স্মার্টফোনের সামনে মাথা নত করে থাকায় অনেক কিছুই চোখ এড়িয়ে যায়, এমন কী ভিড়ের মাঝে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা সুপারহিরোরাও। যেহেতু “Popularity is the slutty little cousin of prestige”, সেহেতু নিজের সেরা সময় পেছনে ফেলে আসা একজন শিল্পীর দিকে পুনরার দৃষ্টি ফেরাবার কথা নয় ইদানিং কেবল অন্যের চোখে পড়তে চাওয়ার মহামারিতে আক্রান্ত মানুষের। অতীতচারী এসব শিল্পী, টকশোর পর্দায় ‘আমাদের সময়ে আমরা যখন অমুক রাজা-উজির মেরেছি’ বলে আহাজারি করা ছাড়া অন্য কিছুতে যারা বেমানান, অস্তিত্বের এক রকম ভীষণ সংকটের চোটে আর অগণিত টুইটার সমালোচকের ভিড়ে এরা আজকাল ভীষণ পর্যুদস্ত। ‘বার্ডম্যান’ সিনেমাটা দ্বিতীয়বার দেখার পর ড্রোন বিমানের এই যুগে ব্রাত্য হয়ে পড়া পক্ষীমানবদের দিকে তাই চোখ ফেরাতো হলো আবার। পরিচালনায় ছিলেন সেই আলেহান্দ্রো ইনারিতু, ‘বাবেল’ বা ‘আমেরোস পেরোস’ এর মতো বহুদিন মনে রাখার মতো সিনেমা এসেছে যার হাত ধরে।
“How did we end up here? … This place is horrible.”- সিনেমার আরম্ভেই এ স্বগোতক্তিতে ইনারিতু স্পষ্ট করে দেন, বার্ডম্যান স্বস্তিতে নেই। এখানে বার্ডম্যান কে? রিগান থমসন নামের এক অভিনেতা, বার্ডম্যান নামের এক সুপারহিরোর ভূমিকায় অভিনয়ের সুবাদে এককালে যে পয়সা আর নামযশ- দুটোই কামিয়েছে। কিন্তু আধুনিক পৃথিবীতে সুপারহিরোর প্রয়োজন নাই, আর রিগান নিজেও হয়ে পড়েছে প্রায় বৃদ্ধ। ফলে সে এবার নিজেই প্রযোজনায় নেমেছে, মঞ্চনাটকে অভিনয় দিয়ে নিউ ইয়র্কের ব্রডওয়ে মাতাতে চায় রিগান। অন্তঃসারশূন্য কোনো সেলেব্রিটি সুপারহিরো নয়, সে যে একজন প্রকৃত অভিনেতা- এই কথাটি প্রমাণ করতে চেয়ে রিগান থমসন এখন ব্যাকস্টেজে উদ্ভ্রান্ত।
উদ্ভ্রান্ত এই সাবেক সুপারহিরোর সাথে মঞ্চনাটকে পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে যোগ দেয় মাইক শাইনার। লোকটা তুখোড় এক তরুণ অভিনয়শিল্পী, অথচ নীতি-ভব্যতা-সৌজন্য বিবর্জিত। মঞ্চের পেছনে কাজ করছে রিগানের মাদকাসক্ত মেয়ে স্যাম, ছেলেবেলায় ব্যস্ত বাবার কাছ ত্থেকে প্রয়োজনীয় সময়টা সে পায়নি, কিন্তু এর চাইতেও তাকে বেশি পোড়ায় অতীতে সময় না দেয়ার অপারগতা ঢাকতে ইদানিং বাবার মাত্রাতিরিক্ত স্নেহ ঝরানো। এদের সাথে আরো কিছু চরিত্র মিলেই নাটকের দলটা প্রস্তুত হতে থাকে ব্রডওয়ে মাতাতে, মাঝে মাঝে দেখা দিয়ে যায় রিগানের প্রাক্তন স্ত্রীও।
কিন্তু রেমন্ড কারভারের ছোটগল্প অবলম্বনে বানানো মঞ্চনাটকটি ঘিরে ভিড় জমায় একের পর এক সংশয়। কেবল একটিবারের জন্য রিগান নিজের কাছেই প্রমাণ করতে চায় নিজের অভিনয়সত্ত্বাকে। অথচ স্যামের ধারণা, এ যুগের ভাইরাল হতে চাওয়া তরুণ প্রজন্মকে ক্রমাগত ধুয়ে দেওয়া তার বাবা এই নাটক করছে আধুনিক পৃথিবীতে নিজেকে আরো একবার প্রাসঙ্গিক করে তুলতে শুধু। এসব বলে ফেসবুকে পেজ না থাকা-তথা অস্তিত্বহীন হয়ে থাকা- রিগানের প্রতি স্যাম রাগ ঝাড়ে।
অন্যদিকে, নিজেই প্রযোজনা করছে বলে নাটকের সাফল্য নিয়ে রিগানের নিজের চিন্তাও আজকাল কম নয়। বার্ডম্যান থাকাকালীন সময়ে ইচ্ছে হলেই সে সাঁই করে উড়ে গিয়ে মুহুর্মুহু ধ্বংস করেছে যুদ্ধবিমান আর শত্রুঘাঁটি, কিন্তু এখন বুড়ো হয়েছে – একগাদা রাশভারি দর্শকের সামনে মনস্তাত্ত্বিক সংলাপ আওড়ে তাদের সে কতটা আলোড়িত করতে পারবে, এই নিয়ে রিগানের বেশ দ্বিধা আছে। সাথে যুক্ত হয়েছে সমালোচকেরা। শিল্প নিয়ে খুব বিচলিত এই সমালোচক দলের চোখে রিগান হলিউডের একজন মেয়াদোত্তীর্ণ মাল। কখনোই লোকটা অভিনেতা ছিলো না, আজও হবে না। পক্ষীমানবের সাজপোষাকের আড়ালে একদা ব্লকবাস্টার হিট জন্ম দেওয়া এই ভাঁড়ের নাটক দেখার দরকারটা কী? বরং তার নাটকটাকে ধুয়ে দিতে টাবিথা ডিকিনসনের মতো অজস্র সমালোচকের হাত আজ নিশপিশ করে। বার্ডম্যান সিনেমা এগিয়ে যায় এসব নিয়েই।
সিনেমার কারিগরি দিক নিয়ে বলাটা কঠিন, তবে এটুকু বোঝা যায় যে ইনারিতু ওখানে চোখে পড়ার মতো কাজ দেখিয়েছেন লংশট দিয়ে। অন্যের মনোযোগ আকর্ষণের আধুনিক মানুষী-প্রবণতার কথা সিনেমায় প্রচ্ছন্নভাবে এসেছে বারবার। কাজেই ইনারিতু, যাকে আমরা চিনি বিশাল পটভূমিতে একের পর এক মোচড় মারা গল্প বলিয়ে হিসেবে- সেই ইনারিতু কেবল সংলাপের ঘনঘটা আর লংশটের যাদু দিয়ে নিজেকেই তাই এখানে চোখে পড়তে চাওয়ার উদাহরণ হিসেবে তুলে এনে ব্যঙ্গ করলেন-এমনটা তাই মনে হয় মাঝে মাঝে। অনিয়মিত ড্রাম বাদনের কথাও বলতে হবে। সিনেমার শুরু থেকেই নানা কায়দায়, নানা তালে, সংলাপের মাঝের বিরতি থেকে শুরু করে একেবারে অপ্রস্তুত মুহুর্তেও ড্রাম বাজিয়ে মুগ্ধ করে ফেলা হয়েছে দর্শককে। শাইনারের ভূমিকায় এডওয়ার্ড নর্টন আর স্যামের ভূমিকায় এমা স্টোনের কথা যেমন না বলে থাকা যাবে না, তেমনি রিগান থমসনের চরিত্রে থাকা মাইকেল কিটনের প্রশংসা শুরু করলেও থামাটাই দর্শকের পক্ষে হয়ে পড়বে দুস্কর। নাটকের ভেতর লুকিয়ে থাকে আরেক নাটক, ইনারিতুর আলোচ্য প্রহসন আমাদের তাই উপহার দেয় আরো একটি রসিকতা। সুপারহিরো ব্যাটম্যানের ভূমিকায় একদা অভিনয় করা মাইকেল কিটন নিজেও যে এখন বয়সকালে একের পর এক চড়া শিল্পমূল্যের ছবিতে অভিনয় করছেন, এ সাদৃশ্য খেয়াল করলে মুচকি ও তিক্ত হাসি না মেরে উপায় কী?
বার্ডম্যানের ছাল গায় চড়ানো জনপ্রিয়তা খুঁটে বাঁচতে রিগান চায়নি। সে চেয়েছে সত্যিকারের অভিনেতা হতে, সযত্নে এড়াতে চেয়েছে সেলফি-বিব্রত তারকার দ্যুতি। আর এই করতে গিয়ে রিগানের নতুন কস্টিউম বানাতে হয়েছে আত্মপ্রেম, অহং আর নিরাপত্তাহীনতার সুতা দিয়ে। সমালোচকের মুখোমুখি হয়ে সে নিজেকে অভিনেতা দাবি করে গলা তুলেছে, কারণ রিগান জানে নিরাপদ দূরত্বে বসে মনোযোগ আর অধুনা ফেসবুকে লাইক কামানো এসব লোকের হারানোর কিছু নেই, কিন্তু শিল্পী হারাতে পারে তার সর্বস্ব। আবার বিপাকে পড়ে প্রায় নগ্ন হয়ে দর্শকসারির মাঝ দিয়ে হেঁটে গিয়েও নাটকের সংলাপের আবরণে ‘What’s wrong with me? Why do I always beg people to love me?’ বাণী ছেড়ে রিগানকে প্রমাণ করতে হয়েছে যে কাপড়খোলা ছাড়া এ যুগে বিনোদন প্রত্যাশী জনতার দৃষ্টি আকর্ষণ শিল্পীর জন্য কতটা কঠিন।
সব মিলিয়ে, বার্ডম্যান তাই এক অন্ধকারের সুপারহিরোর গল্প। অন্যের প্রত্যাখ্যানের সারাক্ষণ থরথর ভয়ে কাঁপতে থাকা সব শিল্পীর মনের ভেতরেই এই সুপারহিরোর বাস, আধুনিক সব রিগানের দৈন্যদশা সে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে স্পষ্ট করে দেয়। আর স্মরণ করিয়ে দেয় যে, একবিংশ শতাব্দীর মহাব্যস্ত সোশ্যাল নেটওয়ার্কের চৌরাস্তায় প্রতিনিয়ত বিচারের মুখোমুখি হওয়ায় পায়ের তলায় মাটি যখন সরে যাচ্ছে, কাঁপতে থাকা অস্থিতিশীল বিজয় সরণি বা টাইমস স্কোয়ারে দাঁড়িয়ে একটি- কেবল একটি কাজই মানুষ করতে পারে তখন। উড়াল দেওয়া।
শেষ দৃশ্যে এমা স্টোনের টানা চোখের একরাশ বিস্ময়কে তাই কেবল যাদুবাস্তব বলে ভাবলে ভুল হবে।
[১৩ জানুয়ারি, ২০১৮]
Leave a Reply