২ আগস্ট
কী ঘটে, যখন উপন্যাস লিখতে চাওয়া কেউ গিয়ে যোগ দেয় ওয়েব-সিরিজের চিত্রনাট্যকারদের দলে?
‘কারাগার’ ওয়েব-সিরিজকে নিয়ে বলতে নিয়ে টের পাই, বলার মতো বেশ কিছু কথা আমার জমে গেছে এই নিয়ে।
০১। অনীম ভাইয়ের সাথে আলাপের সূত্র ধরে বছরখানেক আগে যখন ঢুকে পড়ি ‘কারাগার’ সিরিজের চিত্রনাট্যের টেবিলে, তাৎক্ষণিক যে উপলদ্ধিটা প্রথমেই হয়, তা হলোঃ বহু মানুষই চিন্তা করেন ছবি এঁকে। আমি নিজে আজীবন শ্লথগতির, সেইসব উপন্যাসই পড়তে ভালো লাগে- যেখানে চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করে শব্দেরা; সেই সব সিনেমাই আমার প্রিয়- মারদাঙ্গা অ্যাকশানের চেয়ে যেখানে চরিত্রেরা নির্ভর করে সংলাপের ওপর। সেই আমার কাছে ছবি (বলা ভালো দৃশ্য) সাজিয়ে গল্প বলার কায়দা আবিষ্কার তাই একেবারে নতুন এক জগৎ। শাওকি ভাই, মাসুম ভাই আর রাকিব ভাই সেই জগতে আমার একেবারে গুরু, চিত্রনাট্য লেখার প্রাথমিক সমস্ত কায়দাও তাদের কাছেই শেখা।
০২। দ্বিতীয় যে বিষয়টা আবিষ্কার করেছি ‘কারাগার’ দলের সাথে থেকে, সেটাকে বলা যায় ‘দলগত’ শব্দটাকেই নতুন করে চেনা। লেখার টেবিলে মানুষ সবসময়ই একা। সত্যি বলতে, দরজা বন্ধ করলেই ঔপন্যাসিক নিজের ভেতরটাকে বুঝতে পারে। অথচ- আবিষ্কার করি- চিত্রনাট্যের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আগাগোড়া উলটো। কয়েকটা মাথা একত্রে কাজ করে একটা দৃশ্য তৈরি করতে চাইছে, পুরো বিষয়টা খুব কঠিন হবার কথা ছিলো নতুন কারো জন্য। সেটা হয়নি ঘরের বাকিদের প্রাণখোলা আচরণের জন্য। শাওকী ভাইকে নিয়ে কিছু লিখলেই বকা খেতে হবে, সুপারস্টার রাকিব ব্রো’কে নিয়ে কিছু বলা আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। আর মাসুম ভাই যেহেতু গাজী বাবার এক ছোঁয়া দিয়ে সর্বনাশ করে ফেলতে পারেন, ওনাকে এসবে না টানাই ভালো।
০৩। এবং শেষ কথাঃ ফ্যান্টাসি আর থ্রিলারের মোড়কে কারাগার ওয়েব-সিরিজ কিন্তু কথা বলেছে আমাদের ইতিহাসের একটা অনালোচিত জায়গা নিয়ে। সেটার কতটুকু কী অর্জন করা গেলো, সেইসব হিসাব অন্যদের জন্য থাক; কিন্তু ওয়েব-সিরিজের চিত্রনাট্যের টেবিলে প্রথম অভিজ্ঞতার সাথে এই ইতিহাস-সচেতনতার ব্যাপারটা আমার কাছে ব্যক্তিগত ভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। একদিনও শুটিং-এ যেতে না পারার অপরাধবোধও সেই স্মৃতির ওজন কমাতে পারবে না।
… ‘কারাগার’ অচিরেই আসছে হইচই বাংলাদেশ-এ। আশা করি দর্শকদের সেটা পছন্দ হবে।
৭ জুন
কুয়োর ভেতর থেকে হঠাৎ কথা বলে ওঠা কোনো লাশ, কৌতূহলে সুহান গলা বাড়িয়ে দেয় আন্তঃনগর ট্রেনের কু-ঝিকঝিক থেকে। শুরু হয় লোকটার সাথে এক আশ্চর্য ভ্রমণ।
কোথায় নেই মানুষটা?
মোহাম্মদপুরের ছকে কাটা চৌকো রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে টের পাই, যেন চিহাঙ্গীর স্ট্রিটে গালিবের ছায়াসঙ্গী হয়ে আমি আর সে হেঁটে যাচ্ছি নীরবে। নর্থ এন্ডের কোনার টেবিলে একলা আমি আর ল্যাপটপ, সৈয়দ হক খানিক পরে উঠে গেলেও ওই এলোমেলো লোকটা নীরবে আমাকে সঙ্গ দিয়ে যায় বহুক্ষণ। ধুলোমলিন নীলক্ষেতের কৈশোরের স্মৃতিতে, মাগরিবের আযানে রিকশার জ্যামে বসে থেকে, প্যাস্ট্রির মতো কাটা-কাটা আলোর সুধী সমাবেশে ভিড়ের মাঝে একলা হয়ে অনুভব করি, আমার ঢাকা হয়ে গেছে তার শহর।
অনেকেই লেখেন, কিন্তু সত্যিকারের বড় প্রশ্নের মুখে দাঁড়ানোর সময় পাঠকের পাশে থাকেন অল্প কিছু লেখক।
ভোরের বারান্দা কিংবা বেইলি রোডের একলা বিকালে সব কিছু যখন চোখে ঢুকে কিন্তু গড়িয়ে পড়ে যায় কোথাও, রায়ের বাজারের যানজট কিংবা সরকারি ব্যাংকের লাইনে অবিরাম থাপ্পড় খেতে খেতে যখন ইচ্ছে করে নৃশংস কোনো খুন করতে, মানিক পড়তে গিয়ে যখন বইয়ের পাতা বন্ধ করে সামনের সাদা দেয়াল দেখি চুপচাপ; তখন – এবং আরো অনেক মুহুর্তেই – মনে হয়, কেন যে লিখি। পেছনে দাঁড়িয়ে তিনি তখন ফিসফিসিয়ে মনে করানঃ “লিখি, কারণ দরজা বন্ধ করে একা-একা বসে থাকতে আমাদের ভাল লাগে।”
‘পদতলে চমকায় মাটি’ লিখতে গিয়ে, যখন পায়ের তলায় দ্বিধা হয় যে প্রচ্ছন্ন পরাজয়ের এই গল্প বলা উচিৎ কি না আমার; আনাতোলিয়ার কোনো আদালতের কাঠগড়া থেকে তিনি সাহস দিয়ে যানঃ “ইতিহাসের দায় আমাদের নিতেই হবে, নিজের কথা থেকে আমি সরবো না, এবং কথা বলার অধিকারের পক্ষে আমি আরো শক্ত হয়ে দাঁড়াবো।”
তারও পরে, যখন বড় এক সিদ্ধান্তের মুখে দাঁড়িয়ে চরকির মতো দেখি চারপাশে ঘুরছে এইসব মা-বাবার মুখ আর এইসব প্রথা, এইসব রুঢ় সমাজবাস্তবতা আর ঘুপচি ফ্ল্যাটবাড়ি, এইসব ল্যাংড়া-ল্যাংড়া উপন্যাস আর ফেসবুক লেখালেখির কুতকুত খেলা, এইসব নৃশংস নিমতলি-সীতাকুন্ড আর আর কুত্তার বাচ্চায় ভরে থাকা শহর; টের পাই, আমার মুখ দিয়ে কথা বলে ওঠেন ওই মানুষটাইঃ “চাকরি – হোক সরকারি আর মোটা বেতনের- আমি করতে চাই না। আমি উপন্যাস লিখতে চাই।”
শুভ জন্মদিন অরহান। আমার সৌরজগতে উপন্যাস নামক গ্রহের সবচেয়ে বড় জীবিত নক্ষত্রটা আপনি। আপনি কখনোই জানবেন নাঃ ‘I read a book one day, and my whole life was changed.’
২৬ এপ্রিল
বহু দিন পর, মাকোন্দোর প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে সুহান রিজওয়ানের মনে পড়ে যায় সেই সুদূর সন্ধ্যা, যেদিন প্রথমবার গার্সিয়া মার্কেজের সাথে শতবর্ষের পুরোনো এক নিঃসঙ্গতা সে আবিষ্কার করেছিলো।
‘বহু বছর’ বলা গেলো না, কারণ ১৭ বছরের দূরত্বকে সেই নামে ডাকা যায় কিনা তা নিশ্চিত বলতে পারি না আজ। জগৎ নিয়ে এমন অনিশ্চয়তা আমাকে অধিকার করে রেখেছিলো আমার সেই কলেজ দিনেও। কিন্তু, বলতে পারি নিশ্চিত, তখনও-সহনীয়-যানজটের ঢাকার দিনগুলো ছিলো আজকের চেয়ে অনেকটা রঙিন, কলেজপড়ুয়া মেয়েদের ইউনিফর্মের মতোই। আমি জানতাম মেট্রো লিংকের বাসের টিকেটগুলো সাদায় লাল মেশানো, নটরডেমের করিডোরের আভা সবুজ, আর রসায়নের লবণ মেলানোর খেলায় ব্লু ভিট্রিওল কি সবুজ সালফেট আমি ভুল করবো না। নীলক্ষেতের ফুটপাথ থেকে নেয়া মার্কেজের এই উপন্যাস প্রথম পাঠ করি আমি তখনই।
কিন্তু আজ বুঝে উঠি না, কেন সেই সময়ের অন্যসব স্মৃতি ঝাপসা হয়ে কেবল ব্যুনসেন বার্নারের ওপরে সবুজ সালফেটের দানাই খোঁচা মারছে আমায়। অবশ্য অভূতপূর্ব এই উপন্যাস আমার স্মৃতিতে প্রকৃতই ঝাপসা। আমি কেবল মনে রাখতে পেরেছি রেনেতা রেমেদিওসের প্রেমের দৃশ্যে সবকিছু দখল নেওয়া সেই হলদে প্রজাপতির ঝাঁক আর ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে হোসে আর্কাদিওর সেই মৃত্যুদৃশ্য। ও হ্যাঁ, পত্রিকা কি টুকরো আলাপে বারবার পড়ার কারণে- অবিরাম ইনসোমনিয়ায় ভর করে যেই ভুলে যাওয়ার মহামারি নেমে এসেছিলো মাকোন্দো গ্রামে, সেটাকেও আমি মনে রেখেছি। একইভাবে মনে রেখেছি কলা-শ্রমিকদের ওপর সেই নির্বিচারে গুলিও চালানোটাও।
আলোচ্য উপন্যাস আমাকে হতাশ করেনি ঠিকই, সেটাকে আমি দারুণ উপভোগও করেছি ১৭ বছর আগে, কিন্তু দুনিয়ার-সমস্ত-কিছু-সম্পর্কে-নিশ্চিত-আর-সব-কলেজপড়ুয়া-মূর্খের মতোই, সেকালে আমি এই ধারণা পোষণ করি যে ‘জেনারেল ইন হিজ ল্যাবিরিন্থ’টাই মার্কেজের ম্যাগনাম ওপাস- যেটা তার কাজের মাঝে আমার প্রিয়তম।
তারপর, বহু বছর পর, যখন তিনটা ল্যাংড়া উপন্যাস লিখে ফেলা সুহান একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনুভব করে নতুন উপন্যাস-প্রচেষ্টায় একটা শব্দও লেখার সামর্থ্য নাই তার, কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার সাথে ৩২টা যুদ্ধ হারবার সেই গ্লানি আবিষ্কারের জন্য সে তখন আবার ফিরে যায় মাকোন্দো গ্রামে। কর্নেলের মতোই সে অনুভব করেঃ “… His only happy moments, since that remote afternoon when his father had taken him to see ice, had taken place in his silver workshop where he passed the time putting little gold fishes together. He had had to start thirty-two wars and had had to violate all of his pacts with death…”
আর তখন সে বুঝে নেয়, তার প্রথম তারুণ্যের আর দুই-দশকের-পুরাতন ঢাকার মতোই মার্কেজের স্মৃতিও ভরে আছে শৈশবের রঙে আর ঘ্রাণে; এই উপন্যাস সেই স্মৃতির কাছে গ্যাবোর ব্যক্তিগত নতি স্বীকার ছাড়া আর কিছু নয়। সুহান অনুভব করে, প্রেম কি মৃত্যুর ওসব যাদুকরী দৃশ্যের আড়ালে তো প্রথম পাঠে আসলে হারিয়ে গেছে মার্কেজের এই ম্যাগনাম ওপাসের সত্যিকারের চাবিকাঠি, জিপসি মেলকিয়াদেসের সেই পার্চমেন্ট, যা আমাদের বলবে প্রতিটি আউরেলিয়ানোর জন্ম হয় ৩২ যুদ্ধ জয়ের আশাবাদ নিয়ে; কিন্তু সময় শালা এমন বৃত্তাকার- যে নিয়তির কাছে মানুষকে পরাজয় বহন করতেই হয়।
১৭ বছরের অবসরে গিজগিজ করা ধূলাবালিতে গা চটচট করে ঠিকই, কিন্তু এমন ভয়ঙ্কর সুন্দর উপন্যাসকে পুনরাবিষ্কার করবার জন্য সেই ধুলো গায়ে মাখতে সুহানের আজ আর আটকায় না।
পুনশ্চঃ বিশেষ ধন্যবাদ এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানো’কে, তার ‘মেমোরি অফ ফায়ার’ ট্রিলোজির কয়েকটা বাক্যই আমাকে আবার ফিরিয়ে আনলো এই উপন্যাসে। কেবল সত্যিকারের বড় লেখকেরাই এভাবে পারেন আলতো ইঙ্গিতে আমাদের অন্য কোনো বড় লেখকের দিকে নিয়ে যেতে।
২২ এপ্রিল
১৯২৯/ গার্সিয়া মার্কেজ
“শুরু হলো আহত আর লুকিয়ে থাকাদের খোঁজ। খরগোশের মতো তাদের তাড়িয়ে আনা হলো আর জালে আটকানো মাছের মতো আটকানো হলো স্টেশনে। একরাতেই মোট ১২০ জন ধৃত। গভীর রাতে সৈন্যরা ঘুম থেকে পাদ্রীকে ডেকে তুললো কবরখানার চাবির জন্য। ঘুমের কাপড় পরে থাকা পাদ্রী লোকটা কাঁপতে কাঁপতেই শুনতে পেলো আটকদের ওপর গুলির শব্দ।
অদূরেই কোনো খাটের তলায় ভয়ে ফোঁপাতে থাকা ছোট্ট ছেলেটাও শুনলো সেই আওয়াজ।
বছরের পর বছর চলে যাবে, একদিন এই ছেলেটা পৃথিবীকে জানাবে এমন এক জনপদের গোপন কথা, যারা আক্রান্ত হয়েছিলো এমন মহামারিতে যে সমস্ত জিনিসের নাম তারা ভুলে গিয়েছিলো। ছেলেটা তুলে আনবে সেই ইতিহাস যে কীভাবে শ্রমিকদের গুলি করা হয়েছিলো, আর কীভাবে বড়মা সমস্ত প্রাণ আর খামারের সাথে সাথে বৃষ্টিরও মালিক- যে বৃষ্টি আগেও পড়েছে আর সামনেও পড়বে, আর কীভাবে বৃষ্টির অবিরাম পতনের মাঝে সুন্দরী রেমেদিউস চলে যাবে স্বর্গে।”
১৯৫০ / মেরিলিন
“রিটার মতো এই মেয়েটাকেও ঠিকঠাক করা হলো। তার চোখের পাতা ছিলো ভারি, সাথে মোটা নাক, বড় দাঁত। চর্বি ফেলে হলিউড তাকে করলো টানটান, দাঁতের গর্ত ভরাট হলো, চেস্টনাটের মতো চুলগুলো করা হলো চোখ ধাঁধানো সোনালি। এই কারিগরেরাই তাকে ব্যাপ্টাইজড করালো নতুন নামে, আর তার জন্য তৈরি করা হলো এমন একটা ফালতু শৈশব- যার গল্প সে নিজেই সাংবাদিকদের বলবে।
তৃতীয়-শ্রেণির কোনো সিনেমায় দ্বিতীয়-সারির কোনো চরিত্রের জন্য হলিউড প্রস্তুতকৃত এই সুন্দরীকে আর কারো শয্যায় উঠতে হয়নি এরপর। তাকে আর কাঁপতে হয়নি শীতে, বাঁচতে হয়নি হটডগ আর কফির ওপর। এখন সে মহাতারকা; কিংবা মুখোশের আড়ালে থাকা একটা ছোট্ট মানুষ, যে মনে করতে চেয়েছে- কিন্তু পারেনি- সেই মুহুর্তটা, যখন সে কেবল একাকীত্ব থেকে বাঁচতে চেয়েছিলো।”
১৯৫৭ / চে
“হোমব্রিতো উপত্যকায় বিদ্রোহীদের সম্বল বলতে আছে রুটি সেঁকার একটা চুলা, প্রিন্ট করার জন্য একটা পুরোনো মিমোগ্রাফ যন্ত্র আর হাসপাতাল হিসেবে কাজ করা একটা কুঁড়েঘর। ডাক্তারের নাম আর্নেস্তো গুয়েভারা, লোকটার মাঝে এখনো কিছু আর্জেন্টাইন ব্যাপার থেকেই গেছে, যেমন তার রসিকতা। ফিদেলের বাহিনিতে লোকটা যোগ দিয়েছে মেক্সিকোতে, তারও আগে- পতনের আগ পর্যন্ত সে ছিলো গুয়াতেমালায়; সেখানে সে প্রতি ছবি এক পেসো দামে ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করতো আর কাঠের মাঝে খোদাই করতো দেবীমূর্তি।
গত বছর, যখন মেশিনগানের গুলি ছেঁটে ফেলছিলো সদ্য প্রশিক্ষিত বিদ্রোহী গেরিলাদের, পালানোর সময় গুলির বাক্স আর ওষুধের বাক্সের মাঝে ডাক্তারকে তখন বেছে নিতে হয়েছিলো কেবল একটা, দুটোই বয়ে নেবার সামর্থ্য তার ছিলো না। এখন সে অবসরে নিজের একমাত্র সার্জিকাল যন্ত্র- একটা পুরোনো থমসন রাইফেলে হাত বোলায়।”
– – – The Memory of Fire Trilogy / এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানো
১৭ মার্চ
‘আরে না, দীঘির জলে… দীঘির জলে কার ছায়া গো!’ চিৎকারে মেয়েটি চারপাশ সচকিত করে তোলে ঠিকই, কিন্তু বইমেলার জনসমাবেশে কল-ড্রপের আধিক্যে তার এই বিশেষ্য কিংবা প্রশ্নবোধক শব্দেরা ফোনের ওইপারে পৌছায় না। ফলে মেয়েটির মন এমন খারাপ হয়, যে কারাগারের রোজনামচার খাঁচায় ঢুকে বঙ্গবন্ধুর সাথে কারাবরণে প্রস্তুত ও ছবি-তুলতে-আগ্রহী মানুষেরা মুহুর্তের জন্য ম্লান হয়ে পড়ে।
এদিকের অটোগ্রাফ দিতে ব্যাকুল লেখকদের কাছ থেকে পালিয়ে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনিস্টিউটের দিকে সরে পড়লে একেকটা বোর্ডে সাজানো আছে গুণী লেখকদের ছবি ও উদ্ধৃতি। ফটকের পাশে বলে জসীমউদ্দিন, শওকত আলী, বিদ্যাসাগর তো বটেই- এমনকি মীর মোশাররফ হোসেনের সামনে পর্যন্ত লোকে দুজনে বা সপরিবারে ছবি তোলে। পজিশনটা ভালো না বলে এ যুগের ক্যুল ড্যুড জীবনানন্দকে আজ বড্ড একাকী লাগে।
বেরিয়ে এসে সবুজ ও লাল আলোয় ভরপুর শহরের মাঝে শর্টকাট খুঁজে নিয়ে ঢুকে পড়ি রমনায়, সেই রমনা, ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডজের হাতে যার সূচনা। যুধিষ্ঠিরের মতোই, অনেকক্ষণ আমাকে একাকী সঙ্গ দেয় একটি কুকুর। দুইদিকে বৃক্ষশোভিত এই নির্জন পথের দিকে চাইলে বহু আগে পড়া প্রমথনাথ বিশীর শান্তিনিকেতনের বর্ণনা থেকে একটি স্কেচ উঠে এসে আমায় বিব্রত করে।
পা চালিয়ে তবুও এগোই। রেনবার্গারের সোলের তলায় পিষ্ট হয় পুরোনো প্রেমিকা সেই ঢাকা শহর। সে বুড়িয়ে যাচ্ছে, আমিও আর তরুণ হচ্ছি না।
০২ মার্চ
বইমেলা নয়, ওদের সমস্ত ক্লান্তিকর ইঁদুর দৌড়কে অগ্রাহ্য করতে বরং ধানমন্ডি লেক। বন্ধুদের সিগারেট থেকে ধোঁয়া ওড়ে, পেছনের হ্রদ থেকে হঠাৎ বাতাস বইলে সোনালি তুষার হয়ে মাথার ওপর ঝরে যায় হলুদ পাতা। ঝরতে ঝরতে প্রশ্ন ছোঁড়ে, ‘কী তুমি ভালোবাসো হেঁয়ালি মানুষ, আমায় বলো?’
উত্তর জানা নেই বলে হাত পেতে দেই মারিসা কন্ডের কাছে। কিন্তু ক্যারিবিয়ানের সমুদ্র নীরব থাকে। বরং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বাড়ির দরজায় এসে কপাল মুছতে মুছতে মহাশ্বেতা দেবী বলেন, ‘ভায়োলেন্স আমার কাছে পবিত্র, ভায়োলেন্স সূর্যের মতো, ভায়োলেন্স জ্বলে’। জবাবে ‘লাস্ট নাইট ইন সোহো’র পর্দা থেকে উঠে এসে সুরেলা প্রতিবাদ করে পিটার এন্ড গর্ডনঃ I dont care what they say, I won’t stay in a world without love ♪ ♫ ♬
কিন্তু ভালোবাসাহীন পৃথিবীতে থাকতে বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই পুতিন সাহেবের। ফলে একটু একটু আফগানিস্তানের ক্রিকেট, কয়েক ফোঁটা সড়কে পাঁচ ভাই, অল্পস্বল্প নির্বাচন কমিশনারও মুছে গেলো। মুছে গেলো শ্রেণীবিদ্যা নিয়ে আঁতলামি করা উমবার্তো একো, উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন চীনের প্রাচীরের ওইপারে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা লিউ-সিশিন। তবু নজর কাড়লো টিসিবির নায্যমূল্যের লাইনে সপরিবারে দাঁড়িয়ে থাকা উৎপলকুমারের ওই হাভাতে ক্লাউন, দুঃখের দিনেও সবাইকে না হাসিয়ে সে ছাড়বে না।
হলদে পাতার ফিল্মি দুপুরে আরামপ্রিয় চোখ ধানমন্ডি লেকের ধারে তবু খুঁজে যায় পুরোনো নায়িকা। অরহান পামুক নামের পুরোনো ইনসোমনিয়া ফিরে ফিরে এসে কেবল বলে, ‘কেন তুমি লেখো হেঁয়ালি মানুষ, আমায় বলো?’
১৩ জানুয়ারি
‘না, না, তার কথা আর নয়, সেই
বেরিয়েছে সকাল বেলায় সে তো- শহীদ কাদরী বাড়ি নেই।’
কিন্তু শহীদ কাদরী তো নয়, খোঁজ করছিলাম আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের।
দুই অগ্রজ ইমতিয়ার শামীম আর প্রশান্ত মৃধার সাথে দুপুরে ফোনালাপ হলো ঠিকই, তবে মোহাম্মদপুরের এইসব আয়তক্ষেত্র গলির মাঝে লোকটাকে বিকালে হারিয়ে ফেললাম। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলে পাতলা কুয়াশা, তার মাঝে রিকশা দিয়ে লোকটাকে খুঁজতে খুঁজতে যাই। পোস্টারে শোভিত নেতা আছে, দেয়ালে চিকা মারা মেধাকুঞ্জ কোচিং এর বিজ্ঞাপণ আছে, শারীরিক শিক্ষা কলেজের সামনে নিয়ন আলোতে ‘কারিগরি শিক্ষাই জাতির উন্নয়নের মূল শক্তি’ মার্কা ইউনিভার্সাল ট্রুথ পর্যন্ত দেখা যায়; কিন্তু ইলিয়াস কোথায়?
তখন মনে হয়, ইলিয়াসের খোঁজ করি, অথচ আবার করি না।
২৭ নাম্বারের চৌরাস্তা ফাঁকা, স্লিভলেস আলো সেখানে এমন মোহনীয়, যে রবীন্দ্রনাথ পারলে আজ শান্তিনিকেতনের ক্লাস পর্যন্ত নেবে। তবে যা খুঁজি তা পাই না। আরেকটু এগোলে কমিক ক্যাফে, গ্লোরিয়া জিনসের ঝলমলে আলোতে এমন প্যাঁচ লাগে; যে রিকশা ঢুকে পড়ে শাখাগলিতে। মরিয়া হয়ে বাড়ির নামে খোঁজ করি। ড্রিম ভ্যালি আছে, শাহজাহান ম্যানর আছে, অধ্যাপক মবিন খান (অবঃ) পর্যন্ত আছে; কিন্তু কী খুঁজছি- তা পাই না।
চিরতরুণ ভার্গাস ইয়োসা ৮৫ বছর বয়েসে আবার ঝাঁপিয়ে পড়লেন গুয়াতেমালার অভিযানে, হোয়াকিন ফোনিক্স প্রস্তুত আবারও মুগ্ধ করতে, কোথায় কারা যেন মারা যাচ্ছে। অনুভব করি, এইসব সন্ধ্যায় উৎপলকুমার বসুর মতোই আমারও ভুল আবিষ্কার – ভুল ধূপাগার- ভুল পুস্করিনী- ভুল দেবদারু- ততোধিক ভুল স্মৃতি। তবু কী খুঁজি নিরুদ্দেশ যাত্রায়? কী খুঁজছি?
‘আম্মার ঘরে কী যেন ফেলে এসেছি।’