবেশ করতে পারে অপরজনের ভেতরে- মুখোমুখি বসবার কিছু তখন আর থাকে না। কেবলই অন্ধকার পড়ে রয়। দক্ষিণ আফ্রিকান লেখক জে এম কোয়েটজি এই সত্য জানেন। তবে যে কোনো প্রথম শ্রেণির লেখকের মতোই, দীর্ঘদিন ধরে সঙ্গে বয়ে বেড়ানো একটি মানুষের জটিল ল্যাবিরিন্থের ভেতরের ঢোকার চেষ্টা তিনি করেছেন দা মাস্টার অফ পিটার্সবার্গ উপন্যাসে।

কোয়েটজির আতশ কাঁচের তলায় জায়গা নেওয়া মানুষটি মিখাইলেভিচ। কিন্তু উপন্যাসের কোনো পাঠক হয়তো খানিক আগে থেকেই আগ্রহের পারদ উঁচু করে রাখবেন এই সত্যটি জেনে, যে আঠারোশো উনসত্তরের এক শীতে জার্মানির ড্রেসডেন থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন শেষ করে যে মানুষটি ফিরেছেন পিটার্সবার্গ শহরে- উপন্যাসের সেই কেন্দ্রীয় চরিত্রটি আমাদের কাছে পরিচিত অন্য একটি নামে। ফিওদর দস্তয়েভস্কি।

উপন্যাসের শুরুতেই জানা যায়, যে দস্তয়েভস্কির পিটার্সবার্গে প্রত্যাবর্তনের কারণটি খুব সুখকর নয়। পুত্র পাভেলের, সত্যি বলতে গেলে বলতে হয় সৎ-পুত্র পাভেলের, রহস্যজনক মৃত্যুই দস্তয়েভস্কিকে ফিরিয়ে এনেছে পিটার্সবার্গে। পাভেল কীভাবে মরলো? আত্মহত্যা, না খুন? খুনই যদি হয়ে থাকে, তবে তার পেছনের রহস্যটা কী?

এসব সত্য জানতে দস্তয়েভস্কি রীতিমতো হন্য হয়ে ওঠেন। কাহিনিতে আসে মৃত পাভেলের বাড়িওয়ালি আনা সের্গেইয়েভনা, তার প্রতি কামনা জেগে ওঠে পুত্রের মৃত্যুতে সংলগ্নতা হারিয়ে ফেলা দস্তয়েভস্কির। বাড়িওয়ালির ছোট্ট মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়লে রাতের আঁধারে চলে দুজনের অভিসার। বাড়ির ভেতরের এই পরিস্থিতিতে, পিটার্সবার্গের দিনগুলোয় দস্তয়েভস্কি মুখোমুখি হন পুলিশ অফিসার ম্যাক্সিমভের। এ লোকটি পিতার আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়ে জানান যে রহস্যময় এক বিপ্লবী দলের সদস্য হতেও পারেন মৃত পাভেল, তার মৃত্যুর পেছনে থাকতে পারে সেই দলের পাণ্ডা নাচায়েভের হাত। দস্তয়েভস্কি অনুসন্ধান করে যান, এবং স্বভাবে বলশেভিক নাচায়েভের মুখোমুখিও হয়ে পড়েন। সকল প্রকার পুরানো প্রথার দেয়াল ধ্বসিয়ে রাশিয়ায় নতুন দিন আনতে, বিপ্লবের ফুল ফোটাতে এই নাচায়েভ খুঁচিয়ে যান দস্তয়েভস্কি’কে।

কোয়েটজির উপন্যাসের এই সাধারণ গতি বর্ণনার মাঝে থেকে আবিষ্কার করা যাবে না মাঝবয়েসি দস্তয়েভস্কির উন্মাতাল চিন্তাপ্রবাহকে। মনের ওপর চাপ ফেলা এক ক্যানভাসে দস্তয়েভস্কি এখানে রীতিমতো তার স্ব-রচিত কোনো উপন্যাসের চরিত্রই হয়ে উঠেছেন। চারপাশের পৃথিবী যেন সম্ভাব্য সমস্ত উপায়ে বিশ্বাসঘাতকতা করছে এই মানুষটির সাথে। তাকে পাগল করে তোলে নানা ধরনের প্রশ্ন। এই বিছানাতেই কি আনা সের্গেইয়েভনা’র সাথে প্রেম করেছে পাভেল নিজেও? পাভেল কি ঘৃণা করতো তার পিতাকে, সে কি সত্যিই ছিলো গোপন বলশেভিক দলটির সদস্য? নাচায়েভ যেমনটা বলছে, পাভেল কি তার পিতাকে দেখেছে বিপ্লবের শত্রু এক বুর্জোয়া হিসেবে? জিজ্ঞাসা গুলোর জবাব যেন মিলতে চায় না।

এবং কালি-কলমের ওস্তাদ দস্তয়েভস্কির সামনে কোয়েটজি এখানে উন্মুক্ত করেন পিটার্সবার্গের রুক্ষ জীবন, পতিতাবৃত্তি, গৃহহীন শিশু, অভিজাত তন্ত্রের শোষণ। আর এই উন্মুক্তকরণটা অবশ্য চলে দার্শনিক উপায়েই।

ইতিহাসকে উপন্যাসের পাতায় তুলে আনার ব্যাপারটা চিরকালই আমার কাছে বেশ কৌতূহলজনক ব্যাপার বলে, পড়া শেষ হলে একটু খোঁজ করি এই উপন্যাসের পেছনের পটভূমিটায়। জেনে অবাক লাগে যে, কোয়েটজির নিজের ছেলেই প্রাণ হারিয়েছে ঠিক পাভেলের মতো। তখন মনে হয় তাই, ছেলে হারানো পিতার ভূমিকায় দস্তয়েভস্কিকে চড়িয়ে দিয়ে কোয়েটজি যেন নিজেকেই একটু একটু করে কোরবানি করে দিলেন উপন্যাসের পাতায়।

উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র সের্গেই নাচায়েভ অবশ্য ইতিহাসের পাতায় পরিচিত গোপন এক নিহিলিস্ট দলের চাঁই হিসেবেই। কিন্তু সবচেয়ে মজা লাগে জেনে, যে পাভেলের মৃত্যুর রহস্য ভেদ- অর্থাৎ যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে দস্তয়েভস্কিকে চলে আসতে হয় সেন্ট পিটার্সবার্গে; প্রকৃতপক্ষে সেই পাভেল বেঁচে ছিলেন অনেকদিন, দস্তয়েভস্কি নিজে তার মৃত্যু দেখে যাননি। একেবারে হাওয়া থেকেই এই ঘটনা আমদানি করে কোয়েটজি সৃষ্টি করেছেন চমৎকার এক উপন্যাসের পৃথিবী। ভয় হয় যে আমাদের দেশে এই সাহসের দাম খুব বেশি দেয়া হবে না।

কিন্তু ক্যানো করলেন কোয়েটজি এই কাজ?

‘দা মাস্টার অফ পিটার্সবার্গ’ উপন্যাসের দিকে একটু দূর থেকে তাকালে হয়তো এ প্রশ্নের একটা ব্যাখ্যা মেলে। উপন্যাসের পটভূমি, দস্তয়েভস্কির মানস যাতনা, চরিত্রগুলোর সংলাপ; ভুল হতে পারে- কিন্তু সবই ক্যামন যেন মনে করিয়ে দেয় দস্তয়েভস্কির উপন্যাসগুলোকে। সত্য পকেটে নিয়ে ঘুরতে ভয় পাই বলেই, মৃদু এমন একটা সিদ্ধান্ত মনের মধ্যে তৈরি হয়, যে কোয়েটজি’কে আসলে ভর করেছিলেন দস্তয়েভস্কি। ওস্তাদের মাথায় ঢুকতে চেয়ে যে পৃথিবী কোয়েটজি তৈরি করলেন, মনে হলো যেন সেটার জলবায়ূ আমাদের পূর্ব-পরিচিত। মনে হলো, উপন্যাসের চূড়ান্ত উপলদ্ধিও আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে দস্তয়েভস্কি বলে গেছেন আগেই। অপ্রকৃতিস্থ অন্ধকারে ঢোকা ছাড়া চূড়ান্ত ও সুস্থির একটি জ্যোতির্ময় পৃথিবীতে মানুষ পৌঁছাতে পারে না।

কিন্তু হয়তো দস্তয়েভস্কি তাড়িত বলেই, হয়তো দার্শনিক প্রশ্নের ছড়াছড়ি বেশি বলেই, হয়তো একটি নির্দিষ্ট সময়ের ভাষাকে আশ্রিত করা হয়েছে বলেই; কোয়েটজির এই উপন্যাস মনে রাখার, ভালোবাসার নয়। ‘দা মাস্টার অফ পিটার্সবার্গ’ টানে সবাইকেই, কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না।

[২০ জুলাই, ২০১৮]