২০ মার্চ 
The Dumber I behave, the Richer I get.

পেশাব করতে করতে যুগের সহজ সত্যটা এভাবেই আমাদের জানিয়ে দেয় একজন লেখক। আর ‘আমেরিকান ফিকশন’ কৌতুকী স্বরে আমাদের সামনে হাজির করে মার্কিনি সাহিত্য-জগতের হালচাল। কিন্তু হাসতে গিয়েও আটকে যায় গলার কাছে। ভাবি, বাংলাদেশি ফিকশন কি উঠতে পেরেছে ওইসব বর্গীকরণের ঊর্ধ্বে?

সিনেমার নায়ক থেলানিয়াস এলিসন একজন- বাংলা সাহিত্য জগতের ভাষ্যে- মূলধারার লেখক। কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ এই লেখকের পাণ্ডুলিপি বিকোতেই চায় না এয়ারপোর্ট নভেলের যুগে। প্রকাশকদের দাবিঃ তারা খুঁজছে কালোদের ‘সত্যিকার’ স্বর; মাদক আর ভায়োলেন্স ভরপুর যে গল্প হবে ‘নিগা’ আর ‘ব্রো’ ভারাক্রান্ত।

এলিসন তাই, অনেকটা ব্যঙ্গ আর বেশ কিছু রাগ মিশিয়ে ছদ্মনামে লিখে ফেলে একটা দারুণ সস্তা উপন্যাস। কাগজের চেয়েও পাতলা যে সব দ্বিমাত্রিক গ্যাংস্টারদের তুলে আনা হয় টিভির পর্দায়, সেরকম চরিত্র দিয়ে ভরিয়ে তোলা হয় পাণ্ডুলিপি। এবং এইবার, সত্যিকার ‘কালো মানুষের স্বর’ খুঁজে পেয়ে প্রকাশকেরা বিশাল বড় অংকের চুক্তি করতে চায়।

এলিসনকে তখন ছদ্মনামের সাথে দাঁড় করাতে হয় ছদ্ম-পরিচয়ও, সে হয়ে বসে জেল খাটা এক কালো মানুষ। রাগের চোটে সেই বইয়ের নামও পালটে দেয় ‘*দি না!’ শিরোনামে। কিন্তু সাদা মানুষ যেহেতু চিরকাল কালোদের দেখতে চায় নিজের মাপে, ফলে ‘*দি না!’ হয়ে ওঠে বেস্টসেলার, সেই গল্প নিয়ে তৈরি হতে থাকে সিনেমাও।

… দেখতে বসে ভাবি, মন জোগানো ফিকশনের ওই বাঘ কি আমেরিকার সীমানা পেরিয়ে আমাদের ভূখন্ডেও আজ অনেকদিক ঘুরছে না পেটে খিদে নিয়ে?

বাংলার চায়ের আড্ডায়, ইউটিউবের ভিডিও’তে, গুডরিডসের তারা-দাগানো রিভিউতে আমরা কি সেই বইটাই খুঁজি না– যা আমাদের সামনে উপস্থিত করবে খুন হওয়া আবরার অথবা রক্ত ঝরা ফিলিস্তিনকে নিয়ে সেই তরল ভাষ্য, যা আমরা ইতোমধ্যে জানি- তবুও চাই ‘তরতর করে’ পড়তে?

কেন, যে ইতোমধ্যে লেখা হয়েছে বাংলায়; তা-ই নিয়ে স্যুটমারানি হয়ে শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত কক্ষে আমরা সেমিনার করি– যখন সেই লেখা নতুন করে রচিত হয় ইংরেজিতে?

… উত্তর জানা নেই। সৈয়দ শামসুল হকের কলম ধার বলতে চাইঃ “ প্রাণিত হয়ে উঠি, বাংলা উপন্যাসকে আন্তর্জাতিক মানের অন্তর্গত করতে আমারই এ কলমে।”

১৪ মার্চ 
কী চাই, যখন আমরা একটা মার্ডার-মিস্ট্রি পড়তে বসি?

এক কথায় উত্তরটা সহজ। মার্ডার-মিস্ট্রি’তে আমরা চাই কিছু চিরচেনা টোপের উপস্থিতি।

সেখানে থাকবে একটা ক্লোজড সিস্টেম (বদ্ধ ঘর/ জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপ/ সাগরে ভাসতে থাকা জাহাজ/ চলন্ত রেলগাড়ি)। থাকবে কয়েকজন সন্দেহভাজন আর তাদের পারস্পরিক অবিশ্বাস। আরও থাকবে প্রশ্নোত্তর, চলবে অ্যালিবাই খোঁজা।

… মোটাদাগে শুধু মার্ডার-মিস্ট্রি নয়, উত্তরটাকে আসলে সম্প্রসারিত করা যায় জঁরা সাহিত্যের জন্যেও। ‘জঁরা’ শব্দটা যদিও মোটাদাগে তৈরি হয়েছে বইয়ের বিপণন বা বিক্রেতাদের সুবিধার্থে, কিন্তু নির্দিষ্ট একটা জঁরার কাছে পাঠকের প্রত্যাশাও বহুল ব্যবহৃত কিছু টোপের উপস্থিতি। মার্ডার-মিস্ট্রি’র কথা তো বললামই; ওয়েস্টার্নের ক্ষেত্রে ওই টোপগুলো হলো ঘোড়া দাঁপানো কাউবয়, র‍্যাঞ্চ, শক্তিশালী কারো অনাচার।

কিন্তু যদি উল্টোটা ঘটে? একটা কাহিনিতে ঘোড়া আর র‍্যাঞ্চ থাকলেই কি সেটা হয়ে যাবে ওয়েস্টার্ন? কোনো কাহিনিতে যদি একটা খুন আর কয়েকজন সন্দেহভাজন থাকে, তাহলেই কি সেটা হয়ে উঠবে মার্ডার-মিস্ট্রি?

… না, ওইসব উপাদান থাকলেই একটা রচনা মার্ডার-মিস্ট্রি হয়ে উঠবে না।

আর এখানেই বড় লেখকদের কৃতিত্ব। সত্যি বলতে, জঁরা সাহিত্যের চিরচেনা উপাদানদের ব্যবহার করেই বড় লেখকেরা বহুবার সাহিত্যের নতুন সীমানা তৈরি করেছেন। তাদের হাতে পড়ে জঁরা সাহিত্যকে ছুঁয়ে গিয়েও এক-একটা লেখা হয়ে উঠেছে ধ্রুপদী সাহিত্য।

একটু খেয়াল করলেই দেখবো, র‍্যাঞ্চ, কাউবয় আর বুনো পশ্চিমের সমস্ত উপাদান থাকলেও লরা ইঙ্গলস ওয়াইল্ডারের বইগুলো তাই শুধুই ‘ওয়েস্টার্ন’ নয়; সেটা তার চাইতে বেশি কিছু। সর্বকালের সেরা ওয়েস্টার্ন উপন্যাসের কথা ভাবলে ‘গ্রেপস অফ র‍্যাথ’ এর নাম না এসে পারেই না।

সৌভাগ্য, বাংলা ভাষার বড় লেখকেরাও জঁরা উপন্যাসের বুড়ি ছুঁয়ে লিখে গেছেন প্রচুর ধ্রুপদী উপন্যাস। বাংলাভাষার সেরা ফ্যান্টাসি তো উপন্যাস মানিকের ‘পদ্মানদীর মাঝি’। হরর ঘরানায় চট করে মনে পড়ছে হুমায়ূন আহমেদের ‘ভয়’ আর সৈয়দ শামসুল হকের ‘দূরত্ব’এর কথা।

… শুরুর মতো শেষটাও মার্ডার-মিস্ট্রি দিয়েই হোক। কী চাই আমরা সেটার কাছে?

প্রথাগত একটা মার্ডার-মিস্ট্রি পাঠকের সামনে উন্মোচন করে খুনীর পরিচয়; কিন্তু ধ্রুপদী একটা মার্ডার-মিস্ট্রি উপন্যাস পাঠকের সামনে খুলে দেয় সেই সমাজটাকে- যে খুনীর জন্ম দিয়েছে। পড়তে যখন বসি – অন্যের কথা জানি না- আমার তখন প্রত্যাশা থাকে ওই দ্বিতীয় ঘরানার মার্ডার-মিস্ট্রি পড়ার।

‘ব্রাদার কারামাজভ’ কি চমৎকার একটা মার্ডার-মিস্ট্রি নয়? কিংবা পামুকের ‘মাই নেম ইজ রেড’?

বাংলাভাষার সেরা মার্ডার-মিস্ট্রি’টা শহীদুল জহিরের ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিলো’।

১১ মার্চ 
রবার্ট ওপেনহাইমারের উদ্দেশ্যের মহানুভবতা নিয়ে এই আলাপ নয়। সেরা নির্মাতা হিসেবে ক্রিস্টোফার নোলান কতটা যোগ্য আর অভিনেতা হিসেবে কিলিয়ান মার্ফি কতটা দুর্দান্ত- সেই আলাপেও যাচ্ছি না। তাদের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে নড করেই বলি, ‘ওপেনহাইমার’-কে সেরা ছবি করার পেছনের কারণটা অন্য কিছু। পুতুলনাচের সুতোটা নিশ্চিতভাবেই রাজনীতি।

সম্ভাব্য মানবসৃষ্ট সবচেয়ে বড় দুর্যোগ- যার জন্য আজ আশি বছর পরেও কোথাও কখনো গলার স্বর নিচে নামায়নি মার্কিনিরা, সেটার জন্য শ্রেষ্টত্ব যে ওপেনহাইমার’কেই দেয়া হবে; তা যথেষ্ট অনুমানযোগ্য। (লিখতে লিখতেই মনে পড়লো মানবসৃষ্ট আরেক মহাদুর্যোগ, চেরনোবিল-এর কথা। মনে মনে ভাবি, চেরনোবিল-কাণ্ড যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন সৃষ্ট না হতো; তা নিয়ে নির্মিত টিভি-সিরিজটা কি অতটা সুলিখিত, অতটা দুর্দান্ত হয়ে উঠতো আদৌ?)

দ্বিতীয় কারো গল্পকে মানুষের কাছে নিয়ে আসা শিল্পের মাত্র একটা দিক কেবল; শিল্পের অন্য দিকটা হলো, নিজের গল্পকেই অন্যের মুখে বসিয়ে দেওয়া। ঠিক যেমন “হার্ট লকার” সিনেমাও অস্কারে সেরা হয়ে ওঠে ইরাক যুদ্ধে অংশ নেওয়া আমেরিকান সৈন্যের মানসিক যাতনা দেখিয়ে। তারও বহু আগে থেকেই প্রোপাগান্ডার ঠুকঠাক আর হলিউডি সিনেমার কয়েক ঘা’ দিয়ে দিনের পর দিন অ্যাপাচি ইন্ডিয়ানদের প্রচার করা হয়েছে যুদ্ধপ্রিয় হিসেবে; রাশান কি সার্বিয়ানদের দুনিয়াজোড়া প্রচার করা হয়েছে অপরাধপ্রবণ- মাথা গরম ভাবমূর্তির।

ইরাক আফগানিস্তান যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে ইঙ্গ-মার্কিন প্রশাসনের কর্তারা কেমন আত্মগ্লানির ভেতর দিয়ে গেছেন, সিনেমা আর সিরিজে তা বহুবার দেখে ফেলেছে দর্শকেরা। ‘যুদ্ধ করতে অনিচ্ছুক’ সৈনিকদের মনোবেদনার কথা তো বললামই। কিউবা, রাশিয়া শেষে আর বাদ থাকে কী, ভিয়েতনাম? … খেয়াল করলে দেখা যাবে, ‘ইয়ং শেলডন’ টিভি সিরিজে ইতোমধ্যে হাজির করা হয়েছে এক ভিয়েতনামি চরিত্রকে, যার কাজ একটু পর পর তার দেশের স্বৈরতন্ত্রের বদনাম করা।

…উপায় যেহেতু নেই, আপাতত তাই এই রাজনীতিকে অগ্রাহ্য করেই অভিনন্দন জানাতে চাই ‘ওপেনহাইমার’কে। শ্রেষ্ঠত্বের বিচার উপেক্ষা করতে পারলে সিনেমাটা তো সত্যিই বেশ ভালো। বাংলার আরেফিন শুভ অভিনিত ইউনিভার্সে যা হয়েছে-যা হচ্ছে, তার চাইতে বায়োপিক হিসেবে ‘ওপেনহাইমার’ হাজারগুণে এগিয়ে।

০৫ মার্চ 
 “কবিরা মুগ্ধ হয় বিদ্যমান পৃথিবীর সৌন্দর্য্যে, আর কথাসাহিত্যিক চায় নতুন একটা পৃথিবীর নির্মাণ।”

অক্টাভিও পাজ’এর – না কি অন্য কেউ? স্মৃতিতে আসে না – এই কথাটা মনে আসে ঘুরেফিরে, প্রায় সবসময়ই একমত না হয়ে পারি না। শুধু অল্প কিছু কথাসাহিত্যিকের ক্ষেত্রে, বাস্তবতার প্রতি তাদের গ্রানাইট নির্মিত আনুগত্য দেখে মনে হয়ঃ নাহ, এরা বোধহয় নতুন পৃথিবী চায় না, এরা চেনা পৃথিবীকেই ধরতে চায় অবিকল। সতীনাথ ভাদুড়ী এই ঘরানার লেখক।

বইমেলার সদ্য কেনা বইগুলোর মাঝে উপন্যাস আছে কয়েকটা, কিন্তু প্রায় সবগুলোই দৈর্ঘ্যে খাটো। অথচ পড়ততে ইচ্ছে করছিলো দীর্ঘ কিছু, তাই ভাদুড়ীজীর কাছেই ফিরলাম। “অচিন রাগিনী”।

বাংলা ভাষার ভিন্ন-ঘরানার প্রেমের উপন্যাসের তালিকা যদি করতে বসি কখনো, অচিন রাগিনীকে সেখানে প্রতিবার রাখবো। কাহিনির প্লট হিসেবে নতুন দিদিমা’র সাথে দুই কিশোরের ওই ‘টান-ভালোবাসার’ গল্প রীতিমতো বিস্ময়কর।

কিন্তু আরও বিস্ময়কর সতীনাথ ভাদুড়ীর নিস্পৃহতা। চিরচেনা পৃথিবীর প্রতি এমন বিশ্বস্ত থেকে কোনো লেখক কীভাবে পারেন এমন নিস্পৃহ থাকতে? যতবারই তাকে পড়ি, আলতো করে বই বন্ধ করে সাদা দেয়ালের দিকে চেয়ে থাকি শ্রদ্ধায়। এবং ভালোবাসায়।

০৩ ফেব্রুয়ারি
গোটা বইমেলা বাতি জ্বেলে সতর্ক, তার মাঝে অভ্যাগতরা পায়ে পায়ে প্রস্রাবের জায়গা খুঁজে মরে। মেট্রোরেল থাকলেও এ বইমেলায় শৌচাগার নেই। খাবারের দোকানও দেখলাম দুয়েকটা, আর দেখলাম কয়েকডজন লাইভ কিংবা সাক্ষাৎকার। শেষ দলটির ভিড় বাড়িয়ে নিজেও চক্কর দিতে শুরু করলাম এবার।

ইতিহাসের গলিঘুঁপচি ছেড়ে আনিসুল হকের মা রিটার্নস, মহিউদ্দীন আহমেদকে মনে হচ্ছে ইনস্টাগ্রামীণ যুবতীদের চাইতেও বহুপ্রজ। সেবাকে খুঁজে পেলাম যথারীতি এক প্রান্তে, অন্যপ্রকাশ দেখলাম তাদের প্যাভিলিয়নে চিরস্থায়ী চিলেকোঠার সেপাই হয়ে থাকা হুমায়ূন আহমেদকে বিদায় করে দিয়েছে। মুক্তমঞ্চটার দেয়ালে খোদিত বিবিধ উত্তরাধুনিক কবিতাদের দিকে পিঠ ফিরিয়ে চাইলে অবশ্য ইউপিএল’এর স্টলটাকে বেশ সুদৃশ্য লাগে।

গতবার চন্দ্রবিন্দু’র স্টলের সামনে বেঞ্চ সহ কুঁড়েঘর পেতেছিলো আকাশ প্রকাশনী। এবার তাদের পার ক্যাপিটা ইনকাম বেড়েছে, কুঁড়েঘর ছেড়ে তারা দেখলাম বারান্দাযুক্ত বাংলোয় উঠে গেছে। কিন্তু ইনফ্লুয়েন্সারদের পার ক্যাপিটা ইনকাম বোধহয় অত সুবিধার নয়, উদয়াস্ত পরিশ্রম করে তাদের এবারও লিখতে হচ্ছে নানা বিষয়ে। এইসব চোখে নিয়ে সহজে ইংরেজি শেখার কায়দাকে পাশ কাটিয়ে যাই, বিশেষ করি জোরে হাঁটি সেইসব এলাকায়, যেখানে উত্তরাধুনিক চিন্তকেরা বিড়ির টানে তালাল আসাদের- বই নয়- কেতাবের যাবতীয় গুণ ব্যাখ্যা করছেন।

হাসনাত শোয়েব দেখলাম বইয়ের উৎসর্গে রেখেছে এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানোকে। কোথায় যেন দেখলাম এক লেখক বই উৎসর্গ করেছেন মূল্যস্ফীতিকে। মহাজাগতিক এইসব কেরদানি দেখে বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে ভাবি, এখন কোনো বই লিখে উঠতে পারলে সেটা কাকে উৎসর্গ করা যায়- নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে বিরাট কোহলিকে বোল্ড করা প্যাট কামিন্সকে?

… অথচ অমন কিছু করা যাবে না। মেট্রোরেল সয়ে গেছে, বইমেলা সরে গেলে সেটাও সয়ে যাবে। শীত কমে যাবে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছে কোকিল ডাকবে ‘কোকেইন! কোকেইন!’ বলে। ইট দিয়ে বানানো সাময়িক শৌচাগারে একই সমতলে বিসর্জন করবে একজোড়া গলাবাজ গল্পকার, তিনটি আধাশিক্ষিত কবি ও চারটি দ্বান্দ্বিক প্রবন্ধকার। বাতাস কাটা রিকশায় ফিরতে ফিরতে- পাশে বসা ঈশিতা কী ভাববে জানি না- আমি শুধু ভাববোঃ সেন্ট্রাল পার্কের ছোট্ট হ্রদটার হাঁসগুলো কোথায় সাঁতার কাটে, হোল্ডেন কলফিল্ড কি এই শীতে সেটার উত্তর পেয়েছে?

১০ জানুয়ারি
শীতের রোদে রিকশাযাত্রা করি, মাথার ভেতর আশা নয়- স্বপ্ন নয়, কোনো এক ছায়াশহর খেলা করে।

মিরপুর রোড ধরে রিকশা এগিয়ে যায় ঢিলগতিতে, ঝরঝরে বাসের শেষ জানালা দিয়ে গলা বাড়ানো কোনো হিজাবী কিশোরী হয়ে ওঠে টাইমস ম্যাগাজিনের পুরোনো প্রচ্ছদ। শাহবাগ থেকে নির্মাণাধীন মেট্রো স্টেশনের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ কাঁপি, মনে হয়- এবনেজার ক্রুজের ক্রিসমাসের বুড়ো ভূত এখনও আমার পিছু ছাড়েনি। আরেকটু এগিয়ে গেলেই বর্ধমান হাউজ। স্ট্যাম্প সাইজের বইমেলা দেখতে গিয়ে টের পাই, পেছনের দরজা দিয়ে আগরতলা মামলার বিচারপতি এস এ রহমান পালিয়ে যাচ্ছেন জনতার ধাওয়া খেয়ে, বাঙালি বাবুর্চির লুঙ্গি ধার নিয়ে তিনি এবার সোজা ভেগে যাবেন এয়ারপোর্টে।

বছরের এই সময় পত্রিকার পাতায় অবধারিতভাবে থাকে কম্বল পাওয়া শীতার্ত মানুষের হাসিমুখ, এবং নতুন বছরের পাঠ্যবই তৈরিতে বাজে কাগজ ব্যবহারের প্রাচীন অভিযোগ। সেটাকে পাশ কাটিয়ে ঢাকার রাস্তায় সন্ধ্যায় বের হলাম তো রকমারি শীতপোশাক শোভিত রাজকন্যাদের চেয়েও চোখ কাড়ে দূরের রেস্তোরাঁগুলোর ফিল্টার করা আলো, কুয়াশাকে ভেদ করে তারা বাতিঘরের মতো মায়া দোলায়। নিকেতন থেকে মোটরবাইকে চাপলাম তো প্রবল বাতাসে চোখে হঠাৎ পানি, দিনেরাতে সার্ভাইল্যান্স চালানো এই শহর কি জানে না আমার সমস্ত কিছু?

পুরোনো হয়ে গেছে রেলওয়ে ম্যান আর রাজু ভাস্কর্যের ক্যাচাল। গাজা-হামাসকে পাশ কাটিয়ে টিভির পর্দায় এখন অবাধ ও সুষ্ঠ রিয়েলিটি শো। ‘ইন্টার ফেল’ দেখে রুমালে চোখ মুছতে মুছতে লোকে ক্ষণিকের জন্য ডার্ক নাইট ভেবে বসে যমুনা টিভিকে।

লেগস্পিনারের চেয়ে অধিক মন ঘোরানো রশিদ খান আর সম্রাটের চাইতেও বেশি কাইজার হয়ে থাকা বেকেনবাওয়ারের জন্য অল্পস্বল্প নাগরিক মেলানকোলি লালন করতে করতে ভাবি, শৈশবে এ ঋতুর নাম কী ছিলো? নির্বাচন, না হোম অ্যালোন?