পেরুভিয়ান ঔপন্যাসিক মারিও ভার্গাস ইয়োসা’র মুখোমুখি হয়েছিলেন তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক মাইকেল স্কাফিদা। জুন ২০১৮-এর শেষভাগে ওয়াশিংটন পোস্টের মতামত বিভাগে প্রকাশিত উক্ত সাক্ষাৎকারটির প্রায় পুরোটাই এখানে অনুবাদ করা হলোঃ 

প্রশ্নঃ
কয়েকজন সদস্যের ওপর যৌন নিপীড়নের অভিযোগ আসায় এবার সুইডিশ অ্যাকাডেমি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করলো না। আপনি নিজেও তো একবার এই পুরস্কার জিতেছেন, ঘটনাটা শুনে আপনার ক্যামন লেগেছে?

ইয়োসাঃ
জীবনেও ভাবিনি যে সুইডেনে এরকম কিছু ঘটতে পারে!

ঘটনাটা থেকে বোঝা গেলো, যে আমরা আসলে সব দেশকে এক রকমের স্টেরিওটাইপিং-এর ভেতর দিয়ে দেখি। এখন দ্যাখেন, স্পষ্ট হয়েছে যে সুইডিশরাও মানুষ, ওদের দেশেও খারাপ কিছু ঘটতে পারে। সাধারণ মানুষের কাছে কিন্তু তবু পুরো ব্যাপারটা এসেছে একটা ধাক্কার মতো!

নোবেল ঘোষিত না হওয়াটাও দুঃখজনক। তবে সামনের বছর তো দুজন পুরস্কার পাবে, সেটা একরকমের মন্দের ভালো।

প্রশ্নঃ
#MeToo আন্দোলন নিয়ে কী বলবেন? ব্যাপারটা তো বিশ্বজুড়ে একেবারে তোলপাড় লাগিয়ে দিলো! বলতে গেলে একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে এটা কেন্দ্র করে।

ইয়োসাঃ
নারী নির্যাতনের সমালোচনা করাটা তো মানুষের কর্তব্য! এমন কোনো জায়গা নাই যেখানে কোনো ধরনের নির্যাতন হয় না। কাজেই এই আন্দোলনের সাথে আমি পূর্ণ সংহতি জানাই। শুধু তো এই আন্দোলন না; সুবিচার, গণতন্ত্র আর নারী-পুরুষের সমতার জন্য যত ধরনের আন্দোলন আছে, সবগুলোর প্রতিই আমার সমর্থন থাকবে।

তবে আজকালকার নারীবাদে এক ধরনের সমস্যা লক্ষ করছি। ব্যাপারটা ক্যামন যেন খুব সংকীর্ণ হয়ে উঠছে, চাপিয়ে দেয়া মতবাদের মতো। আপনাদের কিন্ত এই প্রবণতাটার সমালোচনা করতে হবে। যেমন ধরেন, কিছুদিন আগেই শুনলাম, যে স্পেনের কয়েকজন নারীবাদী মিলে একটা হইচই লাগিয়ে দিয়েছে। তাদের বিতর্কে আক্রমণের লক্ষ্য হচ্ছে একটা উপন্যাস, নবোকভের ‘লোলিতা’। আমার কাছে সেটা বিংশ শতাব্দীর সেরা কাজগুলোর একটা। কিন্তু ওই নারীবাদীদের সমস্যাটা কী? নাহ, তাদের দাবি, এই উপন্যাসের মূল চরিত্র একজন শিশুকামী।

… এটা কোনো কথা? আরে এরকম বিচার করলে তো সাহিত্যের কোনো অস্তিত্বই থাকে না! খালি আদর্শবাদী, শুদ্ধ ধ্যান ধারণা নিয়ে তো সাহিত্য রচনা হয় না; লেখালেখি তো মনের কুৎসিত ব্যাপারগুলোও তুলে আনবে!

জর্জ বাতালি বলেছিলেন যে মানুষের ভেতরে শয়তান আর ফেরেশতা- দুটো সত্ত্বাই থাকে। ফেরেশতারা ভালো, কিন্তু সাহিত্যের জন্য শয়তানকেও সমান ভাবে দরকার। আমারও তেমনটাই মনে হয়। বাস্তব জীবনে আমরা যা লুকিয়ে রাখতে চাই, সাহিত্য সেটা উন্মুক্ত করে দেয়। সাহিত্য জিনিসটা বেঁচেই থাকে ওই কারণে। মানুষের দোষ, সংস্কার বা নির্বুদ্ধিতা- এসবের কারণে তাই সাহিত্যকে দোষ দেয়া যায় না। আমি মনেপ্রাণে চাই যে নারীবাদের কণ্ঠস্বর যেন আরও স্পষ্ট হয়, কিন্তু লেখালেখির ওপর কোনো নিয়ম আরোপ করাকে আমি মেনে নেবো না। আরেকটু সহজ করে বললে, কোনো সাংস্কৃতিক আচরণের ওপরেই নিষেধাজ্ঞা চাপানো যাবে না।

প্রশ্নঃ
২০১৫ সালে আপনার একটা সংকলন বেরোয়- ‘চশমা চোখের সভ্যতা’। সেখানে আপনি আক্ষেপ করেছিলেন এই বলে, যে আধুনিক পৃথিবীতে মানুষের চিন্তা তেমন কোনো প্রভাব রাখতে পারছে না। ঐ সংকলনে আপনি ‘সংস্কৃতির মৃত্যু প্রসঙ্গে কিছু কথা’ নামে যে প্রবন্ধ লিখেছিলেন, তরুণ প্রজন্ম সেটা খুব ভালো ভাবে নেয়নি। এমন কী, আপনাকে রক্ষণশীল, গোঁড়া- এরকম তকমাও দেওয়া হয়েছিলো। এখন আপনার কী মনে হয়, নবীনদের বিরোধিতাটা কতটা যৌক্তিক ছিলো?

ইয়োসাঃ
আজকের বিশ্বে যারা তরুণ, তারা এমন একটা সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠেছে, যেখানে চিন্তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ছবি, প্রতিবিম্ব। কাজেই চিন্তার শক্তিটা তাদের কাছে অচেনা। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো, সংস্কৃতি এখন সত্যিকার অর্থেই বৈশ্বিক, প্রাচ্য আর পশ্চিমের মাঝে আপনি কোনো পার্থক্য করতে পারবেন না। আমরা সবাই এখন একটা নতুন সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়েছি, যেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ছবি।

তরুণরা মনে করে যে এসব ছবি বা প্রতিমা- যেটাই বলেন না ক্যানো- মানুষকে আধুনিক করে, সৃষ্টিশীল করে। কিন্তু ব্যাপারটা ভুল। ছবি আসলে নিষ্ক্রিয় মানুষের জন্ম দেয়। যে লোকটা চিন্তায় বিশ্বাস করে- তার তুলনায় ছবির প্রভাবে বেড়ে ওঠা একটা মানুষকে চুপ করিয়ে দেয়াটা সোজা। মৌলিক চিন্তার শক্তি শেয়ার করা ছবির চাইতে অনেক বেশি। বয়স তো কম হলো না। সারা জীবন ধরেই আমি দেখলাম যে সমাজ বদলের যুদ্ধ সবসময় হয়েছে বিপরীত দুই চিন্তাধারার মধ্যে। কোনো কোনো বুদ্ধিজীবীকে দেখেছি, তারা কম্যুনিজম, মার্ক্সিজমের পক্ষে ছিলেন। কিছুদিন তারা খাতিরও পেয়েছেন, কিন্তু পরে দেখা গেছে আসলে এরা সত্যিকারের প্রগতির পক্ষ নিতে পারেন নাই।

আমি এখন এই বিষয় নিয়েই ব্যস্ত। একটা আত্মজীবনীর মতো লিখছি। প্রথম যৌবনের মার্ক্সিজম থেকে কীভাবে আমি আস্তে আস্তে প্রথমে গণতন্ত্র, পরে আরো উদারনীতির দিকে সরে এসেছি- তা নিয়ে আমি সেখানে বিস্তারিত লিখবো। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ন সাতজন চিন্তককে নিয়ে সেখানে সাতটা প্রবন্ধ থাকবে। এদের মাঝে অ্যাডাম স্মিথ আছেন, হোসে ওর্তেগা আছেন, ইসা বার্লিন আছেন। বামদের অতি বিপ্লবী হয়ে ওঠার যে ধ্বংসাত্বক প্রবণতা, এরা সবাই সেটার বিপক্ষে ছিলেন।

প্রশ্নঃ
আপনার প্রথম উপন্যাস ‘নায়কের কাল’ প্রকাশিত হয় ১৯৬২-তে। আপনার সাহিত্যিক যে সত্ত্বাকে আমরা চিনি, সেটার শুরুটা ওখানেই হয়েছিলো। তো আমাদের মনে হয়েছে আপনার লেখাকে দুটো বিষয় খুব প্রভাবিত করেছে। একটা হচ্ছে বাস্তব জীবনে কর্তৃত্বপরায়ণ পিতার প্রতি আপনার ক্ষোভ, আরেকটা হচ্ছে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আপনার এক ধরনের আদর্শিক দৃঢ়তা। এই পর্যবেক্ষণ নিয়ে আপনার মতামত কী?

ইয়োসাঃ
আমি আপনার সাথে একমত।

তবে আরও একজন আমাকে খুব প্রভাবিত করেছিলেন। সাত্রে। উনি বলতেন যে, লেখা দিয়ে ইতিহাস গড়া যায়, পৃথিবী বদলানো যায়। একটা ভয়হীন, উদার দুনিয়া গঠন করার উপায় হচ্ছে লেখালেখি। আমি তখন তৃতীয় বিশ্বের একজন তরুণ লেখক, আমার দেশে খুব বেশি মানুষের তখন পড়ার অভ্যাস নাই। সাত্রে পড়ে আমি তাই খুব উদ্দীপিত বোধ করতাম। লেখালেখি যে শুধু আনন্দ পাবার জন্যেই না, এটা যে পরিবর্তন আনার একটা রাস্তা- সেই বোধটাও আমার মধ্যে তখনই জন্মায়।

হয়তো এই কথাগুলো শুনতে এখন হাস্যকর রকমের সরল, কিন্তু আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি যে একসময় ওগুলো আমাদের শক্তি দিয়েছে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের লেখকদের।

প্রশ্নঃ
শেষ প্রশ্ন। প্রয়াত নাদিন গর্ডিমার একটা কথা বলেছিলেন, যে ঔপন্যাসিক হচ্ছেন প্রাকৃতজনের ইতিহাসবিদ। আপনি কি এটার সাথে একমত?

ইয়োসাঃ
পুরোপুরি!

সত্যি বলতে, ঔপন্যাসিকের এই সংজ্ঞাটা আসলেই চমৎকার। ইতিহাস আর সাহিত্য তো মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। একটা অন্যটার খুবই কাছাকাছি। কখনো কখনো তো সাহিত্যে বর্ণিত ইতিহাসটাই ঐতিহাসিকের বয়ানকে ছাড়িয়ে যায়। যেমন টলস্টয়ের কথাই ধরেন। নেপোলিয়ানের যুদ্ধের যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, তার কি তুলনা হয়? ইতিহাসবিদ হয়তো আরো বেশি তথ্য দিতে পারবেন, কিন্তু ওখানে লেখক কল্পনাকে যেভাবে প্রসারিত করলেন- সেটার তো মাত্রাই আলাদা!

যে সব লেখা বাস্তবের খুব কাছাকাছি, আমার সেগুলো পড়তেই ভালো লাগে। নির্জনতার জন্য লেখক জনমানুষ থেকে সরে গিয়ে কোনো লাইব্রেরিতে বসে থাকবেন, আমি তেমনটা ঠিক অনুমোদন করি না। ওরকম লেখকদের পড়তে কিন্তু আমার ভাল লাগে, যেমন ধরেন- বোর্হেস। কিন্তু আমি সেরকম হতে চাই না।

সব লেখকের রচনাই আসলে আত্মজৈবনিক। কোনো কোনো লেখক ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখতে পারেন না- প্রকাশ পেয়ে যায়, আর কেউ হয়তো বিষয়টা একটু ভালোমতো গোপন রাখতে পারেন। কিন্তু আমার মনে হয় না একেবারে শুন্য থেকে কিছু সৃষ্টি করা যায়। সব সময়ই লেখাটা বেরিয়ে আসে নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকেই।

[৫ জুলাই, ২০১৮]