০৫ জুলাই
সাতটি রঙের মাঝে নীল খুঁজে না পেয়ে পাশের বাড়ির কোনো কিশোরী সারা বিকেল হারমোনিয়াম নিয়ে আক্ষেপ করলো, আকাশ তবু হয়ে রইলো ছাই, আর ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের পদার্থবিজ্ঞানের থিওরি অগ্রাহ্য করলো ঝিরঝিরে বৃষ্টির গতি।

বৃষ্টি ভেজা ফাঁকা সড়কের চাইতে মহৎ কিছু কোথাও দেখি না। রিকশা থেকে চাইলে চোখে পড়ে, ক্যারিয়ার শেষ হওয়া কোনো ফুটবলারের মতোই পানি জমা ফাঁকা মাঠে নিঃসঙ্গ বসে আছে একটা কুকুর। ছুঁড়ে ফেলা গরুর নাড়িভুঁড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে জয়নুল আবেদীনের কাক। সড়ক শুধোয়, পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে মহীনের ঘোড়াদের নিয়ে যাচ্ছে? উত্তর দিতে পারি না।

ম্যাগি ও ফেরেল, কোলসন হোয়াইটহেড আর দেবেশ রায়কে অগ্রাহ্য করে পড়ার টেবিলে শুধু প্রিন্ট করা জার্নাল। ‘ডেথ এন্ড কম্পাস’ গল্পে বোর্হেস কী করেছে, হিচকক কেন পছন্দ করে না ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’, কেন অ্যালান পো’র দুঁপোকে নিউইয়র্কের বদলে ঘুরে বেড়াতে হলো প্যারিসে।

দর্শনের চাইতেও মার্কেটিং অধিক সেই বাজবল নীতিতে ধ্বসে যাচ্ছে ইংল্যান্ড, এমি মার্টিনেজের দেখা পেতে চলছে কাড়াকাড়ি, আর সুইচ টিপলেই বাংলার উন্নয়ন। তবু সাতাশ নম্বরে জমে ওঠে পানি, সুড়ঙ্গ বনাম প্রিয়তমা সংক্রান্ত বালছাল চলে, ভাগনার গ্রুপ করে বিদ্রোহ। অন্তহীন মাথাব্যথা নিয়ে ভাবি, পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র আমিই কি সুস্থ?

নো মোর লাইফ ইজ এলিমেন্টারি ডিয়ার ওয়াটসন, কেমন করে- কী দিয়ে সাজাবো না জানলেও এখানে দুনিয়া জুড়ে কেবল নীল।

১৯ জুন
এজবাস্টন টেস্টের প্রথম তিনদিনে উসমান খাজা যখন খেলছেন তার জীবনের ইনিংস, সেই সময়ে বাংলাদেশে শহরে শহরে নিজেদের ১৯তম জন্মোৎসব পালন করলো বইবিপণী বাতিঘর।

বিন্দুমাত্র অফ-ফর্ম, অথবা তরুণ কোনো ব্যাটার উঠে আসা মাত্রই নির্বাচকেরা উসমান খাজাকে খারিজ করে দিয়েছেন বহুবার। খাজা কিন্তু ফিরেও এসেছেন। তবুও থেকে গেছেন সেই বিরল অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটারদের একজন, যাকে প্রতিবার মাঠে নামতে হয় পরের ম্যাচে বাদ যাবার সম্ভাবনা মাথায় নিয়ে।

বাংলাদেশের বইপড়ুয়াদের দশা ওই খাজার মতোই। যখনই কোনো বইবিপণীর প্রতি ভালোবাসা জমে ওঠে আমাদের, প্রায়শই সেটাকে দেখি বন্ধ হয়ে যেতে। খুব কম বইবিপণীই দীর্ঘস্থায়ী হতে পেরেছে এখানে। বাতিঘর সেদিক থেকে ব্যতিক্রম। চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে তারা এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে একরকম চেইন শপ, বিভাগীয় বেশ কয়েকটা শহরে তারা এখন ইনিংস থিতু করেছে, যাত্রা করেছে প্রকাশনী হিশেবে। আগ্রহী মাত্রই জানেন বই কেনা ছাড়াও বই পড়া বা আড্ডা দেয়ার জন্যেও বাতিঘর বিপণীগুলো কেমন ঘরোয়া।

গতকাল বাতিঘর জন্মোৎসবে গিয়ে বেশ ভালো সময় কেটেছে। বইয়ের পাঠক, লেখক আর বইপ্রেমী সমমনা মানুষদের সাথে আড্ডা মারার সুযোগ খুব বেশি হয় না এই শহরে। গতকাল এক সন্ধ্যায় তেমন অনেকগুলো মুখের সাথেই দেখা হয়ে গেলো; নাম বলে শেষ করা যাবে না।

১৪ জুন
ভারাক্রান্ত এই দুনিয়ায় নতুন বই প্রকাশ নয়, লেখকের নামকে একটু বেশি মানুষের কাছে নিয়ে আসে কোনো ক্লিকবেইট স্ক্যান্ডাল আর মৃত্যুর খবর।

কিছু লেখক থাকেন, যারা পড়ার আগেই আমাদের চেনা কেউ হয়ে যান কাছের পাঠকদের সূত্রে। প্রত্যেক পাঠকেরই নিজের বৃত্তে কিছু সমমনা পাঠক থাকে। সেইসব সমমনা মানুষের মধ্য দিয়ে, আরও অনেক না-পড়া-লেখকের সাথে একধরনের আত্মিক যোগাযোগ ঘটে যায় পাঠকের। ইউকিও মিশিমার ক্ষেত্রে তেমনটা হয়েছে আমার, করম্যাক ম্যাকার্থির ক্ষেত্রেও।

জীবিত লেখকদের মাঝে অন্যতম শ্রেষ্ঠ – এমন একটা গুঞ্জন প্রায়ই শুনতাম করম্যাক ম্যাকার্থিকে নিয়ে। ফলে, তার উপন্যাসের জগতে না ঢুকলেও টুকটাক সাক্ষাৎকার পেলেই সেটা পড়তে ছাড়িনি। মাঝের সময়টায় মিশিমার ফিকশনের জগতে ঢুকে পড়লেও ম্যাকার্থির জগতে আমার ঢোকা হয়নি, সেই ফাঁঁকে ভদ্রলোক চলে গেলেন।

বিদায় ম্যাকার্থি। লাশ ঠুকরে খাওয়া শকুনের মতো ছোটোলোক হয়ে এবার সত্যিই ঢুকবো আপনার উপন্যাসের জগতে। তার আগে হয়তো আপনার ‘নো কান্ট্রি ফর ওল্ড ম্যান’-কেও একবার চালিয়ে নেবো ল্যাপটপের পর্দায়।

০৩ মে
মৃদু এইসব ঝড়-জলের দিনে পৃথিবী কি হিস্টাসিন খায়?

মনে করো সময়ের অর্ধেক প্রাচীন একটা দিনে দুষ্টু ছেলের দল রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’ থেকে উঠে এসে খেলাধূলা করলো। তারপর মাগরিব পার করে বাড়ি ফেরার অপরাধে তীব্র বকুনি, দুয়েকটা আঘাতের ক্ষত। তারপর থেকে সময়ের সাথে সাথে পৃথিবীর বয়স বাড়ে, ব্লাড প্রেশার বাড়ে, বাড়ে লুকানো সেই ক্ষতের বিস্তার। হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করা যায় যে উত্তরাধিকার সূত্রে এসব মৃদু ঝড়জলের দিন বহন করে বিষণ্ণতা, আর ব্যক্তি বহন করে বিষাক্ততা।

এসব দিনে ধানমন্ডি লেকের পারে গাছের আড়ালে যুগলেরা চুমু খায় লুকিয়ে, কোথাও অনেকটা ফাঁকা রাস্তায় পড়ে থাকে নিঃসঙ্গ একটা ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া। মনে হয়, ইতালো কালভিনো তার আমেরিকার ডায়েরিতে এই দিন নিয়ে অন্ততঃ একটা পাতা খরচ করতোই; মনে হয়, এই দিনটা এবিং মিসৌরির বাইরে তিনটি বিলবোর্ডে লিখে রাখার মতোই। আজ সবই ভালো লাগে। অথচ কিছুই ভালো লাগে না। উইলিয়াম ট্রেভরের ছোটগল্পের মতো ব্যাখ্যাতীত একটা বিষাদ বেরিয়ে এসে এলাকার গলির জীবনকে ছাড়খাড় করে দেয়।

রাশিয়ার যুদ্ধের সালতামামিতে ভরে থাকে পত্রিকার পাতা, ওয়েবসিরিজের স্কিপ করা ইন্ট্রোর মতো ফট করে ফুরিয়ে যায় দিন, পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়তেই থাকে- তবু সে প্যারাসিটামল খেতে চায় না।

মানুষ ক্ষুদ্র, কিন্তু তার দুঃখেরা অনন্ত-বিশাল। 

২১ এপ্রিল
উর্দিহীন কোনো দল যখন তুলে নিয়ে যায় একজন মানুষকে, কী ঘটতে পারে তখন? অন্যভাবে বললে, লেখক কিংবা নির্মাতার চোখে কীভাবে ধরা দিতে পারে সেই গল্প?

ওয়েব সিরিজ ‘মহানগর’ এর দ্বিতীয় মৌসুম দেখা শেষে ওপরের প্রশ্নটা মনে ঘাই মারতেই থাকে। প্রশ্নটা জাগানোর জন্য পুরো ক্রেডিট পরিচালকের ঘাড়েই চাপে, আর মনের খুঁতখুঁতিটা- বলাই বাহুল্য- আমার ছোটোলোকি।

সাধারণ কোনো মানুষ যখন বদ্ধ একটা জায়গায় মুখোমুখি হয় বিশেষ বাহিনীর, ভেবে দেখি, গল্পকার তখন ব্যাপারটা দেখাতে পারেন অ্যাবসার্ডনেস দিয়ে। উদাহরণ হিসেবে চট করে মনে আসে হাসান আজিজুল হকের ‘সাক্ষাৎকার’ নামের গল্পটা, কিংবা আরও বড় স্কেলে কাফকার ‘দা ট্রায়াল’। অপরাধ নয়, অপরাধীটিকে এক ধরনের অকারণ বিচারের মুখে ফেলাই যে উর্দিহীন ওই জাস্টিস লীগের লক্ষ্য- এই ঘরানার লেখা কোনো থাপ্পড় ছাড়াই সেই ব্যাপার আমাদের বুঝিয়ে দেয়।

তবে, গল্পকার কিংবা নির্মাতার সামনে আরেকটা পথও থাকেঃ অপেক্ষাকৃত সরাসরি কথা বলা।

সেই পথ যারা বেছে নেন, তারা আবার কাজ করেন দুই ভাগে।

১) নির্দিষ্ট কোনো ঘটনাকে ইঙ্গিত না করে তারা আলো ফেলেন কোনো ব্যক্তিগত ঘটনায়, একজন ব্যক্তির বেদনাকে তারা করে ফেলতে পারেন একটা জনপদের বেদনা। লাতিন আমেরিকা ছাড়াও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের ‘নিও নয়্যার’ থ্রিলার লেখকেরা এই কাজটা করে আসছেন গত কয়েক দশক ধরে। আমাদের সুমন রহমানের ‘নিরপরাধ ঘুম’ এক্ষেত্রে খুব উল্লেখযোগ্য একটা কাজ।

২) নির্দিষ্ট একটা পীড়নের গল্পকে লেখক বা নির্মাতা উপস্থাপন করেন ইতিহাসের প্রেক্ষিতে, ফলে পাঠক পায় সত্য-আশ্রিত ফিকশন পড়া/দেখার একরকম অনুভূতি। চট করে মনে পড়ছে কোস্তা গারভাস এর সিনেমা ‘মিসিং’ এর কথা।

… খুঁতখুঁতে এবং আঁতলামি ভরা মনে অনুভব করি, সম্ভাবনার সমস্ত বুদবুদ ছুঁয়ে এসেও ‘মহানগর’ দর্শককে এর ঠিক কোনো অনুভূতিই দেয় না। এই গল্প কি রিয়ালিস্ট? নাহ, কারণ বিটিভি যুগের সিনেমার নায়ক হয়ে এখানেও হারুন এক সুপারম্যানের মতো জয় ছিনিয়ে আনে শক্তিশালী ভিলেনের বিপরীতে। সেখানে ইচ্ছাপূরণ থাকলেও বাস্তবতা থাকে না। এই গল্প কি নির্দিষ্ট কোনো ঘটনার ক্রিটিক, ডকুমেন্টেশন? নাহ, কারণ ঝোপেঝাড়ে কথা বললেও আমাদের ক্ষোভকে বিশেষ কোনো খাতে এই গল্প প্রবাহিত করে না।

শেষ পর্যন্ত ওসি হারুণের গল্প তাই আমাদের কাছে একটা মেলোড্রামাই হয়ে রয়, কারণ বাস্তব ও সমকাল দ্বারা দারুণ ভাবে অনুপ্রাণিত হয়েও আমাদের কালকে সে বর্ণনা করে মোটাদাগে, ঠিক যেমন প্রেম দেখাতে মোবাইলের আলাপ আর দামি রেস্তোরাঁর দৃশ্যকল্প দেখানোর বাইরে এ যুগে কেউ হাঁটে না।

তবু, ঈদের ছুটিতে আগ্রহীদের ‘মহানগর-২’ দেখে ফেলার আমন্ত্রণ জানিয়ে, না বলে পারি নাঃ দুইটা কথা মনে রাখবেন জনগণ।
১) বাংলা ওয়েবসিরিজ বা সিনেমার দুনিয়ায় এই কাজ নতুন। কারণ আড়িপাতার নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার মতো, আরো কিছু ক্ষেত্রে মহানগর আনকোরা, ঈদের চাঁদের মতোই নতুন।
২) লেখকের সাহসের প্রশংসাই যখন করি আমরা, শিল্পের প্রশংসা তখন নিশ্চিত দূরে চলে যায় বিনয় মজুমদারের সারস হয়ে। It is – and it should- always about the story. It is not about you.

১৪ এপ্রিল
ক) “আগে লোকে ধরে নিত নানা ধরনের ইতিহাস বেরোবে। তাতে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য ও ব্যাখ্যা থাকবে। ইদানীং দেখছি, এ দেশের শাসক ইতিহাসকে কবজা করতে চাইছে। একচেটিয়া দখল নিতে চাইছে। এটা শুধু আমাদের দেশেই নয়, বাংলাদেশেও কিছুটা লক্ষ করা গেছে। কিন্তু সত্য এই, ইতিহাসকে একচেটিয়া কবজা কেউ আজ পর্যন্ত করতে পারেনি। বই পুড়িয়ে নাৎসি জার্মানিও নয়।” – সাক্ষাৎকারে আশিস নন্দী।

গতকাল পত্রিকায় এই আলাপটা পড়ে ‘গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে’এর সাথে মিলিয়ে বেশ কৌতুক বোধ করলাম।

খ) ইন্ডিয়ানা জোনসের সিনেমায় শর্ট রাউন্ডের ভূমিকায় অভিনয় করা সেই কি হুই কোয়ান এবার অস্কার পাওয়ার পরে বিচিত্র এক মিশ্র অনুভুতি হলো। আনন্দ হয়, কিন্তু ফেলে যাওয়া সময়ের জন্য একটা আক্ষেপ- একটা হতাশাও হয় তখন।

জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রয়াণে তেমন মিশ্র একটা অনুভূতি হলো আবার। রাজনীতিতে নানা রকম আপোষ করতে হয় মানুষকে, কিন্তু রাজনীতিটা যদি হয় ক্ষমতার বদলে কল্যাণমুখী- তার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে লোকে তখন কার্পণ্য করে না। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রয়াণে খারাপ লাগে, কিন্তু ভালো লাগে তার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ দেখে। এই শ্রদ্ধার পাশে- সাইফুদ্দিন মিলনের মতো কেলানো হাসির পোস্টার বানিয়ে পেঙ্গুইন ভাইদের আরোপিত সালাম জানানোকে আরো বেশি নোংরা লাগে।

৩) ইংরেজিতে সাফার মানে দুঃখভোগ, হিন্দি গানে সাফার মানে যাত্রা। এই সাদৃশ্যের উৎস কোথায়? কেন শঙ্খ ঘোষের কবিতা হয়ে আর্তনাদ করে জঙ্গলের কাটা হাত, গারো পাহাড় আর সিন্ধুর স্রোত?

… শুভ নববর্ষ ১৪৩০। সবার ভালো হোক।

২৮ মার্চ
 “Unfortunately, the architect of your soul appears to be social media.”- বলেছিলেন লিডিয়া টার। সেই লিডিয়া টার, ক্যান্সেল কালচারে বরবাদ হয়ে যাবার আগে – গল্পের কোনো দুনিয়ায় হলেও- পৃথিবী যাকে একনামে চিনতো।

কী দিতে পারে কেউ, তার চাইতে আজ বড় হয়ে ওঠে কী দিতে সে পারেনি। খারিজের খাতায় কাকে কাকে তোলা যায়, আরিয়া স্টার্কের মতোই দিনরাত সেই লিস্টি জপে যায় অনলাইনের সদাসতর্ক ল্যান্সনায়েক।

একদল আকাশ মাপে নিজের ছকের জানালায়, সেখানে মানিক ব্যানার্জি হয়ে ওঠে বিষাক্ত পুরুষতন্ত্রের ব্যবসায়ী, মার্কেজ হয়ে যান পেডোফাইল।

আরেকদলের পক্ষে থাকে যুগের হাওয়া। এ দেশের বুলি, ও দেশের গালির মতোই; এ যুগে যা সাধারণ, পরের যুগে তা উচ্চারণ-অযোগ্য দোষ।

কপিরাইটের সত্যগ্রহ আন্দোলনের সামনে ছিটকে যায় কাজী আনোয়ার হোসেন, সোফিয়া তলস্তয়ের কাঠগড়ায় আটকে যায় তলস্তয়ের ঘোড়া। এ যুগে শান্তি নাই, সত্যি কেবল যুদ্ধ।

ফালতু বকে পার পাবার দিন আর নাই জেনে স্বস্তি লাগতো একদা, এখন হয় সংশয়, এমনকি ভয় পর্যন্ত। সন্ধ্যার নক্ষত্র, তুমি বলো দেখি কোন পথে যাবো?

০৯ মার্চ
 ইউরোপের অধিকাংশ দেশের জনসংখ্যার চেয়ে, কিংবা পৃথিবীর অধিকাংশ ধর্মের চেয়েও বেশি অনুসারীযুক্ত বাঙালি সেলেব্রিটিদের অনলাইন মুদি দোকান দেখতে দেখতে ফেসবুকে স্ক্রল করে নিচে নামি। মানুষ হিসেবেও।

বনবিবি আছে, কাচ্চি আছে, কনসার্ট আছে; ভালোমতো তাকালে এখনও শাহীনকে কার যেন পুলার পেছনে লেগে থাকতে দেখা যায়। মুড়ির টিন, অঞ্জন দত্ত আর অপ্রীতিকর বইমেলার আয়ূ আগেই শেষ; গুলশানের ফায়ার ফাইটারের মতো একটু মাথা তুলেই তারা বিদায় নিয়েছে।

মাথা উঁচু করার চেষ্টা করেছিলো কুষ্টিয়ার ফুলপরীও, কিন্তু প্রগতির পেটোয়াবাহিনির সামনে তার মিন মিন স্বর ঢেকে গেছে মার্চ মাসের কলার টিউনের শব্দে। ওদিকে জলের ওপর চক্রাকারে ঘুরতে থাকা বক, তাকে দেখে আমার জাগে ইমতিয়াজ মাহমুদের কবিতা পড়ার শখ।

ইমতিয়াজ থেকে চোখ সরালে এদিকে কী আছে? ‘ক্যালকাটা ক্রমোজম’ আর ‘জবরখাকি’। অমিতাভ ঘোষকে আজও ভালো না লাগলেও বর্ণালিকে আজও ভালো লাগে। আর তার চেয়েও ভালো লাগে রাস্তায় হাঁটা, পৃথিবী তাদের কাছেই নিজেকে উন্মুক্ত করে – যারা নাকি একা একা হাঁটে।

পাতা ঝরে ন্যাংটো হয়ে যাওয়া একজোড়া এস্থেটিক গাছকে সামনে রেখে বিশ্বাস ক্রেডেন্সের নিচতলায় ঝলকায় ক্যাফে সিক্সটি এইট। রোদের মাঝে ডেস্টিনি-মার্কা টাই বেচে আফ্রিকানদের মতো দেখতে এক তরুণ। বিদ্যুতের খুঁটি ঘিরে নাচে তিন না হলে চার বছর বয়েসি এক নেইমার জুনিয়র। নামে নেইমার হলেও রাস্তার নটির পুলাটি প্রায় কাকার মতো দেখতে, আবেগে থরথর বিভূতিভূষণ একে দেবশিশু ছাড়া অন্য কোনো নামে ডাকতেন না। বছর পাঁচেক পরে খিদের কষ্ট কাটাতে এই পিচ্চিই ডান্ডি খেয়ে শুয়ে থাকবে কোনো ফ্লাইওভারের নিচে, সেই কষ্টকল্পনায় এখন খারাপ লাগে। সামনে এগোলে খারাপ লাগে আরো বাড়ে। মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে বৃদ্ধা যাত্রীর কাছে বেশি ভাড়া চেয়ে বুকের কাছে হাত নিয়ে কাঁদে আরও বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা।

… অথচ আমি লিখতে চেয়েছিলাম এমন কিছু, যা হয়ে উঠবে বাংলা ভাষার বাগধারা।

২৬ ফেব্রুয়ারি
টিএসসি’র মোড়ে ‘বরকতেরই আপন দেশে, হিন্দী-উর্দু সর্বনেশে’ লেখা ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে কে? দেলোয়ার জাহান ঝন্টু! দেলোয়ার জাহান ঝন্টু! দেলোয়ার জাহান ঝন্টু!! হিন্দী ছবি আমদানির বিরুদ্ধে আহুত মানববন্ধনে তার দলবল এমন গলা কাঁপায়, সঞ্জয় লীলা বানসালি থেকে খোদাবক্স মৃধার কাতারে তাদের দিব্যি নামিয়ে দেয়া চলে।

ভেতরে ঢোকার আগে একটু ওভালটিন চা খাবার সাধ জাগে। কিন্তু নানা রঙের ব্যানার উপর থেকে যেভাবে ঝোলানো, তাকে করে জায়গাটাকে টিএসসি কম হগওয়ার্টস বেশি বলে বোধ হয়। বসন্ত বাতাসে দোল খাচ্ছে নানা ক্লাবের বিবিধ কর্মসূচী। রঙিন এসব ব্যানারদের মাঝে বিশেষ করে দৃষ্টি কাড়ে ফুল ছড়ানোর আনন্দে হাস্যময় কামরুন্নাহার মুন্নী। উদীয়মান এই কবির গ্রন্থের নামঃ প্রেম ভালোবাসা একটি ঐচ্ছিক কাজ।

প্রেমের এই দুর্দান্ত হাইপোথিসিস আবিষ্কার করা মানবীর সামনে নতমুখে ওভালটিন চা খাওয়া শেষে চুপিসারে ঢুকি পড়ি মেলায়। খেলা হবে!

তা খেলার বদলে আড্ডাটাই অবশ্য বেশি হয়। আফসার ব্রাদার্সের সামনে জাহিদ হোসেন, সালমান হক, ওয়াসি রাফির সাথে শহীদুল জহিরের পানাভ্যাস শীর্ষক একটি নতিদীর্ঘ আলাপ দিয়ে শুরু। এরপর বাতিঘরের স্টলে বসে আলভী আহমেদের সাথে ওয়েবসাইট বিষয়ক আলাপ, মাঝে চন্দ্রিল ভট্টাচার্য ক্যামিও দিয়ে গেলেন ক্ষণিকের জন্য। এরপর নজরুল ভাইকে সাথে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ‘চন্দ্রবিন্দু’র স্টল।

বর্ণমালায় সবার নিচে বলেই বোধহয়, চন্দ্রবিন্দুর ঠিক সামনেই বিস্তৃত ‘আকাশ’। কুঁড়েঘর আকৃতির এই স্টলের সামনে মেলায় আগত সুন্দরীরা এসে ছবি তোলার গুরু দায়িত্বটি সেরে নিচ্ছে। ধূলো অগ্রাহ্য করে দারুণ উদাসী ভঙ্গিমায় এক-একটি প্রোফাইল পিকচার অর্জন করা এই জনতাকে পেছনে ফেলে লিটল ম্যাগ কর্নারের দিকে সরে গেলেই সিগারেটের আড্ডা হতে পারে কামাল ভাই, আলতাফ ভাই, নোমান ভাই, হামিমদের সাথে। অধূমপায়ী ভদ্রলোকদের দলে আমার সাথে আছেন হাসনাত শোয়েব দম্পত্তি, জুয়েল ভাই এবং ছিট কাপড়ের ব্যবসায়ী এনামুল রেজা।

ফেরার পথে রাসেল রায়হানের সাথে তো গান্ধীকেও হারিয়ে দেওয়া দীর্ঘ পদযাত্রা। কখনো-সখনো তার মাঝে অভিজিৎ রায়কে অবশ্য মনে পড়ে। কিন্তু সায়েন্স ল্যাবের মোড় আর মিরপুর রোডে এই রাতেও এমন ভিড়, তার মাঝে লোকটা আলাদা করে ঠিক ফুটতে পারে না।

‘নিদ্রায় আসক্ত হতে চেয়ে তবু বেদনায় জেগে ওঠে পরাস্ত নাবিক…’

০৮ ফেব্রুয়ারি
স্পটলাইটের নিচে বকবকানো সালমান রুশদীর কানের কাছে ঝিকমিক করে ওঠে ছুরি। ম্যান ফ্রম নিউ জার্সি চিৎকার করে জিজ্ঞেস করেঃ ‘What do you say to the God of Death?’

‘Not today!’ বলে একচোখো সাইক্লপস হয়ে ওঠেন রুশদী, সেই ১৯৮৯’এর ভ্যালেন্টাইন ডে থেকে যিনি জোসেফ আন্তন। পাশ থেকে সুবিমলমিশ্র ফিসফিস করে বলেনঃ ‘চিল্লাবে না, গণতন্ত্রে অমন দুয়েকটা কেস হয়েই থাকে। চিল্লালে পাশের দেশ শুনতে পাবে।’

তা এসবের আগে অবশ্য সাহিত্যক্ষেত্রে সকলকেই হার মানিয়েছে বাংলার একাডেমি, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়ে গেছে বলে মধ্যবিত্তের মতো তারাও ছেঁটে ফেলেছে আদর্শ। আদর্শ ফেরে, কিংবা ফেরে না; আর মধ্যমেধার কেউ হয়ে ওঠে- বাংলা না জেনেও- বেস্টসেলার। মুজতবা আলী হলে ‘মধ্যমেধা’ শব্দটার পাশে বন্ধনীতে বসিয়ে দিতেনঃ উভয়ার্থেই!

ভেবে দেখলে, মেলা প্রান্তরে উদাস হাসি মারা বেস্টসেলার লেখকের ভিড় প্রায় আর্ট সামিটের মতোই। পাঠক ছবি তুলবে কী, একজন ক্রেতা পেলেও লেখক নিজেই তাকে জাপটে ধরে সেলফি তোলে।

সেখান থেকে সরে তুরস্কে গেলে সবকিছু ভেঙে পড়ে, ভারতে গেলে আদানি গ্রুপের বিপর্যয়। এদিকে নজর রাখলে কোথাকার কোন আলম হয়ে ওঠে ফারহাদির সিনেমার ‘হিরো’।

সত্যি বলতে, এই একটি দিকে ২০২২ এর জুড়ি মেলা ভার। ‘টার’ বলতে পারো, ‘ট্রায়াঙ্গল অফ স্যাডনেস’ বলতে পারো, ‘বার্ডো’ কি ‘ফেবলম্যান’কে পাশ কাটিয়ে ‘জয়ল্যান্ড’ আর ‘হাওয়া’ পর্যন্ত উল্লেখ করা যায়। আর এবিং- মিসৌরির পাশে ঝুলিয়ে দেওয়া বিলবোর্ড তিনটির দিকে মুগ্ধচোখে দাঁড়িয়ে থাকার পর আইশেরিন নিয়ে মাতামাতিকে একটু বেশিই লাগে। ম্যাকডোনা লোকটা সেই ‘ইন ব্রুজেস’ থেকেই তার চরিত্রদের আত্মহত্যার প্ররোচনা দিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে একরকম আত্মহত্যাই করে মরফিয়াস। তবু তার জগতটাকে এতো আকর্ষণীয় লাগে যে মিশিমাকে পাশ কাটিয়ে, মুরাকামির মুক্তগদ্যকে এড়িয়ে, ইউপিএল-এর ভারি প্রবন্ধদের কনুই মেরে পড়ার টেবিলে থাকে কেবল নেইল গেইম্যান। আর একটু একটু থ্রিলার লেখার কাটাকুটি খাতা।

ফেব্রুয়ারির দারুণ ঝলকে লেখকের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায় বিগ ব্রাদার, নইলে ছুরি হাতের হাদি মাতার। জানতে চায়ঃ ‘What do you say to the God of Death?’

রুশদীকে পাশ কাটিয়ে সবচেয়ে জোরে শোনা যায় সুবিমলমিশ্রের গলাঃ ‘I do not want to be a Writer. I want to be the meaning of it.’

০৫ ফেব্রুয়ারি
আর্ট সামিটে ঢুকতেই বেশ একটা ধাক্কা লাগে। বোধ হয় যে হঠাৎ ‘ওয়াকান্ডা ফরএভার’ স্লোগান সমৃদ্ধ কোনো ইউটোপিয়ায় চলে এলাম। চোখের এই কড়কড়ানি কি পোশাকের জন্য?

হতে পারে। কারণ ছেলে থেকে মেয়ে হয়ে মহিলা- সকলেই এখানে বড় মনোহর এবং ইনস্টাগ্রাম্য। নকশা কি সানন্দার পাতা থেকে উঠে আসা নীল জামদানি থেকে উত্তরাধুনিক হাঁটু ছেঁড়া জিন্স, সবই এই কসমোপলিটান ঘাটে জল খাচ্ছে। কখনো জ্যাকেটের একপাশ কেটে রেখে কেউ খুব বাতাস লাগায়, কোথাও আধেক খোলা পিঠের মাঝে ঘোড়ার ট্যাটু ঝলকায়। বিশেষ করে চোখ যায় রাজকন্যাদের দিকে। কোনো সুদৃশ্য ভাস্কর্য, না হলে রঙিন দেয়াল অথবা বিমূর্ত চক্রা-বক্রা কাঠের টুকরোর পাশে দাঁড়িয়ে এরা ব্যক্তিগত ফটোগ্রাফারের লাল সুতা-নীল সুতা বের করে ফেলে।

ফটোগ্রাফারেরা প্রজাতিতে প্রধানত পুরুষ। তবে এখন তারা কখনো ওয়েস এন্ডারসনের ক্যারিকেচার হয়ে ডানে কি বামে ঝোঁকে, কখনো আবার সুন্দরবনের ঘড়িয়াল হয়ে হামাগুঁড়ি দেয়। আর তাদের সামনে মেয়েরা? কখনো হালের ফ্যাশন গোল চশমাকে নাচিয়ে, কিংবা নাকের লোকজ নথে কাঁপুনি সৃষ্টি করে, কিংবা পরনের জনি-প্রিন্ট শাড়ির আঁচলটি পূর্বাচল পর্যন্ত বিস্তৃত করে এরা কত যে আনমনা হয়! জয়া আহসান না হলেও পূর্ণিমার নিচে নামানো এদের মুশকিল।

কিন্তু এসব জাজ করা এ যুগে বিপজ্জনক। কখন কে খারিজ করে দেবে- কে জানে! সেই ভয়ে আমি আর অনীম ভাই মুগ্ধ হয়ে সাজানো জিনিসপাতি দেখার ভান করি। সেই কিছু ত্যাঁড়া-ব্যাঁকা মূর্তি, কয়েকটা মঙ্গোলীয় চেহারার ছবি, আর খড় নইলে মাটি নইলে কাঠ দিয়ে বানানো ফকিরা কিছু ভাস্কর্য, বিশাল ক্যানভাসে ইচ্ছে মতো রঙ নষ্ট করে মনের জটিল ভাব ব্যক্ত করার অপচেষ্টা। সাদা কিংবা হলদে আলো ফেলে অযথাই এদের শিল্পময় করার চেষ্টা করা হয়েছে। সব কিছুর মাঝে পড়ে- অনীম ভাইয়েরটা জানি না- আমার ফাতরা এবং মধ্যবিত্ত মনটা ইতস্তত করে।

০২ ফেব্রুয়ারি
মাঝে মাঝে এমন হয়, পুরোনো কোনো ভালো উপন্যাসের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। উপন্যাসটা আখ্যানধর্মী হলে চলবে না, সেটা হতে হবে বুদ্ধিবৃত্তিক কিছু। পড়তে ইচ্ছে করে এমন কিছু, শব্দেরা যেখানে একেবারে হেলাফেলায় ব্যবহৃত হবে না, গদ্য মসৃণ হলেও শব্দেরা যেখানে চিন্তা উসকে দেবে, কিংবা আমার হাইপার-অ্যাকটিভ ঢাকানিবাসী মনটাকে আবেগমথিত করবে। সবচেয়ে বড় কথা, ওল্ড ম্যান’স সাধু ভাষা কি পুরোনো দিনের মানুষ নয়, পড়তে ইচ্ছে করে একেবারে নাগরিক মনের কাউকে।

এমন উপন্যাসের কি খুব অভাব? তা নয় হয়তো। কিন্তু ইচ্ছে করে- অন্য কোনো ভাষা নয়- খাঁটি বাংলা ভাষায় অমন কিছু পড়ি – কেবল বাংলা শব্দের সংস্পর্শে দীর্ঘক্ষণ বুঁদ হয়ে থাকার জন্য।

এমন শর্ত মিলিয়ে পড়ার জন্য বই বেশি পাওয়া যায় না। হুমায়ূন আহমেদের একেবারে প্রথম দিকের উপন্যাসগুলো আছে, আছেন রশীদ করিম, হাসনাত আবদুল হাই। এদের আলতো করে ছুঁয়ে গিয়ে তাই বেছে নেই সৈয়দ হককে।

‘… যত নিকট হোক দু’টি মানুষ, এমনকি তারা বিনিময় করুক তাদের রক্ত, তবু তারা বুঝতে পারবে না একজন আরেকজনকে সম্পূর্ণভাবে। যে সেতু আমরা কল্পনা করে থাকি তা সেতুর বিভ্রম মাত্র। নইলে মুখে না বললে, ভাবনাকে ভাষায় না ব্যক্ত করলে কেন অচল হয়ে যায় জগৎ?’

এসব অতি পুরাতন কথাও এমন গানের মতো করে বাংলা গদ্যে বলতে পারেন আর কজন?

২০ জানুয়ারি
অনেক মানুষ, তাদের অনেক চেহারা।

আল নূর চক্ষু হাসপাতালের সামনে দুই চোখ আর নাকের নিচে তেরচা করে ঘোমটা টেনে পিঠা বিক্রি করে এক চাচী। একশ টাকায় দৈনিক আসা-যাওয়া তার, এই দাবির মাধ্যমে রিকশাচালকের সাথে দরদাম করে একটু উঁচু দাঁত নিয়েও হাসতে থাকা এক মোটাসোটা আপা। বাবার হাত ধরে থাকা এক পিচ্চি বেণী দুলিয়ে পেছনে তাকিয়ে ফুটওভার ব্রিজে ওঠার শৈশবের আনন্দে চ্যাঁচায়- ‘মা! আসো! বিরিজ দিয়ে যাবো!’

মোড় ঘুরিয়ে হাঁটা ধরলে এমনকি মিরপুর সড়ক আজ অচেনা। জট দূরের কথা, পর্যাপ্ত গাড়ি পর্যন্ত দেখা যায় না। ধু-ধু রাস্তায় সত্য হয়ে রয় কেবল হালকা কুয়াশা, আর অনেকদিন পর ছুটে যাওয়া একটা করে বাস, প্রাইভেট কার, না হলে রিকশা। বিস্ময়কে চূড়ান্ত করে ক্লপাটি-ক্লপাটি-ক্লপ শব্দে রাস্তা দিয়ে ছুটে যায় এক জোড়া সাদা ঘোড়ায় টানা গাড়ি। ঘোড়া দুটো ম্যালনিউট্রিশন ভারাক্রান্ত না হলে এই রাস্তাকে ধরে নিতাম ভ্লাতাভা নদীর ধারের প্রাগ শহরের মালা স্ত্রানা। তবু সন্দেহ হয়, ইবিএল ব্যাংকের হলদে আলোর চোখ টিপ মারা সাইনবোর্ড-সম্বলিত এই মেট্রোপলিস কি আমার?

পিয়্যান ফোন করেছিলো আসবে বলে। শালা আজ না আসুক। ইস্তানবুলের ওরহান পামুক থেকে শুরু করে মিডনাইট ইন প্যারিসের আদ্রিয়ানা- আজকের এই একাকী পথচলার খাতিরে আমি সবাইকে অগ্রাহ্য করতে পারি। একটা গান হলে এই রাতটা হতো সাহানা বাজপেয়ীর গাওয়া, একটা গল্প হলে এই রাতটা হতো রবীন্দ্রনাথের লেখা; ‘… সুরবালা আজ তোমার কেহই নয়, কিন্তু সুরবালা তোমার কী না হইতে পারিতো …’

সামনে এগোলে রাস্তার অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়। মহুয়া চটপটির জমজমাট ব্যবসার পাশেই শীতের রাতের রেলস্টেশনকে মনে করিয়ে মাফলার টেনে ঘুমায় এক ডাবওয়ালা। চোখে-মুখে দুষ্টুমি নিয়ে কমলা রঙের টেনিস বল ওপরে ছোঁড়ে এক পিচ্চি, ক্যাচ ধরার মুহুর্তে তার ডান চোখ কুঁচকে যায়। থেমে থাকা বাসের জানালা দিয়ে কুলির মতো বমি করে এক তরুণ। সেখান থেকে দৃষ্টি ফেরালে চোখ ঝলসে যায় সেই মেয়েটিকে দেখে, যার থেকে বিচ্ছুরিত হয় গোলাপি আলো।

‘যা কিছু তিনি বর্ণনা করেছেন, মূহুর্তের জন্য যেটা তার হয়েছে, সবটাই তিনি দখল করে নিয়েছেন চিরকালের জন্য।’-  আর্নেস্ট হেমিংওয়েকে নিয়ে লিখেছিলেন গার্সিয়া মার্কেজ।

সেইন্ট মাইকেলের সেই ক্যাফেতে যে মেয়েটি ঢুকেছিলো -হেমিংওয়ের বর্ণনায় – কাকের ডানার মতো আড়াআড়ি করে কাটা চুল নিয়ে, একশো বছর পরে আজ তাকে খুঁজতে খুঁজতে আমি ঢাকার রাস্তায় হাঁটি।

১১ জানুয়ারি
নতুন কোনো শব্দ শেখার পর সেটা সবখানে দেখতে পাওয়ার মতো করে, নতুন একটা কিছু নিয়ে আগ্রহ তৈরি হলে সেই জিনিসটা – অনলাইনের আড়িপাতা বাদ দিয়েই- অন্য কোথাও আবিষ্কার করা যায় কাকতালীয় ভাবে। সম্প্রতি তেমনটা হলো দুই সুরকার এবং অপেরা কন্ডাকটরকে নিয়ে। প্রথম জনের নাম লিডিয়া টার, দ্বিতীয়জন দিমিত্রি শোস্তাকোভিচ। প্রথমজনের কাহিনি দেখলাম, দ্বিতীয়জনেরটা পড়লাম।

২০২২ এর সেরা সিনেমার দৌড়ে প্রায় সবখানেই উঠে এসেছে ‘টার’-এর নাম। দুর্দান্ত, অবিশেষণসম্ভব এই সিনেমা দেখে বুঝি উঠি নাঃ পরিচালক টড ফিল্ড, না নাম ভূমিকায় অভিনয় করা কেট ব্ল্যানশেট- কার জন্য বড় হাততালিটা থাকবে। শুরুতে আঁতলামি-ভরা ওই চিত্রনাট্যের শেষে এমন নাগরদোলা রোমাঞ্চ, কিছুতেই সেটা আন্দাজ করা যায়নি।

এই সিনেমায় লিডিয়া টার এক দুনিয়াখ্যাত অপেরা কন্ডাকটার। মানুষী সাফল্যের সম্ভাব্য সকল কিছু পেয়েও তার জীবন অশান্ত। ঘরে সঙ্গিনী রেখেও লিডিয়া ছোঁক-ছোঁক করে বেড়ায় তার কাছে আসা শিক্ষানবিস বাদিকাদের সাথে। আর যেহেতু সে মায়েস্ত্রো, তার অঙ্গুলি হেলনে যেহেতু শেষ হয়ে যেতে পারে মিডিওকার বহু শিল্পীর, সেহেতু কখনো ক্রিস্টা- কখনো ওলগারা সঙ্গী হয় লিডিয়া টারের।

শিল্পীর জীবন শিল্পের অংশ নয়- এই আপ্তবাক্য নিজের ক্লাসেও জোর দিয়ে পড়ায় টার, এ যুগের ক্যান্সেল-কালচার নামক খারিজী সংস্কৃতিকে সে ধুয়ে দেয়। অথচ, ভাগ্যের মোচড়ে টারের নিজের জীবনই ক্রমশ হয়ে ওঠে বাইরের মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। টার আবিষ্কার করে, শিল্প নয়, শিল্পীকেই বিচার করছে মানুষ।

লিডিয়া টারের এই নাটকীয় গল্পের রেশ কাটতে না কাটতেই দেখা হয়ে যায় আরেক কন্ডাকটার শোস্তাকোভিচের সাথে, জুলিয়ান বার্নেসের উপন্যাস ‘আ নয়েস অফ টাইম’-এর পাতায়।

সোভিয়েত রাশিয়ার প্রবাদপ্রতিম সুরকার দিমিত্রি শোস্তাকোভিচের জীবনী-নির্ভর উপন্যাস ওই ‘আ নয়েস অফ টাইম’, তিনটি দীর্ঘ অধ্যায়ে লোকটার জীবনের তিনটা পর্যায় তুলে এনেছেন বার্নেস। দারুণ রকম জাদুকরি গদ্য বার্নেসের। ছোট ছোট অনুচ্ছেদে লোকটা অনেক ভারি কথা বলে যায় অনায়াসে।

আবিষ্কার করা যায়, শোস্তাকোভিচের জীবনের মূল সংকট কখনোই ছিলো না সুর সৃষ্টির- যেমনটা ছিলো না লিডিয়া টারেরও। শোস্তাকোভিচকে বরং তাড়িয়ে বেড়ায় ক্ষমতার সাথে সমঝে চলার ভয়, ব্ল্যাকলিস্টে নাম উঠে যাবার ভয়, পশ্চিমা-দালালের তকমা পেয়ে যাবার ভয়।

নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে বড় বড় কথা বলা পিকাসো কি সাঁত্রের সাথে একমত হতে পারে না শোস্তাকোভিচ। সে জানে, এই একনায়কের রাশিয়ায় সবচেয়ে বড় সত্যি হলো টিকে থাকা। স্তালিনের প্রতিবাদ করে শাস্তি পাবার চাইতে সাহস তার নাই, এমনকি সামর্থ্য পর্যন্ত তার চশমা-পরা টিংটিঙে শরীরে অনুপস্থিত। প্রতিনিয়ত নিজের ভীরুতার সাথেই তাই আপোষ করতে হয় শোস্তাকোভিচকে, সে নিজের কাছেই ছোট হতে থাকে অবিরাম।

ভিন্ন সময়, ভিন্ন সমাজ, ভিন্ন লিঙ্গের দুই শিল্পী। একজন কল্পনার, অন্যজন ইতিহাসের। তাদের ভিন্ন সংকটেরা দুই মাত্রায় স্পর্শ করে গেলো ঢাকাবাসী কাউকে।