মৌসুমের ৪র্থ গাঢ়-ছাই রঙ আকাশের দিন,
২য় দশক, একবিংশ শতাব্দী,
ঢাকা।

আজ সকালে বৃষ্টি হলো। কোনো রকম ভেজাল ছাড়াই প্যাঁচপ্যাঁচে গরম আর ঘামের গন্ধ বাড়ানো দোসরহীন ঢাকাইয়া বৃষ্টি। ফলে যেটা ঘটে, ব্যালকনি থেকে ঘড়ির এলোমেলো বিশটি মিনিট কেটে নিয়ে রাস্তা জুড়ে চলা রিকশাগুলো পালিয়ে যায়। মনে হয়, কমসে কম তিন হাজার বছর ধরে এরকম দিন আমার জীবনে আসে না। বরং মনে পড়ে বৃষ্টির তীব্র পাতের মাঝে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি স্টেডিয়ামের ওদিকে, ফুটপাথের টিকিট কাউন্টারের ওপরের তেরপল থেকে খানিক পর পর গড়িয়ে পড়ছে জমে থাকা পানি। কে যেন অনুযোগ করছে- আলম ভাইয়ের সাথে বের হলেই তাকে কোনো না কোনো ভাবে বিপত্তির শিকার হতে হয়। আলম ভাই লোকটা কি আজও সহযাত্রীদের বিপদে ফেলে?

স্টেডিয়ামের সেই পুরানো বৃষ্টিটাকে টুথপেস্টের সাথে গিলে নিয়ে ফেলে দিতে হয়। এসব বর্ষণমুখর দিনে স্কুলের পরীক্ষার জন্য পড়া রচনা মনে আসে আবার মনে আসে না, বরং মাথায় ঘোরে গোড়ালি পর্যন্ত পানি ছপ ছপ করা মাঠের ফুটবল। বৃষ্টির মাঝে পিছলা কেটে রাজিব ভাই পায়ে ব্যথা পেলো অনেকদিন হয়। কিন্তু অমন দক্ষ ফুটবলার রাজিব ভাইয়ের মুখটা আজ স্পষ্ট হয় না। বদলে একটি ধূসর হয়ে আসা টেবিলের ওপার থেকে কোনো কর্পোরেট অফিসের কর্তা আমার হিসাবের খাতা মিলিয়ে দেখে। এই শালারা কি কিছুতেই আমার পিছু ছাড়বে না? মাথার ভেতরে আমার বিস্ফোরণ ঘটে, সাথে অবশ্য একটা পরিচিত ঘড়িও চালু হয়, দ্রুত বের হওয়া দরকার।

বের হতে হতে বৃষ্টি থামে। কিন্তু রাস্তায় নামতেই মেজাজটা গরম হয়ে গেলো পায়খানার মতো কাদায় পা পড়ায়। নাক বন্ধ রেখে গন্ধ বাঁচিয়ে চলার যুদ্ধ করে লাভ হয় না, সড়কের পাশে ওঁত পাতা মাছওয়ালার থালার মাধ্যমে খলবল করা শিং মাছের গা থেকে ছিটকে আসা পানি সেঁটে যায় প্যান্টে। সামনের কিন্ডারগার্ডেনে খুচরো পিচ্চিদের দিতে আসা হিজাব অথবা সালোয়ার কামিজ অথবা জিন্স গায়ে পারফিউম মারা গার্জিয়ানদের ভিড়ের মাঝে দশ মিনিট বসে থাকলেও এই মেছো গন্ধ দূর হবে না। এদিকে রিকশাওয়ালারা এক একজন নবাবজাদা হয়ে বসে আছে। এইটুকু রাস্তার ভাড়া সত্তর টাকা? ষাট টাকা বললেও তো হয়। মুখ সামলে রিকশায় উঠি। কিন্তু মোড়ের জ্যামটা কাটতেই দামী কয়েকটা মিনিট যায়, শালার দিনের শুরুটাই খারাপ হয়ে গেলো।

মোড় পেরিয়ে চিপাগলিতে ঢুকলে ফাঁকা পেয়ে কিন্তু ভালোই লাগে। উলটো দিক থেকে ছুটে আসা মোটরসাইকেলকে গালি দিতে ইচ্ছা হয় ঠিক, কিন্তু নামজাদা স্কুলের সামনে পেপার বিছিয়ে বসে সচেতন অথচ অকর্মা আন্টি কিংবা বিসিএস গাইড পড়া বেকার ছোকরাদের দেখতে খারাপ লাগে না। এমন কী ভিক্ষা চাইতে আসা বৃদ্ধদের জন্যেও খানিক মায়া মায়া বোধ হয়। একটু ফুরফুরে বাতাস গায়ে লাগলে ভালো লাগার পরিমাণ ভালোই বাড়ে। এবং এর সাথে কানাগলি থেকে ছুটে এসে কেউ আজ কোনো মালাউন কী কলেজ শিক্ষককে কুপিয়ে যাবে না- এরকম একটা ভাবনাও কিছুক্ষণ লালন করা চলে। কিন্তু ঢাকার সকাল কী আর আমার জন্যে অতক্ষণ অপাপবিদ্ধ থাকতে পারে? চিপাগলি থেকে মাঝারি রাস্তা হয়ে বড় রাস্তায় উঠবার মুখে আবার জ্যাম লাগে।

এই রাস্তাটা খারাপ। বর্ষার নিয়মিত খোঁড়াখুঁড়ি তো আছেই,সারারাত ট্রাক চলায় পিচে পাকা অংশটাও গ্রামের রাস্তার মতো। রিকশা চললে সারা গা ঝাঁকুনি খায়। চালক একটু জোরে প্যাডাল মারার চেষ্টা নিলে সেই ঝাঁকুনি অ্যাতো বাড়ে যে দৃষ্টি স্থির রাখা যায় না,পাশের মার্কেটের গায়ে বিশ ফুটের বিদ্যা সিনহা মীম পর্যন্ত ঝাপসা হয়ে পড়ে। পথের ঐ অংশটা পেরিয়েও অবিচলিত থাকা যায় না পেছনের গাড়ির ক্রমাগত হর্নে। তবে গলা বাড়িয়ে পুলিশের গাড়ি দেখে আর প্রতিবাদী সুপারহিরো হতে পারি না। অতটা বিপ্লব করা, এখনো আমার পোষাবে না।

এরপর সিনেমার পোস্টার আর বাদল স্যারের হাতের লেখা শেখানোর বিজ্ঞাপণ দেখতে দেখতে, পথের পাশের বাসি তেলে ভাজা পরোটা আর বুটের ডালের গন্ধ নিতে নিতে গন্তব্য এসে যায়। আজও কয়েক মিনিট এদিক -সেদিক হয়ে গেছে,  ওভারব্রিজে উঠে আরো দেরী করে কথা শোনার মানে হয় না। একটু একটু রোদ উঠছে, তাকে সাক্ষী রেখে আমি চলন্ত বাস আর রিকশার ভিড় ঠেলে রোড ডিভাইডারের ভাঙা রেলিং এর ফাঁক গলে রাস্তা পার হই। একশো গজ হাঁটলেই অফিস।

অফিসে ঢুকতেই সব পালটায়। ‘অস্ত্র তোমার গোপন রাখো কোন তূণে?’- জানতে চেয়ে সাহানা বাজপেয়ী আর গুনগুন করেন না। ফার্স্ট ইয়ারে মোস্তাকিমের রুমে পরিচয় হওয়া সেই ডেড পোয়েট জন কিটিং পর্যন্ত সারাটা পথ ফিসফিসিয়ে ‘সিজ দ্যা ডে, সিজ দ্যা ডে!’বলে আসলেও এখন চুপ মেরে যান। আমাকে বরং অধিকার করে ফেলে টেবিলের দখল রাখা দু’দশটি অসমাপ্ত হিসাব, ডেস্কটপের চার কি পাঁচটা এলোমেলো মেইল।

অফিস জুড়ে অনেক ভারি ভারি অফিসার। ছোটো কর্তা হাসে, মেজো কর্তা কাজ চাপায়, বড় কর্তা দাঁত খিঁচায়। অলৌকিক সব লাভক্ষতির হিসাবনিকাশে এরা অ্যাতো দক্ষ যে আমাকে এদের প্রয়োজনই হয় না। তবু এরা আমায় ছাড়বে না। তাদের তাচ্ছিল্যের হাসিতে দিনভর মিশে থাকে হোটেল রেডিসনের বিশাল হলরুমের সুগন্ধ, জাহাঙ্গীর গেটের জ্যামে আটকে পড়া পাজেরো গাড়ির মাঝে অপেক্ষায় তিক্ত হয়ে ওঠা এয়ার ফ্রেশনারের ঘ্রাণ। মনে হয়, এদের সুখী আর নিশ্চিন্ত জীবনযাপনের পাশে একটিমাত্র অকিঞ্চিৎ স্বেদবিন্দুর চেয়ে বেশি কিছু আমি হতে পারিনি। এরকম তুচ্ছ, অপ্রয়োজনীয় থেকে আমার জীবন নিঃশেষিত হয়ে যাবে ভেবে খুব ভয় করে।

শরীর জুড়ে এই ভয় ছড়িয়ে পড়তে পড়তে উপদেশ শুনি, ‘ফাইনান্সিয়াল অ্যানালিসিসটা কিন্তু খুব ভালোমতো করতে হবে। প্রকিউরমেন্টের আমিন মোহাম্মদ টাকাপয়সা মারতেছে কি না, জানা দরকার!’

টাকাপয়সার কথা বলতে গিয়ে বনানী, ধানমন্ডি এবং ওয়ারিতে সব মিলিয়ে পাঁচ ফ্ল্যাটের মালিক  কণ্ঠস্বরটা তীক্ষ্ণ হয়। আমার মাথায় আগুন জ্বলে। শালা ঘুষখোর! অফিসের তিনটা গাড়ি সারাক্ষণ তোর ছেলে আর মেয়ের ডিউটি মারে, তোর বউয়ের নামে পূর্বাচলে পনেরো কাঠা জায়গা কেনা, তোর ভাইস্তা অফিসে মদ খেয়ে মেয়ে এনে আজেবাজে কাজ করে- আর তুই এখানে বসে সততা শেখাচ্ছিস? কুত্তার বাচ্চাকে কথা শোনানোর জন্য আমার গলা নিশপিশ করে।

কিন্তু এসব কথা আর বলা হয় না। ঠিক ভয়ে নয়, ভয় আমি পাই না। আসলে সিনক্রিয়েট করতে যেমন ভালো লাগে না, তেমন আবার এদের সাথে কথা বলতেও আমার রুচিতে বাঁধে। জন ডেনভার কি কখনো এদের বাড়িতে আমন্ত্রণ পায়? বুদ্ধদেব বসুর হাত ধরে এরা কি কখনো বোদলেয়ারের মেঘ খুঁজতে চেয়েছে? ক্রেডিট কার্ডের পিন আর কারেন্সির জটিল কনভার্সনের রেটের ফাঁক গলে এদের সমস্ত জীবনটা পড়ে গেলো বলে আমার আসলে করুণা হয়। সেই করুণা আমার ভেতরটা ভরে রাখে অনেকক্ষণ, অন্তত ছয়টা পর্যন্ত, যখন আমি অফিস ছাড়ি।

আমাদের অফিসটাতে সূর্যের প্রবেশ একেবারে নিষেধ,আমায় দেখে সালাম দেয়া সিকিউরিটি অবশ্য মেঘের ডাক আটকাতে পারছে না। আমি নিচে নেমে ব্যাগ থেকে ছাতি বের করলাম,তার মাঝেই টুপটাপে চশমা ছেয়ে যায়। এসব বিকালে বাসায় ফেরা অপরাধ, রাস্তা পেরিয়ে রেস্তোঁরায় বসে শিক-কাবাব নিয়ে আসতে বলি। তার সাথে চা।

বিকালের কাঁটায় ছয়টার চ্যাঁচানো,মানুষ তবু সর্বক্ষণ চালু এই রেস্তোঁরায় ঢুকছে। আমি সবাইকে দেখতে পাই। মহিলাসহ কেবিনের ব্যবস্থা আছে বলে বড় বিজ্ঞাপণ। খানিক বয়স্ক, হাঁটাচলায় ঈষৎ টালমাটাল ওয়েটারটি হেরোইন খায়, শুনি। কাছেই কোনো রেস্তোঁরায় শাটার টেনে কেউ কাউকে মার দিয়েছে সেদিন রাত্রে- আমার মুখের ভেতর শিক কাবাবের সাথে থকথক করে এসব সংবাদে। আমি স্পষ্ট দেখি, ঐ তো ষাটের দশকের সৈয়দ শামসুল হক। সকাল থেকে বসে আছেন এই রেস্তোঁরায়, লিখছেন তার রক্তগোলাপ নভেলা, খানিক পরেই শেষ করবেন লেখা। আমি অপেক্ষা করে থাকি, শেলি আর সন্তুর পেছনে পেছনে অঞ্জন দত্ত কোনো একটা কেবিনে ঢুকে গেছেন দেখবো বলে।

বেরিয়ে যাবার সময় ছোকরা ওয়েটার দাঁত বের করে বলে, ‘বিশটি হইতাছে!’

আমি ছাতা খুলে মাথা বাঁচিয়ে বেরিয়ে যাই। বৃষ্টির প্রবল পাতের ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে দেখি ছুটে পালাচ্ছে সবাই। দোকানের আশ্রয়ে, ওভারব্রিজের নিচে, চালকেরা রিকশার ভেতরে গুটিসুটি। ছাতাহীনেরা কী যে ঈর্ষা নিয়ে আমার মতো কজনকে দেখে! এসব ভোদাইয়ের বাড়ি ফেরার তাড়া দেখে মনে মনে হাসি। আরে বাবা বর্ষাকালে যে ছাতা নিয়ে বেরোতে হবে, একথা ভুলে গেলে কী চলে!

মূল সড়ক থেকে ভেতরে চলে যাওয়া ব্যস্ত চওড়া গলিটায় কেউ নেই। থেমে থেমে রিকশা আসে। তাদের টুংটাং খুব ঠুনকো জোর বৃষ্টিতে।

ভাবি, আজ সন্ধ্যায় করবোটা কী? নিঃসঙ্গ একটা সন্ধ্যা কাটানো যায় নাকি বইয়ের দোকানগুলোয়? নাকি একই সাথে আধখাওয়া উপন্যাসগুলোর কোনোটা নিয়ে বসবো? ইয়োসার ডেথ অ্যাট আন্দেস বা সতীনাথের ঢোঁড়াইচরিত? নাহ- তার চেয়ে বরং গান শোনা ভালো। বৃষ্টির দিনে রবীন্দ্রনাথ খুব জমে। এসব ভাবতে ভাবতেই ছিপছিপে বৃষ্টি আর বখাটে বজ্রপাতের প্রেম দেখি। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলো আজ অনেকদিন হয়, এই দুজনের প্রেম তবু কত অমলিন।

পিচের সড়কে বারিপাত একেবারে গন্ধহীন। সামনে দেখি একটা লাল-কস্টেপে প্যাঁচানো বল। বহুতল অ্যাপার্টমেন্টের বারান্দা থেকে খুদে কোনো সাকিব বোধহয় ফেলে দিয়েছে। বৃষ্টিতে আজ স্কুল মাঠে কেউ ফুটবল খেলছে না? কলোনীর সেই ভাইয়াটার নাম কিছুতেই মনে করতে পারি না। কোনো যাদুমন্ত্রে একযুগ আগে মৃত দুপুরে অর্থহীন বাজানো সেই ভাইয়াটা কি আজও বৃষ্টিতে মৌসুমী ভৌমিকের গান ছেড়েছে?

ভিজে জুতো আর আধভেজা পিঠের ব্যাগ, ঝাপসা চশমার কাঁচ,ছিটছিট পানিতে সপসপে প্যান্ট নিয়ে রিকশায় উঠবার আগেই বৃষ্টি থেমে যায়। আর রিকশায় উঠতেই ধেয়ে আসে বাতাস- কী মসৃণ সে- মাথার ভেতরে বুদবুদটা ভেঙে ছড়িয়ে যায় এবার।

আরেফিন রুমি আর তিশা কাঁপছে বিলবোর্ডে, সাহায্যের নামে কেড়ে নেবে বলে সিগন্যালে ওঁত পেতে বসে আছে বৃহন্নলারা, বিনয়-বাদল-দীনেশের গতিতে পানি উঠে আসছে। আমি মোমিনুল ইসলাম, ঢাকা ভার্সিটি থেকে ইকোনোমিক্সে মাস্টার্স পাশ করে একটা চাকরি করি বেসরকারি অফিসে, ছদ্মনামে গল্প লিখি একটা-দুটা, আমার ভালোবাসার মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে আজ আট মাস হয়। আমার বোধশক্তি তবুও লোপ পায়নি। আমি জানি কত বিপর্যস্ত কত অশালীন কত একা কত অশুভ ভয় নিয়ে এই বেঁচে থাকা,আমি জানি দুর্ভোগের এই শহরে বৃষ্টি কত দুরুহ করবে অগণিতের ফেরা।

তবু এই বাতাস, ধুলো হয়ে যাওয়া ব্যাবিলন আর ছাই হয়ে যাওয়া অ্যাসিরিয়ার পরেও এই ছোটোলোক স্বার্থপর বাতাস, করোটির বুদবুদকে শহরময় ছড়িয়ে দিতে দিতে জানান দেয়,এই বৃষ্টি বিকেলে আমি এখনো সম্রাটের মতো বেঁচে আছি।

[আগস্ট, ২০১৭]