০৯ মার্চ
ইউরোপের অধিকাংশ দেশের জনসংখ্যার চেয়ে, কিংবা পৃথিবীর অধিকাংশ ধর্মের চেয়েও বেশি অনুসারীযুক্ত বাঙালি সেলেব্রিটিদের অনলাইন মুদি দোকান দেখতে দেখতে ফেসবুকে স্ক্রল করে নিচে নামি। মানুষ হিসেবেও।
বনবিবি আছে, কাচ্চি আছে, কনসার্ট আছে; ভালোমতো তাকালে এখনও শাহীনকে কার যেন পুলার পেছনে লেগে থাকতে দেখা যায়। মুড়ির টিন, অঞ্জন দত্ত আর অপ্রীতিকর বইমেলার আয়ূ আগেই শেষ; গুলশানের ফায়ার ফাইটারের মতো একটু মাথা তুলেই তারা বিদায় নিয়েছে।
মাথা উঁচু করার চেষ্টা করেছিলো কুষ্টিয়ার ফুলপরীও, কিন্তু প্রগতির পেটোয়াবাহিনির সামনে তার মিন মিন স্বর ঢেকে গেছে মার্চ মাসের কলার টিউনের শব্দে। ওদিকে জলের ওপর চক্রাকারে ঘুরতে থাকা বক, তাকে দেখে আমার জাগে ইমতিয়াজ মাহমুদের কবিতা পড়ার শখ।
ইমতিয়াজ থেকে চোখ সরালে এদিকে কী আছে? ‘ক্যালকাটা ক্রমোজম’ আর ‘জবরখাকি’। অমিতাভ ঘোষকে আজও ভালো না লাগলেও বর্ণালিকে আজও ভালো লাগে। আর তার চেয়েও ভালো লাগে রাস্তায় হাঁটা, পৃথিবী তাদের কাছেই নিজেকে উন্মুক্ত করে – যারা নাকি একা একা হাঁটে।
পাতা ঝরে ন্যাংটো হয়ে যাওয়া একজোড়া এস্থেটিক গাছকে সামনে রেখে বিশ্বাস ক্রেডেন্সের নিচতলায় ঝলকায় ক্যাফে সিক্সটি এইট। রোদের মাঝে ডেস্টিনি-মার্কা টাই বেচে আফ্রিকানদের মতো দেখতে এক তরুণ। বিদ্যুতের খুঁটি ঘিরে নাচে তিন না হলে চার বছর বয়েসি এক নেইমার জুনিয়র। নামে নেইমার হলেও রাস্তার নটির পুলাটি প্রায় কাকার মতো দেখতে, আবেগে থরথর বিভূতিভূষণ একে দেবশিশু ছাড়া অন্য কোনো নামে ডাকতেন না। বছর পাঁচেক পরে খিদের কষ্ট কাটাতে এই পিচ্চিই ডান্ডি খেয়ে শুয়ে থাকবে কোনো ফ্লাইওভারের নিচে, সেই কষ্টকল্পনায় এখন খারাপ লাগে। সামনে এগোলে খারাপ লাগে আরো বাড়ে। মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে বৃদ্ধা যাত্রীর কাছে বেশি ভাড়া চেয়ে বুকের কাছে হাত নিয়ে কাঁদে আরও বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা।
… অথচ আমি লিখতে চেয়েছিলাম এমন কিছু, যা হয়ে উঠবে বাংলা ভাষার বাগধারা।
২৬ ফেব্রুয়ারি
টিএসসি’র মোড়ে ‘বরকতেরই আপন দেশে, হিন্দী-উর্দু সর্বনেশে’ লেখা ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে কে? দেলোয়ার জাহান ঝন্টু! দেলোয়ার জাহান ঝন্টু! দেলোয়ার জাহান ঝন্টু!! হিন্দী ছবি আমদানির বিরুদ্ধে আহুত মানববন্ধনে তার দলবল এমন গলা কাঁপায়, সঞ্জয় লীলা বানসালি থেকে খোদাবক্স মৃধার কাতারে তাদের দিব্যি নামিয়ে দেয়া চলে।
ভেতরে ঢোকার আগে একটু ওভালটিন চা খাবার সাধ জাগে। কিন্তু নানা রঙের ব্যানার উপর থেকে যেভাবে ঝোলানো, তাকে করে জায়গাটাকে টিএসসি কম হগওয়ার্টস বেশি বলে বোধ হয়। বসন্ত বাতাসে দোল খাচ্ছে নানা ক্লাবের বিবিধ কর্মসূচী। রঙিন এসব ব্যানারদের মাঝে বিশেষ করে দৃষ্টি কাড়ে ফুল ছড়ানোর আনন্দে হাস্যময় কামরুন্নাহার মুন্নী। উদীয়মান এই কবির গ্রন্থের নামঃ প্রেম ভালোবাসা একটি ঐচ্ছিক কাজ।
প্রেমের এই দুর্দান্ত হাইপোথিসিস আবিষ্কার করা মানবীর সামনে নতমুখে ওভালটিন চা খাওয়া শেষে চুপিসারে ঢুকি পড়ি মেলায়। খেলা হবে!
তা খেলার বদলে আড্ডাটাই অবশ্য বেশি হয়। আফসার ব্রাদার্সের সামনে জাহিদ হোসেন, সালমান হক, ওয়াসি রাফির সাথে শহীদুল জহিরের পানাভ্যাস শীর্ষক একটি নতিদীর্ঘ আলাপ দিয়ে শুরু। এরপর বাতিঘরের স্টলে বসে আলভী আহমেদের সাথে ওয়েবসাইট বিষয়ক আলাপ, মাঝে চন্দ্রিল ভট্টাচার্য ক্যামিও দিয়ে গেলেন ক্ষণিকের জন্য। এরপর নজরুল ভাইকে সাথে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ‘চন্দ্রবিন্দু’র স্টল।
বর্ণমালায় সবার নিচে বলেই বোধহয়, চন্দ্রবিন্দুর ঠিক সামনেই বিস্তৃত ‘আকাশ’। কুঁড়েঘর আকৃতির এই স্টলের সামনে মেলায় আগত সুন্দরীরা এসে ছবি তোলার গুরু দায়িত্বটি সেরে নিচ্ছে। ধূলো অগ্রাহ্য করে দারুণ উদাসী ভঙ্গিমায় এক-একটি প্রোফাইল পিকচার অর্জন করা এই জনতাকে পেছনে ফেলে লিটল ম্যাগ কর্নারের দিকে সরে গেলেই সিগারেটের আড্ডা হতে পারে কামাল ভাই, আলতাফ ভাই, নোমান ভাই, হামিমদের সাথে। অধূমপায়ী ভদ্রলোকদের দলে আমার সাথে আছেন হাসনাত শোয়েব দম্পত্তি, জুয়েল ভাই এবং ছিট কাপড়ের ব্যবসায়ী এনামুল রেজা।
ফেরার পথে রাসেল রায়হানের সাথে তো গান্ধীকেও হারিয়ে দেওয়া দীর্ঘ পদযাত্রা। কখনো-সখনো তার মাঝে অভিজিৎ রায়কে অবশ্য মনে পড়ে। কিন্তু সায়েন্স ল্যাবের মোড় আর মিরপুর রোডে এই রাতেও এমন ভিড়, তার মাঝে লোকটা আলাদা করে ঠিক ফুটতে পারে না।
‘নিদ্রায় আসক্ত হতে চেয়ে তবু বেদনায় জেগে ওঠে পরাস্ত নাবিক…’
০৮ ফেব্রুয়ারি
স্পটলাইটের নিচে বকবকানো সালমান রুশদীর কানের কাছে ঝিকমিক করে ওঠে ছুরি। ম্যান ফ্রম নিউ জার্সি চিৎকার করে জিজ্ঞেস করেঃ ‘What do you say to the God of Death?’
‘Not today!’ বলে একচোখো সাইক্লপস হয়ে ওঠেন রুশদী, সেই ১৯৮৯’এর ভ্যালেন্টাইন ডে থেকে যিনি জোসেফ আন্তন। পাশ থেকে সুবিমলমিশ্র ফিসফিস করে বলেনঃ ‘চিল্লাবে না, গণতন্ত্রে অমন দুয়েকটা কেস হয়েই থাকে। চিল্লালে পাশের দেশ শুনতে পাবে।’
তা এসবের আগে অবশ্য সাহিত্যক্ষেত্রে সকলকেই হার মানিয়েছে বাংলার একাডেমি, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়ে গেছে বলে মধ্যবিত্তের মতো তারাও ছেঁটে ফেলেছে আদর্শ। আদর্শ ফেরে, কিংবা ফেরে না; আর মধ্যমেধার কেউ হয়ে ওঠে- বাংলা না জেনেও- বেস্টসেলার। মুজতবা আলী হলে ‘মধ্যমেধা’ শব্দটার পাশে বন্ধনীতে বসিয়ে দিতেনঃ উভয়ার্থেই!
ভেবে দেখলে, মেলা প্রান্তরে উদাস হাসি মারা বেস্টসেলার লেখকের ভিড় প্রায় আর্ট সামিটের মতোই। পাঠক ছবি তুলবে কী, একজন ক্রেতা পেলেও লেখক নিজেই তাকে জাপটে ধরে সেলফি তোলে।
সেখান থেকে সরে তুরস্কে গেলে সবকিছু ভেঙে পড়ে, ভারতে গেলে আদানি গ্রুপের বিপর্যয়। এদিকে নজর রাখলে কোথাকার কোন আলম হয়ে ওঠে ফারহাদির সিনেমার ‘হিরো’।
সত্যি বলতে, এই একটি দিকে ২০২২ এর জুড়ি মেলা ভার। ‘টার’ বলতে পারো, ‘ট্রায়াঙ্গল অফ স্যাডনেস’ বলতে পারো, ‘বার্ডো’ কি ‘ফেবলম্যান’কে পাশ কাটিয়ে ‘জয়ল্যান্ড’ আর ‘হাওয়া’ পর্যন্ত উল্লেখ করা যায়। আর এবিং- মিসৌরির পাশে ঝুলিয়ে দেওয়া বিলবোর্ড তিনটির দিকে মুগ্ধচোখে দাঁড়িয়ে থাকার পর আইশেরিন নিয়ে মাতামাতিকে একটু বেশিই লাগে। ম্যাকডোনা লোকটা সেই ‘ইন ব্রুজেস’ থেকেই তার চরিত্রদের আত্মহত্যার প্ররোচনা দিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে একরকম আত্মহত্যাই করে মরফিয়াস। তবু তার জগতটাকে এতো আকর্ষণীয় লাগে যে মিশিমাকে পাশ কাটিয়ে, মুরাকামির মুক্তগদ্যকে এড়িয়ে, ইউপিএল-এর ভারি প্রবন্ধদের কনুই মেরে পড়ার টেবিলে থাকে কেবল নেইল গেইম্যান। আর একটু একটু থ্রিলার লেখার কাটাকুটি খাতা।
ফেব্রুয়ারির দারুণ ঝলকে লেখকের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায় বিগ ব্রাদার, নইলে ছুরি হাতের হাদি মাতার। জানতে চায়ঃ ‘What do you say to the God of Death?’
রুশদীকে পাশ কাটিয়ে সবচেয়ে জোরে শোনা যায় সুবিমলমিশ্রের গলাঃ ‘I do not want to be a Writer. I want to be the meaning of it.’
০৫ ফেব্রুয়ারি
আর্ট সামিটে ঢুকতেই বেশ একটা ধাক্কা লাগে। বোধ হয় যে হঠাৎ ‘ওয়াকান্ডা ফরএভার’ স্লোগান সমৃদ্ধ কোনো ইউটোপিয়ায় চলে এলাম। চোখের এই কড়কড়ানি কি পোশাকের জন্য?
হতে পারে। কারণ ছেলে থেকে মেয়ে হয়ে মহিলা- সকলেই এখানে বড় মনোহর এবং ইনস্টাগ্রাম্য। নকশা কি সানন্দার পাতা থেকে উঠে আসা নীল জামদানি থেকে উত্তরাধুনিক হাঁটু ছেঁড়া জিন্স, সবই এই কসমোপলিটান ঘাটে জল খাচ্ছে। কখনো জ্যাকেটের একপাশ কেটে রেখে কেউ খুব বাতাস লাগায়, কোথাও আধেক খোলা পিঠের মাঝে ঘোড়ার ট্যাটু ঝলকায়। বিশেষ করে চোখ যায় রাজকন্যাদের দিকে। কোনো সুদৃশ্য ভাস্কর্য, না হলে রঙিন দেয়াল অথবা বিমূর্ত চক্রা-বক্রা কাঠের টুকরোর পাশে দাঁড়িয়ে এরা ব্যক্তিগত ফটোগ্রাফারের লাল সুতা-নীল সুতা বের করে ফেলে।
ফটোগ্রাফারেরা প্রজাতিতে প্রধানত পুরুষ। তবে এখন তারা কখনো ওয়েস এন্ডারসনের ক্যারিকেচার হয়ে ডানে কি বামে ঝোঁকে, কখনো আবার সুন্দরবনের ঘড়িয়াল হয়ে হামাগুঁড়ি দেয়। আর তাদের সামনে মেয়েরা? কখনো হালের ফ্যাশন গোল চশমাকে নাচিয়ে, কিংবা নাকের লোকজ নথে কাঁপুনি সৃষ্টি করে, কিংবা পরনের জনি-প্রিন্ট শাড়ির আঁচলটি পূর্বাচল পর্যন্ত বিস্তৃত করে এরা কত যে আনমনা হয়! জয়া আহসান না হলেও পূর্ণিমার নিচে নামানো এদের মুশকিল।
কিন্তু এসব জাজ করা এ যুগে বিপজ্জনক। কখন কে খারিজ করে দেবে- কে জানে! সেই ভয়ে আমি আর অনীম ভাই মুগ্ধ হয়ে সাজানো জিনিসপাতি দেখার ভান করি। সেই কিছু ত্যাঁড়া-ব্যাঁকা মূর্তি, কয়েকটা মঙ্গোলীয় চেহারার ছবি, আর খড় নইলে মাটি নইলে কাঠ দিয়ে বানানো ফকিরা কিছু ভাস্কর্য, বিশাল ক্যানভাসে ইচ্ছে মতো রঙ নষ্ট করে মনের জটিল ভাব ব্যক্ত করার অপচেষ্টা। সাদা কিংবা হলদে আলো ফেলে অযথাই এদের শিল্পময় করার চেষ্টা করা হয়েছে। সব কিছুর মাঝে পড়ে- অনীম ভাইয়েরটা জানি না- আমার ফাতরা এবং মধ্যবিত্ত মনটা ইতস্তত করে।
০২ ফেব্রুয়ারি
মাঝে মাঝে এমন হয়, পুরোনো কোনো ভালো উপন্যাসের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। উপন্যাসটা আখ্যানধর্মী হলে চলবে না, সেটা হতে হবে বুদ্ধিবৃত্তিক কিছু। পড়তে ইচ্ছে করে এমন কিছু, শব্দেরা যেখানে একেবারে হেলাফেলায় ব্যবহৃত হবে না, গদ্য মসৃণ হলেও শব্দেরা যেখানে চিন্তা উসকে দেবে, কিংবা আমার হাইপার-অ্যাকটিভ ঢাকানিবাসী মনটাকে আবেগমথিত করবে। সবচেয়ে বড় কথা, ওল্ড ম্যান’স সাধু ভাষা কি পুরোনো দিনের মানুষ নয়, পড়তে ইচ্ছে করে একেবারে নাগরিক মনের কাউকে।
এমন উপন্যাসের কি খুব অভাব? তা নয় হয়তো। কিন্তু ইচ্ছে করে- অন্য কোনো ভাষা নয়- খাঁটি বাংলা ভাষায় অমন কিছু পড়ি – কেবল বাংলা শব্দের সংস্পর্শে দীর্ঘক্ষণ বুঁদ হয়ে থাকার জন্য।
এমন শর্ত মিলিয়ে পড়ার জন্য বই বেশি পাওয়া যায় না। হুমায়ূন আহমেদের একেবারে প্রথম দিকের উপন্যাসগুলো আছে, আছেন রশীদ করিম, হাসনাত আবদুল হাই। এদের আলতো করে ছুঁয়ে গিয়ে তাই বেছে নেই সৈয়দ হককে।
‘… যত নিকট হোক দু’টি মানুষ, এমনকি তারা বিনিময় করুক তাদের রক্ত, তবু তারা বুঝতে পারবে না একজন আরেকজনকে সম্পূর্ণভাবে। যে সেতু আমরা কল্পনা করে থাকি তা সেতুর বিভ্রম মাত্র। নইলে মুখে না বললে, ভাবনাকে ভাষায় না ব্যক্ত করলে কেন অচল হয়ে যায় জগৎ?’
এসব অতি পুরাতন কথাও এমন গানের মতো করে বাংলা গদ্যে বলতে পারেন আর কজন?
২০ জানুয়ারি
অনেক মানুষ, তাদের অনেক চেহারা।
আল নূর চক্ষু হাসপাতালের সামনে দুই চোখ আর নাকের নিচে তেরচা করে ঘোমটা টেনে পিঠা বিক্রি করে এক চাচী। একশ টাকায় দৈনিক আসা-যাওয়া তার, এই দাবির মাধ্যমে রিকশাচালকের সাথে দরদাম করে একটু উঁচু দাঁত নিয়েও হাসতে থাকা এক মোটাসোটা আপা। বাবার হাত ধরে থাকা এক পিচ্চি বেণী দুলিয়ে পেছনে তাকিয়ে ফুটওভার ব্রিজে ওঠার শৈশবের আনন্দে চ্যাঁচায়- ‘মা! আসো! বিরিজ দিয়ে যাবো!’
মোড় ঘুরিয়ে হাঁটা ধরলে এমনকি মিরপুর সড়ক আজ অচেনা। জট দূরের কথা, পর্যাপ্ত গাড়ি পর্যন্ত দেখা যায় না। ধু-ধু রাস্তায় সত্য হয়ে রয় কেবল হালকা কুয়াশা, আর অনেকদিন পর ছুটে যাওয়া একটা করে বাস, প্রাইভেট কার, না হলে রিকশা। বিস্ময়কে চূড়ান্ত করে ক্লপাটি-ক্লপাটি-ক্লপ শব্দে রাস্তা দিয়ে ছুটে যায় এক জোড়া সাদা ঘোড়ায় টানা গাড়ি। ঘোড়া দুটো ম্যালনিউট্রিশন ভারাক্রান্ত না হলে এই রাস্তাকে ধরে নিতাম ভ্লাতাভা নদীর ধারের প্রাগ শহরের মালা স্ত্রানা। তবু সন্দেহ হয়, ইবিএল ব্যাংকের হলদে আলোর চোখ টিপ মারা সাইনবোর্ড-সম্বলিত এই মেট্রোপলিস কি আমার?
পিয়্যান ফোন করেছিলো আসবে বলে। শালা আজ না আসুক। ইস্তানবুলের ওরহান পামুক থেকে শুরু করে মিডনাইট ইন প্যারিসের আদ্রিয়ানা- আজকের এই একাকী পথচলার খাতিরে আমি সবাইকে অগ্রাহ্য করতে পারি। একটা গান হলে এই রাতটা হতো সাহানা বাজপেয়ীর গাওয়া, একটা গল্প হলে এই রাতটা হতো রবীন্দ্রনাথের লেখা; ‘… সুরবালা আজ তোমার কেহই নয়, কিন্তু সুরবালা তোমার কী না হইতে পারিতো …’
সামনে এগোলে রাস্তার অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়। মহুয়া চটপটির জমজমাট ব্যবসার পাশেই শীতের রাতের রেলস্টেশনকে মনে করিয়ে মাফলার টেনে ঘুমায় এক ডাবওয়ালা। চোখে-মুখে দুষ্টুমি নিয়ে কমলা রঙের টেনিস বল ওপরে ছোঁড়ে এক পিচ্চি, ক্যাচ ধরার মুহুর্তে তার ডান চোখ কুঁচকে যায়। থেমে থাকা বাসের জানালা দিয়ে কুলির মতো বমি করে এক তরুণ। সেখান থেকে দৃষ্টি ফেরালে চোখ ঝলসে যায় সেই মেয়েটিকে দেখে, যার থেকে বিচ্ছুরিত হয় গোলাপি আলো।
‘যা কিছু তিনি বর্ণনা করেছেন, মূহুর্তের জন্য যেটা তার হয়েছে, সবটাই তিনি দখল করে নিয়েছেন চিরকালের জন্য।’- আর্নেস্ট হেমিংওয়েকে নিয়ে লিখেছিলেন গার্সিয়া মার্কেজ।
সেইন্ট মাইকেলের সেই ক্যাফেতে যে মেয়েটি ঢুকেছিলো -হেমিংওয়ের বর্ণনায় – কাকের ডানার মতো আড়াআড়ি করে কাটা চুল নিয়ে, একশো বছর পরে আজ তাকে খুঁজতে খুঁজতে আমি ঢাকার রাস্তায় হাঁটি।
১১ জানুয়ারি
নতুন কোনো শব্দ শেখার পর সেটা সবখানে দেখতে পাওয়ার মতো করে, নতুন একটা কিছু নিয়ে আগ্রহ তৈরি হলে সেই জিনিসটা – অনলাইনের আড়িপাতা বাদ দিয়েই- অন্য কোথাও আবিষ্কার করা যায় কাকতালীয় ভাবে। সম্প্রতি তেমনটা হলো দুই সুরকার এবং অপেরা কন্ডাকটরকে নিয়ে। প্রথম জনের নাম লিডিয়া টার, দ্বিতীয়জন দিমিত্রি শোস্তাকোভিচ। প্রথমজনের কাহিনি দেখলাম, দ্বিতীয়জনেরটা পড়লাম।
২০২২ এর সেরা সিনেমার দৌড়ে প্রায় সবখানেই উঠে এসেছে ‘টার’-এর নাম। দুর্দান্ত, অবিশেষণসম্ভব এই সিনেমা দেখে বুঝি উঠি নাঃ পরিচালক টড ফিল্ড, না নাম ভূমিকায় অভিনয় করা কেট ব্ল্যানশেট- কার জন্য বড় হাততালিটা থাকবে। শুরুতে আঁতলামি-ভরা ওই চিত্রনাট্যের শেষে এমন নাগরদোলা রোমাঞ্চ, কিছুতেই সেটা আন্দাজ করা যায়নি।
এই সিনেমায় লিডিয়া টার এক দুনিয়াখ্যাত অপেরা কন্ডাকটার। মানুষী সাফল্যের সম্ভাব্য সকল কিছু পেয়েও তার জীবন অশান্ত। ঘরে সঙ্গিনী রেখেও লিডিয়া ছোঁক-ছোঁক করে বেড়ায় তার কাছে আসা শিক্ষানবিস বাদিকাদের সাথে। আর যেহেতু সে মায়েস্ত্রো, তার অঙ্গুলি হেলনে যেহেতু শেষ হয়ে যেতে পারে মিডিওকার বহু শিল্পীর, সেহেতু কখনো ক্রিস্টা- কখনো ওলগারা সঙ্গী হয় লিডিয়া টারের।
শিল্পীর জীবন শিল্পের অংশ নয়- এই আপ্তবাক্য নিজের ক্লাসেও জোর দিয়ে পড়ায় টার, এ যুগের ক্যান্সেল-কালচার নামক খারিজী সংস্কৃতিকে সে ধুয়ে দেয়। অথচ, ভাগ্যের মোচড়ে টারের নিজের জীবনই ক্রমশ হয়ে ওঠে বাইরের মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। টার আবিষ্কার করে, শিল্প নয়, শিল্পীকেই বিচার করছে মানুষ।
লিডিয়া টারের এই নাটকীয় গল্পের রেশ কাটতে না কাটতেই দেখা হয়ে যায় আরেক কন্ডাকটার শোস্তাকোভিচের সাথে, জুলিয়ান বার্নেসের উপন্যাস ‘আ নয়েস অফ টাইম’-এর পাতায়।
সোভিয়েত রাশিয়ার প্রবাদপ্রতিম সুরকার দিমিত্রি শোস্তাকোভিচের জীবনী-নির্ভর উপন্যাস ওই ‘আ নয়েস অফ টাইম’, তিনটি দীর্ঘ অধ্যায়ে লোকটার জীবনের তিনটা পর্যায় তুলে এনেছেন বার্নেস। দারুণ রকম জাদুকরি গদ্য বার্নেসের। ছোট ছোট অনুচ্ছেদে লোকটা অনেক ভারি কথা বলে যায় অনায়াসে।
আবিষ্কার করা যায়, শোস্তাকোভিচের জীবনের মূল সংকট কখনোই ছিলো না সুর সৃষ্টির- যেমনটা ছিলো না লিডিয়া টারেরও। শোস্তাকোভিচকে বরং তাড়িয়ে বেড়ায় ক্ষমতার সাথে সমঝে চলার ভয়, ব্ল্যাকলিস্টে নাম উঠে যাবার ভয়, পশ্চিমা-দালালের তকমা পেয়ে যাবার ভয়।
নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে বড় বড় কথা বলা পিকাসো কি সাঁত্রের সাথে একমত হতে পারে না শোস্তাকোভিচ। সে জানে, এই একনায়কের রাশিয়ায় সবচেয়ে বড় সত্যি হলো টিকে থাকা। স্তালিনের প্রতিবাদ করে শাস্তি পাবার চাইতে সাহস তার নাই, এমনকি সামর্থ্য পর্যন্ত তার চশমা-পরা টিংটিঙে শরীরে অনুপস্থিত। প্রতিনিয়ত নিজের ভীরুতার সাথেই তাই আপোষ করতে হয় শোস্তাকোভিচকে, সে নিজের কাছেই ছোট হতে থাকে অবিরাম।
ভিন্ন সময়, ভিন্ন সমাজ, ভিন্ন লিঙ্গের দুই শিল্পী। একজন কল্পনার, অন্যজন ইতিহাসের। তাদের ভিন্ন সংকটেরা দুই মাত্রায় স্পর্শ করে গেলো ঢাকাবাসী কাউকে।