অনেক হাজার বছর আগে, তখনো আমি গায়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপ্পড় মেরে ঘুরে বেড়াই। একটির পর একটি নিত্য নতুন চিন্তার সাথে পরিচিত হয়ে যখন উদ্ভ্রান্ত হয়ে উঠছি, নিজের দুইহাত গণ্ডির বাইরে আবিষ্কার করছি বহু লেখক আর চিন্তককে- সেই সহস্র বছরের পুরানো কোনো সন্ধ্যায় আজিজ মার্কেটের তক্ষশীলায় তারেক রহিম আমাকে উপহার দিয়ে চাইলেন একটা ছোটো সাইজের কবিতার বই, ‘ফিরে এসো চাকা’।

উপহারটা সেদিন গ্রহণ করা হয়নি, কিন্তু কথা প্রসঙ্গে তারেক ভাই অ্যামন ক্ষেপে উঠেছিলেন সেই সন্ধ্যায়, যে আমার জানা হয়ে গেলো বিনয় মজুমদারের এই কাব্যগ্রন্থ আসলে গায়ত্রী চক্রবর্তীর দিকে নিবেদন, একটি মানুষীর প্রতি একটি পুরুষের পক্ষপাত।

বিনয় মজুমদারের কবিতা পড়ার আগেই এভাবে তাকে নিয়ে আমার টুকটাক জানা হয়ে ওঠে নানা জায়গায়।

কবিতা শব্দটাই কোমল, আর কাজে ও ভাবে তার সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রকৌশল নামের শব্দটি। এই দুই বিপ্রতীপ রাস্তা এসে মিলে গেছে বিনয় মজুমদার সরণীতে। কবি, অথচ প্রকৌশলী- বিনয়ের প্রতি আমার আগ্রহ প্রধানত জাগিয়ে রাখে এই ব্যাপারটিই। কিন্তু তখনো কবির রচনার দিকে হাত বাড়ানোটা ঠিক হয়ে ওঠেনি বলেই, মানুষটিকে নিয়ে নিজের এলোমেলো বাক্যসব সাজানো হয়ে উঠলো না ‘ফিরে এসো চাকা’ পড়বার আগে।

বইটা ভাবালো। এমন নয় যে সুললিত, পংক্তির পর পংক্তি থেকে ঝংকার এসে নাড়িয়ে যাচ্ছে পাঠককে- বিনয় মজুমদার সেদিক হাঁটেননি। শব্দের পর শব্দ বসছে নিখুঁত, কিন্তু তাতে প্রাণের সঞ্চার ঠিক হচ্ছে না, অনেকটা যেন উদ্দেশ্যহীন ও টিকিটাকা দর্শনের স্পেনের মাপা পাসের খেলাম, পরিচ্ছন্ন কিন্তু মন টানে না। কিন্তু এসবের মাঝে হঠাৎ করে সুযোগ-সন্ধানী স্ট্রাইকারের মতো ঝলসে ওঠে কোনো কোনো পংক্তি-

একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে,
দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে
পুনরায় ডুবে গেলো…

কৌতুকের সাথে খেয়াল করি, বিনয়ের কবিতাকে বর্ণনা করার জন্য আলোচ্য পংক্তিটি একেবারে মোক্ষম। কারণ একটি মাত্র বাক্য মুহুর্তের জন্য লাফ দিয়ে উঠে দর্শককে স্তন্ধ করে পুনরায় মিলিয়ে যাচ্ছে এই বিনয়ী কবিতায়। কে জানে, হয়তো এই মুহুর্ত মাত্র স্থায়ী আনন্দের জন্যেই কবিতার সৃষ্টি!

কবিতা নয়, কবিকে নিয়ে যতই এলোমেলো পড়ি, দুনিয়া শুদ্ধু লোকে ফাল পাড়ে যে বিনয় চেয়েছিলেন কবিতায় গণিতকে ধরতে। গণিত শ্বাশত ও সত্য, কবিতাকে সেই অবিনশ্বর রুপ দিতেই বিনয় ছিলেন সচেষ্ট। শোনা এই কথায় বিশ্বাস বেশ সহজেই স্থাপন করা যায় বিনয়ের কবিতার গড়নে।

খেয়াল করে মাঝে মাঝে দেখি, একটি অমায়িক সত্য, মাধ্যমিকের ভয়েস কী ন্যারেশনের যা ইউনিভার্সাল ট্রুথ, হঠাৎ যেন বেখেয়ালে এসে উঁকি মারছে বিনয়ের কবিতার জামায়। মানুষ নিকটে গেলে সারসের উড়ে যাবার অতি ব্যবহৃত উপমাটি বাদ দিলেও পাঠককে টোকা মেরে যায় দারুণ সব পর্যবেক্ষণঃ

তরুণ সেগুন গাছ, ঋজু আর শাখাহীন, অতি দীর্ঘ হয়; …


কিংবা,


কিছুটা সময় দিলে তবে দুধে সর ভেসে ওঠে।

এসব নিতান্ত প্রামাণ্য কথা-ই বিনয় মজুমদারের সনাক্তকারী চিহ্ন হয়ে আছে, চেষ্টা করলেই তাকে খুঁজে নেওয়া যায় এখান হতে।

কিন্তু কবিতার যে চির-চেনা ধরন আমাদের পাশের বাড়ির ছেলে, একটু খোঁজ করলেই ‘ফিরে এসো চাকা’র কলোনীতে সেই ছোকরার সন্ধানও মিলবে। ছেলেটির জামা কাপড়ও বেশ দেখবার মতো, ভালো মতো দেখলে মনে হয় আমাদের অতি-পরিচিত কাউকে যেন খুঁজে পেলাম। যেমনঃ

কাগজ কলম নিয়ে চুপচাপ বসে থাকা প্রয়োজন আজ,
প্রতিটি ব্যর্থতা, ক্লান্তি কী অস্পষ্ট আত্মচিন্তা সঙ্গে নিয়ে আসে।

অকারণ এ লেখা যখন লিখতে বসেছি, তখন আমার ও আমাদের চারপাশে কোনো আলো নেই। এখন বৈঠার বদলে হাতুড়ি তুলে নিয়েছে প্রলেতারিয়েত নয়, বুর্জোয়ার দল; এখন আমাদের চিরচেনা সমস্ত সম্পর্ক আমাদের আহত করছে শব্দে এবং রক্তে। আমাদের এখন জানা যে নিকটবর্তী উজ্জ্বল তারাদের অনেকেই আলোহীন গ্রহ। তবুও জীবনের প্রতি আমাদের, স্বার্থপর-ছোটোলোক থেকে যাওয়া আমাদের, লোভ কিছুতেই কমে না। কবিতা তাই একপ্রকার মুক্তি হয়ে আসে, যেখানে সুহানকে নিপুণভাবে আহত করে ছুটে যেতে বিনয় মজুমদারের মোটর কারের তেমন বেশি দেরি হয় না।

[জুলাই, ২০১৮]