১৯ নভেম্বর, ২০২১
আঠারো শতকের ফ্রান্সে ব্যাপারটার ভালোই চল ছিলো। নাটকের টিকেট কিনে মঞ্চের সামনে নয়- টাকাপয়সা একটু বেশি খরচ করলে রীতিমতো মঞ্চের ওপরেই জায়গা করে নিতে পারতেন দর্শক। এমন ঘটনা তাই প্রায়ই হতো, যেখানে মঞ্চের ওপরেই ভিড়ে গাদাগাদি করছে দর্শকেরা।
ভলতেয়ারের সেরামিস নাটকের এক দৃশ্যে, শোনা যায়, মঞ্চের ওপর এমন এমন ভিড় হলো, যে টানটান উত্তেজনার এক মুহুর্তে এক অভিনেতা হোঁচট খেয়ে পড়েই যাচ্ছিলো আরেকটু হলে।
দর্শকের এলোমেলো হাসিকে ছাপিয়ে শোনা গিয়েছিলো ভলতেয়ারের তীব্র আকুতি, ‘ভাই সব, দয়া করে পেছনে সরে যান! পেছনে সরুন! অন্ততঃ ছায়াগুলোকে জায়গা দিন।’
… অনুভব করি, অনলাইনের দারুণ এই হট্টগোলের মাঝে আমাদের অক্ষরের দশা, সেই ভিড়ের মাঝে হোঁচট খাওয়া অভিনেতার মতোই। কানের কাছে উঠে আসছে জনতা, তীব্র ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তারা খুঁটিয়ে নজর করছে সমস্ত বাক্য, বাতিল করে দিচ্ছে অভিনেতাদের, শোরগোলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে লেখকের বক্তব্য। ছায়ারও জায়গা লাগে, ঠিক যেমন লেখকের লাগে নীরবতা।
নাট্যকার আকুতি করে যাচ্ছেন, জনতা হেসে যাচ্ছে। আমরা হাসছি, নাটক নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু ছায়ারা জায়গা পাচ্ছে না।
১৫ নভেম্বর, ২০২১
বিদায় হাসান।
আপনি ছিলেন তাই করবী গাছের ছায়ায় রাঢ় বঙ্গের অনেকটুকু ঢেকে ছিলো। আপনি ছিলেন তাই পাওয়া গেলো আগুনপাখির সাক্ষাৎকার। আপনি ছিলেন বলেই নিরাবেগ কলাপাতার মতো ভাসমান হয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের মৃতরা হয়ে উঠেছিলো নামহীন গোত্রহীন ।
১৩ নভেম্বর, ২০২১
সমস্ত মহৎ লেখকদের মতোই হুমায়ূন আহমেদের নিজস্ব একটা জগৎ ছিলো; এবং সমস্ত মহৎ লেখকদের মতোই, সে জগতকে তিনি পাঠকেরও করে তুলতে পারতেন।
সেই অভূতপূর্ব জগতে আশ্চর্যভাবে মিশে যায় বরফের দেশে লিসবেথ নামের বুড়ির উচ্চস্বরে কাঁদা আর মুক্তিযুদ্ধে পা হারানো মজিদের মার নিচুস্বরের কান্না; সেই জগতে মফস্বলের কোনো লেখকের বই ছাপানোর সুখ মিলে যায় একটি নীল বোতামের দুঃখের সাথে। দুরন্ত নেটফ্লিক্স আর হাইপারটেক্সট ফিকশনে অভ্যস্ত একবিংশ শতাব্দীর মন তখন কল্পনার সাদাগাড়িতে বসে ক্রমাগত ভাবে গ্রিন বয়েজ ফুটবল ক্লাবের নান্টু এতো সুখী কেন?
তবুও ভালোবাসার হুমায়ূন আহমেদকে অবিরাম বকতে গেলে- অনেকটা লিওনেল মেসির ক্যারিয়ার আর ঢাকা শহরের রাস্তার মতোই- কোথায় কিছু যেন বাদ পড়ে যায়। অনাবশ্যক সেই অপূর্ণতার অনুভূতি কিছুতেই শান্তি দেয় না।
উত্তর খুঁজতে যেয়ে হাত দিয়েছিলাম একটা লেখায়। অন্য অনেক কিছুর মতোই, সেটা আজও অসমাপ্ত রয়ে গেছে। কারণ লিখতে বসলেই হুমায়ূনের গল্পসমগ্রে চোখ বুলানো হয়, এবং প্রতিবারের মতোই সেখানে ডুবে যেতে হয়। আশা রাখি, ‘হুমায়ূন আহমেদের ফ্রেঞ্চ টোস্ট’ শিরোনামের সেই লেখা শেষ হবে কোনোদিন।
২১ অক্টোবর, ২০২১
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় একবার একটা ইটখোলা করেছিলেন। দেখলেন, ইটখোলার কিছুই ফেলা যায় না। ঝামা ভেঙে খোয়া। ছাই হয়ে যায় গাঁথুনির মশলা। পৃথিবীর খানিকটা কেটে নিয়ে তাই দিয়ে পৃথিবীর গায়ে বাড়ি।
এক একটা দিন এই জনপদে আজ স্কুইড গেমস। ক্রিকেটে বিজয়, পাপুয়া নিউগিনির কাছে এলিমিনেটেড পীরগঞ্জ। ইকবাল হোসেনের দোষ আছে কি নেই, তা নিয়ে জমজমাটি কোর্ট ড্রামা। অভ্র কিংবা রিদমিক চাপা দেশ বিদেশের সমবেত ভদ্রমহোদয়গণ তত্ত্ব দিয়ে যায়। চমস্কি না হোক, মুহম্মদ জাফর ইকবালের নিচে তাদের নামানো মুশকিল। বুঝি, আবার বুঝিও না। একমত হই, আবার হতেও পারি না।
কে হায় যানজটের মাঝে সুকুমার রায় পড়তে ভালোবাসে! প্রতিদিন যত্ন করে ছবি আপলোড না করলে প্রকৃত মানুষ উবে যায়। স্ক্রল করতে থাকাটা অনেকটা রাইড শেয়ারের বাইকে চেপে চিপা গলিতে উল্টো দিক থেকে আসা রিকশার মাঝে সেঁধিয়ে যাবার মতো। দূরে কোথাও তিস্তায় বন্যার খবর। পাবলো নেরুদা প্রশ্ন করে যায়। ইতালো কালভিনো কি তিন রঙের ছিলেন? বেঁচে থাকলে কী সিনেমা বানাতেন জহির রায়হান? সুহানের চেয়ে অথর্ব আর কী আছে দুনিয়ায়? কিছুই ফেলা যায় না। দূর থেকে ইটখোলার গর্ত আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে।
৬ অক্টোবর, ২০২১
শব্দই চিকিৎসিত করে।
কিন্তু যা খোঁজে, সুহানের সেই শব্দ কোথায়? মেট্রোরেলের ঠাপে অচেনা ফার্মগেটে বৃষ্টির জন্য মাথা বাঁচাতে কোথাও আশ্রয় নিলে হঠাৎ শোনা বজ্রপাত, কলাবাগানের গলিতে অমোচনীয় যানজটের মাঝে পাঠাও বাইকারের অশ্রাব্য গালিগালাজ, এইসব ইউটিউব দিনে গেইম অফ ড্রাগনসের আবহসঙ্গীত; এরা আর শব্দ হয়ে উঠলো কখন?
তলস্তয় বলছেন শৈশবে ভাইয়ের সাথে পিঁপড়া-মাটি খেলবার স্মৃতি, নতুন স্বরে ইতিহাস বাতলাচ্ছে নতুন হিরো কাপুচিনস্কি, অমিয়ভূষণ উপন্যাস লেখার কায়দা নিয়ে বকতে গিয়ে বেশ ট্রমা-মুখর হয়ে উঠেছে, নেইল গেইম্যান প্রবন্ধ খারাপ লেখে না,কাপু উ-সেনকে মারতে আবার সঙ্গী হয়েছে মাসুদ রানা। এইসব কোলাহলে সুহানের নিজের শব্দ কোথায়?
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার, উটের গ্রীবার মতো স্পষ্ট সংশয়।
” Because they wouldn’t understand this book that was becoming steadily stranger, because they would measure it against traditional novels, because it was hard to understand, because they would point to the book’s more obscure parts to prove it a failure, and also, perhaps, because I was never going to finish it; I’d written the wrong book. “
১২ আগস্ট, ২০২১
তৃতীয় উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত হয়ে গেলো। আবিষ্কার করি, আনন্দ নয়, বরং জাপটে ধরে অবসাদ। সেই অবসাদ, গ্যুন্টার গ্রাস যাকে লেখকের জন্য অবশ্যম্ভাবী বলেছিলেন কোনো উপন্যাস লিখে ফেলার পরে- যদি সত্যিই লেখক তার সবটুকু দিয়ে উপন্যাসটা লেখে।
দু’হাজার উনিশের যে পৃথিবীতে পরিকল্পনা করে অল্পস্বল্প কাজ শুরু হয়েছিলো এই উপন্যাসের, পেছনে তাকিয়ে দেখি, ডিয়েগো ম্যারাডোনার মতোই সে এখন আর দৃশ্যপটে নেই। সূর্যের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে দুনিয়া চেপেছে আরো ডানে, পেগাসাস নামের গোপন তন্ত্র সাধনা আর ইনফ্লুয়েন্সারের ইনসুলিনে গুঁড়িয়ে গেছে ব্যক্তির নিজস্ব বুদবুদ। অনুভূতিপ্রবণের চাইতে অনুভূতিজর্জর এই দুনিয়ায় উপন্যাস লিখে যাওয়া তাই ইলিয়াসের ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ গল্পের রঞ্জুর সেই অকারণ অজুহাত, ‘আম্মার ঘরে কী যেন ফেলে এসেছি!’
কী ফেলে এসেছে, ঔপন্যাসিক তা জানে না, তবু ‘মিনারি’ সিনেমার অমার্জিত সেই কোরিয়ান বৃদ্ধা হয়ে সে অবাস্তব কোনো আশায় ভর করে রোপণ করে যায় অক্ষরের চারাগাছ।
এই উপন্যাস প্রচেষ্টা এগিয়ে গেছে বহু সুহৃদের সাথে অবিরাম আলাপের মধ্য দিয়ে। মনে আসছে জিল্লুর রহমান সোহাগ, রাশেদ মোশাররেফ, সার্থক রহমান, পিয়্যান মুগ্ধ নবী, আজকা ঈশিতার কথা। সময় নিয়ে পাণ্ডুলিপির বিভিন্ন অংশ পড়ে কৃতার্থ করেছেন তারেক নুরুল হাসান, যুবায়ের মাহবুব, রওশন জামিল, ফুয়াদ নাসের, রজত শুভ্র পার্থ, প্রিতম ঘুম, রিফাত আলম।
শুধু বুঝে উঠতে পারি না যে পাণ্ডুলিপি প্রসঙ্গে কী বলবো। এ কি পলিটিকাল থ্রিলার? স্পেকুলেটিভ ঘরানার ডিস্টোপিয়া? নাকি আঙ্গিক পরীক্ষা দেখবার সেই ভুগিচুগি পোস্টমর্ডান ধারার কিছু?
কিন্তু বর্ণিত প্রতিটি ঘরানাতেই কৃতিত্বের সাথে ফেল করবার বিষয়ে আমি নিশ্চিত যেহেতু, আপাতত তাই এটুকুই বলিঃ এই কাহিনি এমন কোনো সুহানের, যে উপন্যাস লিখতে চায়; অথচ এই কাহিনি লিখেছে এমন সুহান, যে উপন্যাস লিখতেই জানে না।
৩০ জুন, ২০২১
বন্ধুর জন্মদিনের সন্ধ্যার গতিপ্রকৃতি তখনও বোঝা যায়নি।
তখনও বলতে, আরোপ করা শাটডাউনের ভয়ে জরুরী একটা বই বাগাতে ধানমন্ডি চলে যাবার পরেও নয়। হঠাৎ হাজির সোহাগ গিটার নিয়ে ট্যাং ট্যাং করে দুয়েকটা গান শোনালে মুগ্ধ হবার অভিনয় করতে হয় ঠিকই, কিন্তু বাড়ি ফেরার তাড়া ভেতরে ক্রমাগত চুলকায়। বের হতে গিয়ে আবার আন্টির আহবান। রিশাদের-যাকে তিনি নিজেও ডন বলে ডাকেন- জন্মদিন উপলক্ষে প্রচুর ভালোমন্দ রান্না হয়েছে, সেগুলোর সদগতি আমরা ছাড়া আর কে করবে? প্রচুর পরিশ্রমের পর আমি ডন শালাকে কিছু না দেয়ার অপরাধবোধটা উড়িয়ে দেই দুই টাকার সেন্টারফ্রেশ উপহার দিয়ে।
এবং তারপর বেরোনো মাত্রই বৃষ্টি। রিকশাওয়ালাদের নবাবজাদা বলে যে খানিক গালি দেবো, সেটাও হয় না আজ, প্রথম রিকশাটাই রাজি। আশ্চর্য!
এই রাত কি আজকের? এই রাত তো সেই কবে ইংরেজ সাহেব ওয়াল্টারের তত্ত্বাবধানে তৈরি হওয়া ধোলাইখালের লোহার পুলে নেমে এসেছিলো মেঘের ঘনঘটা আর বজ্রপাত নিয়ে, যখন প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখে ফেলেছিলেন ‘হয়তো’ নামের এক অনন্য গল্প। আজ আর লোহারপুল নেই, প্রেমেন মিত্তিরও নয়, কিন্তু থেকে গেছে ঢাকার রাস্তার অজস্র গল্প।
সমস্ত দোকানের ঝাঁপ ফেলা সারা, তার মাঝে অন্ধকার গলিপথে ঢুকে পড়লে কালো ছাতা সমেত কালো বোরখায় আবৃত মহিলাটিকে রীতিমতো অশরীরী দেখায়। ভয়টা অবশ্য দ্রুত কাটে, যখন কয়েক মিটার পরপর যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা দালানের সিঁড়ি ঘরে আশ্রয় নেওয়া মানুষের মাঝে প্রতিবারই খুঁজে পাই ফুডপান্ডার ডেলিভারিম্যান। তারা, এবং বৃষ্টি থেকে বাঁচতে তৎপর অন্যেরা; মোবাইল টেপে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবং রিকশা-চড়া-ভাগ্যবান আমাকে ঈর্ষা করে মনে মনে।
ডাচ টিভিতে ব্যালে নর্তকীর পায়ের ছন্দের সাথে মিলিয়ে ফন বাস্তেনের ড্রিবলিং দেখানো হয়েছিলো একবার, ছপছপ জলের মাঝে তেমনই ফুটবল কারিকুরি দেখিয়ে ছুটে যায় কোনো কিশোর। নটরডেমের ডায়াস থেকে প্রক্সি ক্লাস নিতে আসা সেই শিক্ষক উঠে আসে ইস্টার্ন প্লাজার চাতালে আশ্রিতদের মাঝে, বিষণ্ণ ডগি শুয়ে থাকে বন্ধ লরির নিচে। বিপরীত থেকে ছুটে আসা গাড়ির হেডলাইটের টুকরো আলো হয়ে ওঠে নামী রেস্তোরাঁয় সাজানো পেস্ট্রির মতো ঝলমলে, বৃষ্টির ছাঁটে চোখে কীসের যেন পানি।
এইসব রাতে শব্দমালা বৃষ্টিভেজা বিব্রত কাক। এইসব রাতে চেনা কোনো অক্ষাংশ এবং দ্রাঘিমাংশে ফিরতে থাকা সুহানের কাছে ঢাকা হয়ে ওঠে সাবটাইটেল-হীন বিদেশি ছবির মতো অচেনা। এইসব রাতে এমনকি চেনা পথেও ঢাকা ফিসফিস করে অচেনা স্বরে সুহানকে বলে যায় জলের ভেতর সেই অগ্নির মানে।
২৮ এপ্রিল, ২০২১
চলতি উপন্যাসের প্রথম খসড়া শেষ হলো আজ, সকাল তখন দশটা বারো।
পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালে বাইরে উজ্জ্বল রোদ। তার মাঝে পান্ডুলিপির জন্য খরচ হয়ে যাওয়া প্রায় দুই বছরের দিকে ফিরে চাইলে মেরিন ড্রাইভের গুলির আওয়াজ, ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায় আর জর্জ ফ্লয়েডের গোঙানি; একে অন্যকে ছাড়িয়ে যেতে তারা তর্ক করে অ্যাডাম ড্রাইভার আর স্কার্লেট জোহানসনের মতোই।
আর থাকে মহামারী, কোহেনের মতো আমরাও জানি নৌকা ডুবে গেছে, সকলেই জানে ক্যাপ্টেন মিথ্যা বলেছিলো।
ভাবি, কেন লিখি? অম্লজানের অভাবে ধুঁকতে থাকা দুনিয়ায় যখন আগামী সাতদিন বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা নাই; সেখানে উপন্যাস লিখে কী হয়?
মনোযোগের দৈর্ঘ্য যখন একশো চল্লিশ ক্যারেক্টার, হ্যাশট্যাগময় প্রচারণার ইতরপনা যখন অবিরাম জন্ম দিচ্ছে প্যারাডক্সের; উপন্যাসের লেখক তো তখন ডেভিড মালুফের গল্পের সেই নিজভাষার শেষ বক্তা মানুষটার মতোই সংযোগহীন। আবার হাত বাড়ালেই যেখানে ডন ডি লিলো, জুলিয়ান বার্নেস আর কোয়েটজি; ল্যাংড়া এবং ক্যারিকেচারের মতো উপন্যাস নিয়ে সেখানে দাঁড়ানোর ঔদ্ধত্য কেউ আজও কেন দেখাবে কেউ?
উত্তর দেওয়া দুরুহ। এবং উপন্যাস যে লেখে, সে সম্ভবত প্রশ্নটাই জানে, উত্তর জানে না কখনোই। লেখা তাই নিজের কাছেই নিজের পরীক্ষা; মহারাজ বিক্রমাদিত্যর মতোই, বেতালের লাশের বদলে বেঁচে থাকার ভারকে কাঁধে ফেলে হেঁটে যাওয়া, যাত্রার শেষে থাকে কেবলই নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়ে ধূর্ত বেতালের পুনরায় আদিবিন্দুতে ফিরে যাওয়া।
‘To write is human, to edit is divine!’ বলেছিলেন ওস্তাদ স্টিফেন কিং।
মানুষী কাজের শেষে সকালের তিক্ত রোদেও তাই স্বর্গীয় এক ফুরফুরে ভাব মনে বলি, বেশ, ধরা যাক দুয়েকটা ইঁদুর এবার!
২৩ মার্চ, ২০২১
শিকাগোর সাত নয়, সরকিনের ট্রায়ালে এবার অগুনতি বাংলাদেশি। শেষ দৃশ্যে এডি রেডম্যান কিংবা টম হেইডেন উঠে দাঁড়িয়ে শল্লার পর রামু, নাসিরনগর প্রভৃতি নাম একের পর এক বলা শুরু করলে আবেগে উদ্বেলিত জনতা আরেকটু হলে তালি মেরে বসে।
তালিটা মারতে গিয়েই তবে মুশফিক ক্যাচ ফেললো? নাকি লোকের নজর সরাতে? উত্তর দেয়া মুশকিল, কোথাও সাকিব কোথায় পাপন কে বলে তা বহুদূর; বিসিবির মাঝেই স্র্বর্গ নরক, বিসিবি’ই সুরাসুর।
আরেকটু পেহনে ফিরলে কালোকে ভালো বলে আলো হলো চক্ষুশূল, তারপর এক গামলা ওটিটির মাঝে একমুঠো অলাতচক্রের ভ্যাক্সিন।
এমনিতে অগ্নিঝরা মার্চে বীর বাঙালি ভ্যাক্সিন ছাড়াই শাহেদদের ধন্যবাদ জানিয়ে গেছে, আপাতত এরা হন্য হয়ে কোভিড রুখতে মানববন্ধন করে।
রাস্তাঘাটে সমাবেশের ঘনত্ব কমানোর গুরুদায়িত্ব কমাতে তাই এগিয়ে আসে চাকুরিপ্রার্থীরা, এইচ জি ওয়েলসের টাইম মেশিনের নতুন প্লটে ভবিষ্যতে নাকি মাটির ওপরে তারাই থাকবে।
তাই বলে অবজেক্টিভের টিক দাগাতে হবে যাদের নামে, সেই লেখকদের কি দমলে চলে? চৈত্রের বিকেলে মহীনের ঘোড়াগুলি ছাড়াই এক-একজন প্রচলন করে ভিউকার্ডের ইতরামি কি টুপির শিল্প।
১৯৭১ এর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হবে না বলে পাকিস্তানে বাতিল সমাবেশ, মায়ানমারে বৌদ্ধভিক্ষুদের ওপর গুলি, কোথায় যেন অসুস্থ হয়ে কে জেলে মারা গেছে।
What’s on your mind? ; জানতে চাইছে ফেসবুক।
কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সাশা কোহেন কিংবা অ্যাবি হফম্যান, কিংবা সুহান উত্তর ছাড়েঃ Give Me A Moment, Would You, Friend? I’ve Never Been On Trial For My Thoughts Before.
০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১
করোনাকে ভয় না পেলে কী হবে, ভ্যাক্সিনকে ভয় পেতে বীর বাঙালি মোটেই পিছপা নয়। তুখোড় এই রহস্যকে ভেদ করতে গল্প নিয়ে ফেলুদা ফিরলো আবার। তবে সিজিআই’এর সুলতানকে দেখে বাঘ নয়, মনে পড়ে বাঘের মাসী।
প্রকৃত বিড়াল দেখতে হলে চট্টগ্রামে যাও, সেখানে ইন্দুর বিলাই খেলা ডিক্লার করা, নচিকেতার গানের ভোট নষ্ট হবার ভয়ে অফিস কাচারি হাট হয়ে খোলা। আইডিয়া মেরে দেবার রোগটি অবশ্য আরো পুরোনো, প্লাগারিজমের চক্কর যতই থাক, মেট্রোরেলের ঠাপ খাওয়া ক্যাম্পাসে হাঁটলেও নাকি বাতির তলায় পড়া বিদ্যাসাগরকে পেছনে ফেলা যায়।
তারও আগে মহাভারতের অ্যাডিলেড বিপর্যয়ে সকলেই খুশি, কিন্তু টিম পেইনের দুঃখী মুখ দেখে লোকে এমন ভেঙে পড়ে যে রাগ করে তামিমকে এবার তারা গালি পর্যন্ত মারে না। এরপর তাকদীরের সাথে দুই ছটাক তাণ্ডব আর জানোয়ার মেশালেই বিকাশের মতো মূহুর্তেই সমাধান।
বইমেলা হবে নাকি, সে দ্বন্দ্বে বার্নি দাদু দুই টাকার মাস্ক পরে ঘুরে বেড়ান সর্বত্র। তখন বিরক্ত হয়ে মায়ানমারের গেইম অফ থ্রোনস আর ভারতের কৃষককে মুড়ি খেতে বলে বিভূতিভূষণ পড়তে যাই তো শীতের চোটে হাত পা জমে যাবার দশা, কিন্তু এদিকে সুপর্ণার নাম্বার হারিয়ে ফেলেছি।
সোভিয়েত ইউনিয়নে যাত্রীবাহী একটি বাস নীরবে গড়িয়ে চলে। হঠাৎ সের্গেই পাভলোভিচ ফেলে দীর্ঘনিঃশ্বাস। মিসেস পাভলোভিচ সাথে সাথে হয়ে ওঠেন ক্ষিপ্ত, ‘তোমাকে বলেছি না লোকের সামনে রাজনীতি নিয়ে কোনো কথা বলবে না!’
১২ জানুয়ারি, ২০২১
টিপ বৃষ্টিতে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা এমা স্টোনের চাইতে সুন্দর আর কী আছে পৃথিবীতে?
রাতের ঢাকা শহর।
সেই ঢাকা, কবে কোন মোগল আমলে হীরালাল তবলচিকে সাথে করে লখনৌ থেকে উড়ে আসা গওহরজান বাইজী যেখানে চুড়িদার পাজামা আর ঘুঙুরের ছন্দে নাচাতো নবাববাড়ি; সেই ঢাকা, সাধকশ্রেষ্ঠ ব্রহ্মানন্দ গিরির মাথার ওপর দেবীর আদেশে উড়তে থাকা পাথর যেখানে এসে ঠাঁই পায় রমনার কালীবাড়ি প্রাঙ্গণে; সেই ঢাকা, যেখানে বুড়িগঙ্গার নিচে হারিয়ে যাওয়া কোনো চর থেকে আজও বর্ষার রাতে চিৎকার করে ডেকে ওঠে কালে জমজম নামের কামান; আজ কতকাল পরেও সেই ঢাকা শহর এইসব হালকা শীতের রাতে সোডিয়াম বাতির রিমিক্স আলোয় বহু গাড়ি এবং অগণিত কুত্তার বাচ্চা নিয়েও সুন্দর হয়ে ওঠে এমা স্টোনের চাইতে।
সেখানে এটিএমের পাহারায় নিয়োজিত এবং তোয়ালে বিছিয়ে ঘুমের অপেক্ষায় থাকা বুইড়া মামায় বুট পায়ে অকারণ হাঁটাহাঁটি করে রাত গভীর হবার আগেই নিজের কর্মদক্ষতা প্রমাণে; সেখানে ছক কাটার পরোয়া না করে স্যান্ডেল দিয়ে সীমানা টেনে ব্যাডমিন্টন খেলে সারাটা দিন ট্রাক থেকে মাল খালাস করা মাতারির পোলারা; সেখানে বুকের মাঝে শ্লেষা জড়ানো স্বরে লাইটপোস্টের নিচে বৃদ্ধা ফকিরের কোরআন পাঠ; সেখানে কয়েকদিনের পুরানো তেলেভাজার ঘ্রাণে মৌ মৌ গলির ওপরে বিদ্যুত, ইন্টারনেট আর ফোনের লাইনের মাঝে বসে ওম পোহায় অপুষ্টিতে ভোগা আকাশ।
শুধু ওই আকাশকে দেখেই মনে পড়ে, বেঁচে থাকার জন্য বার্ডম্যানকে যে ট্যাক্স দিতে হয়, তার নাম নিঃসঙ্গতা।
কতদিন কতকালের মানুষের ইতিহাস মুছে গেলো এমা স্টোনের ন্যাপকিন হতে, কিন্তু কালচে ওই আকাশ আজও অমলিন।