প্যারিস, ফ্রান্স।
ডি অরসে’র ইম্প্রেশনিজম আর ফভিজমের চক্কর থেকে বেরিয়ে সীন নদীর ওপারে গেলেই ল্যুভরের ভেনাস ডি মাইলোর সামনে চাইনিজদের আস্ত একটি মহকুমা সেল্ফি তোলায় ব্যস্ত। ভিঞ্চি আছেন, কিন্তু অগ্রাহ্য করা যায় না পল সেজানের তাসের খেলা, রাফায়েল সান্তিনির যিশু, আক্কাদ সভ্যতার হাজার নয়েক বছরের পুরোনো মূর্তিকে। এখানেই শেষ নয়। রোদিন আছেন নরকের দরজায় চিন্তিত মুখ নিয়ে, পিকাসো আছেন কিউবিজমে, দালির পাগলামি ভরা সময়ের ঘোড়া আছে; যাদুঘর এখানে যাদু দেখিয়ে দিচ্ছে।
ঘর থেকে বেরিয়ে পথে নামলে রাস্তার নাম স্তালিনগ্রাদ, বাগানের নাম মার্কো পোলো, দোকানের নাম জুলভার্ন। এরপর শেক্সপিয়ার এন্ড কোম্পানিতে ঢুকতেই চোখে পড়ে জেমস জয়েস নেড়েচেড়ে দেখছেন বইয়ের তাক, ক্লোসারি দে লিলসে গেলেই দেখা যায় রাগী চোখে বিয়ার টেনে যাচ্ছেন হেমিংওয়ে। আরেকটু ভেতরে জার্ডিন দ্যু লুক্সেমবার্গে বাতাস খেতে বসলেই দেখা যায় মঞ্চস্থ হচ্ছে ফকনারের স্যাংচুয়ারির শেষ দৃশ্য, কার্ডিনাল রিশেল্যুর চক্রান্ত ব্যর্থ করতে দারতানিয়ার সাথে যোগ দিয়েছে এথোস, পর্থোস আর আরামিস।
এসব শুধু চামড়ার ওপরের গল্প নয়, কিন্ত ভেতরেও শহরটা কিছু লুকিয়ে রাখেনি। সম্ভাষণ এখানে আবেগে ভরপুর, প্রেম এখানে ফূর্তিতে প্রকাশ্য, বহুজাতিক এখানে দৈনন্দিন। তবে নিয়মের প্রতি এতোটা অনাস্থা কি ভালো? লালবাতিতেও পথচারী দিব্যি নেমে যাচ্ছে রাস্তায়, টিকেট ফাঁকি দিয়ে মেট্রো চাপছে আরবেরা, চার্চের সামনে ঝুলছে পকেটমার হতে সাবধান হবার সতর্কবাণী। উডি এলেনের মিডনাইটে আইফেল টাওয়ারের নিচে ব্ল্যাকে শ্যাম্পেন বেচতে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভারত উপমহাদেশের কেউ, পারীর এই অর্ধেকটা কল্পনা করতে অন্নদাশঙ্কর বোধহয় ভুলে গিয়েছিলেন।
ভুল হতে পারে, তবু মনে হয়- ঝলমলে ল্যুভরের দর্শক আবৃত মোনালিসা আর সীন নদীর পাশে ওয়েডিং ফটোগ্রাফি সেরে নেয়াদের জন্য প্যারিস নয়, যত্রতত্র পশ্চিম ইউরোপের সাথে বেমানান সিগারেটের খোসা নিয়ে পড়ে থাকা প্যারিস হয়ে ওঠেনি ছক দুরস্ত আধুনিক কোনো বিশ্ব নাগরিকেরও। শৃঙ্খলার মাঝেও সে রয়ে গেছে অনিয়মে, যুগে যুগে যার প্রশ্রয় দিয়ে গেছে খেয়ালি শিল্পীরা। প্যারিস তাই অনায়াসে ঠাঁই দিয়েছে দালি, পিকাসো, ফকনার, সতীনাথ ভাদুড়ি, নভেরা’দের। আজও তো দেখি, কুন্ডেরা থেকে শুরু করে মন্টপানেসির রাস্তায় গান গেয়ে যাওয়া মেয়েটির জন্যও এ শহর উন্মুক্ত। আজও ওসব খামখেয়ালির জন্য নটরডেম ক্যাথিড্রালের ঘন্টাবাদক কোয়াসিমোদো প্যারিসের হয়ে ডাক দেয়- ‘অভয়াশ্রয়, অভয়াশ্রয়!’
অংক কষে চলা দুনিয়ায় প্যারিস তাই এখনো এলিসের মতো রয়ে যায় বেহিসাবি কোনো ওয়ান্ডারল্যান্ডে। চলমান ভোজের শহর এখনও, চিরকালের মতোই, খামখেয়ালের অমরাবতী।
Leave a Reply