সুহান রিজওয়ান

লেখালেখি

হাসনাত আবদুল হাই’এর ভ্রমণ-জগত

(১)
প্রিয় ভ্রমণ-গদ্যকারের নাম ভাবতে গিয়ে বাঙালি পাঠককে প্রথমেই সবুট স্যালুট মারতে হয় সৈয়দ মুজতবা আলীকে। একদম আটপৌরে গদ্যে সুনীল গাঙ্গুলীও আমাকে নানা জায়গা ঘুরিয়ে এনেছেন অক্ষর দিয়ে, তাকেও আমি রাখবো নিজের প্রিয় ভ্রমণ-লেখকের তালিকায়। বলতে হবে, মাত্র খান দুয়েক বইয়ের মাধ্যমেই প্রিয় পর্যটক-লেখক হয়ে ওঠা রাইকার্ড কাপুচিনস্কির নামটাও।

কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করা হয় বাংলাদেশে আমার প্রিয় ভ্রমণ-গদ্যকার কে, তখন?

ভেবে দেখলে, খুব বেশি নাম বিবেচনায় উঠে আসে না। হুমায়ূন আহমেদ থেকে মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতো বহুপ্রজ লেখকেরা তো বটেই, সৈয়দ নাজমুদ্দীন হাশেম বা মুনতাসীর মামুনের মতো একটু পাশে সরে থাকা লেখকেরাও ভ্রমণ-কাহিনি পিপাসু পাঠকদের উপহার দিয়েছেন সুলিখিত কিছু বই। বিশেষ করে বলতে হবে শুধু ভ্রমণ সংক্রান্ত রচনা দিয়েই প্রায় তারকা-খ্যাতি পেয়ে যাওয়া মাঈনুস সুলতানের নাম, তার ‘কাবুলের ক্যারাভান সরাই’কে তো রীতিমতো আধুনিক ‘দেশে-বিদেশে’ বলতে হয়। একদম হালের ভ্রমণ-লেখক সঞ্জয় দে কিংবা ফাতিমা জাহানের রচনাও বেশ লাগে পড়তে। তাঁদের প্রত্যেকের রচনাই নিঃসন্দেহে দারুণ নিজস্বতা ও সৌন্দর্য্য-মণ্ডিত। তবু, নির্দ্বিধায় বলতে পারি, বাংলাদেশে আমার প্রিয় ভ্রমণ-গদ্যকার হাসনাত আবদুল হাই।

কী নামে ডাকবো একুশে ফেব্রুয়ারিকে?

একুশে ফেব্রুয়ারি এগিয়ে এলেই কয়েক বছর ধরে একটা বিষয় লক্ষ করি। ‘বিতর্ক’ বললে ব্যাপারটা খানিক ভারি হয়ে যায় অবশ্য। তার চেয়ে এভাবে বলি, যে এক ধরনের মত-দ্বৈততা বা দ্বিধা চোখে পড়ে তারিখটাকে ঘিরে। কেউ একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ দিবস/ভাষা-শহীদ দিবস’ বলেন, কেউ বলেন ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’।

সত্যি বলতে, আমাদের ছেলেবেলার স্মৃতিতে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ বলে কিছু নেই। একুশে ফেব্রুয়ারি তখনও বাঙালির নিতান্ত ঘরোয়া অনুষ্ঠান। গলির মোড়ে মাইকে আবদুল গাফফার চৌধুরীর অমর লাইনগুলো শোনা যেতো, স্থানীয় সব শহীদ মিনারে বাচ্চাদের ফুল রাখার সাথে বাজতো আলতাফ মাহমুদের সুর, সব মিলিয়ে গোটা ব্যাপারটা ছিলো তীব্র আবেগের অথচ আটপৌরে। সেই ১৯৫২-তে সরকারের আরোপ করা ১৪৪ ধারা ভেঙে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করবার দাবিতে মিছিল করা সালাম-বরকতদের ওপর গুলি চালানো আমাদের দিনটাকে করে তুলতো শোকের।

২০২৩ এর বইঃ চায়ের কাপে সাঁতার

(১)
সমসাময়িক কোনো লেখকের মাথায় ঢোকার জন্য এমনকি দুই দশক আগেও পাঠকের রাস্তা ছিলো একমুখী। একজন লেখক কী ভাবছেন কোনো বিষয়ে, কী পর্যবেক্ষণ বা মতামত তার কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে- তা জানতে পাঠকেরা তখন নির্ভর করতেন উদ্দিষ্ট লেখকের লেখা বা বক্তব্যের ওপরেই কেবল। অনলাইনের উত্থান এখন কমিয়ে দিয়েছে পাঠকের সেই বাধা। পাঠকের জন্য পত্রিকা কি বইয়ের মোড়কে পেশ করা লেখা ছাড়াও লেখকরা আছেন ব্লগে, ফেসবুকে; সেখানে তারা জায়েদ খানের রোলেক্স থেকে আবরার হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনায় অক্লেশে মতামত প্রদান করেন নিয়মিত। আর এই দ্বিতীয় ধারার টেক্সটও পাঠকের মাথায় তৈরি করতে থাকে লেখকের দ্বিতীয় একটা সত্ত্বা। সমকালের লেখক এনামুল রেজাকে পড়তে গেলে ওই দ্বিতীয় সত্ত্বা কি কিছুটা ছায়া ফেলে পাঠকের মনে?

কুটি কবিরাজের জগৎ

(১)
কুটি কবিরাজ কে?

পোশাকি পরিচয় দিতে গেলে, লোকটার নাম মীর্জা শিপিহর আলি। আয়ূর্বেদিক শাস্ত্রে পন্ডিত বাপের ছিলো কবিরাজি ব্যবসা, মাইনর পর্যন্ত পড়ে শিপিহর সেখানেই ঢুকে গেলো। তারপর কবিরাজি ব্যবসায় সাফল্য। কখনো সিলেটের করিমগঞ্জ, কখনো শিলং, কখনো বীরভূমের সীতাবাড়িতে তার চেম্বার।

কিন্তু বাংলাভাষী পাঠকদের কাছে মানুষটার জীবন যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো, তার কারণ নিশ্চিতভাবেই শিপিহরের পেশাগত জীবন নয়। লোকে বরং তার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলো ঠিক সেই মুহুর্ত থেকে, যখন দীর্ঘ বিরতির পর ‘কুটি’ ডাকনামের ওই কবিরাজ হঠাৎ চিঠি পাঠায় বন্ধু তুলুকে, আর জানায়ঃ দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর ছায়ার মতো অনুসরণ করে অবশেষে জামশেদ মুস্তফিকে কব্জায় পেয়েছে সে!

আজও অ্যালান পো

(১)
টিভি-ধারাবাহিক কিংবা সিনেমার ক্ষেত্রে ‘অমুক লেখকের রচনা অবলম্বনে’ কথাটা যখনই ব্যবহার করা হয়, সম্ভাব্য দর্শকদের মাঝে তখন একটা বাড়তি সাড়া পড়ে। নির্মাতার দিক থেকে ব্যাপারটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিজ্ঞাপণ-মার্কা প্রচার, নিঃসন্দেহে। কিন্তু দর্শক যখন শোনে যে অমুক কাজটা তমুক লেখকের রচনা অবলম্বনে, ধারণা করি, তার ভেতরে সেই তথ্য তখন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে দু’ভাবে। (ক) যখন সেই নির্দিষ্ট রচনাটা তার পড়া থাকে না, কেবল জানা থাকে নাম-ধাম-রচয়িতা বিষয়ক তথ্য; সে তখন ওই টিভি-ধারাবাহিক বা সিনেমা দেখে স্বাদ পেতে চায় মূল গল্পের। ভাব এমন থাকেঃ খুব তো নাম শুনছি, দেখি না- ওই হ্যারি পটার জিনিসটা কেমন। এবং (খ) যখন মূল গল্পটা তার পড়া থাকে, তখন সে জিনিসটা দেখতে চায় নিজের ভেতরের কল্পনার সাথে নির্মাতার কল্পনা কতটা মিলেছে- সেটা দেখার জন্য।

বোর্হেস বাংলাদেশে এসেছিলেন

আর্জেন্টাইন গল্পকার হোর্হে লুই বোর্হেসের সাথে বাংলাদেশের অন্ততঃ একটি সম্পর্কের কথা জানা ছিল আমার। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ১৯৭১ সালে যে গণহত্যা চালায় এই জনপদে, জানতাম, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর মতো আরো কিছু লেখকসহ বোর্হেস সেটার বিপক্ষে স্মারকলিপি দিয়েছিলেন আর্জেন্টিনা সরকারকে। তবে সম্প্রতি বোর্হেসের সাথে বাংলাদেশের আরো একটি সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পেয়েছি আমি। জেনেছি, পুরাতন পুঁথির খোঁজে সত্তরের দশকে বাংলাদেশে এসেছিলেন বোর্হেস।

২০২২ এর বইঃ ডি-মাইনর

(১) যখনই কোনো উপন্যাস প্রসঙ্গে বলি আমরা, অনুমিতভাবেই আমাদের মাথায় তখন ঘুরতে থাকে উপন্যাসটা পড়বার স্মৃতি। কোন জায়গাটায় সে উপন্যাস স্পর্শ করেছে আমাদের গোপন কোনো বেদনা, কোন অধ্যায়টা আমাদের নতুন কোনো ভাবনা দিলো, কিংবা কোন জায়গাটা মনে হয়েছে একেবারে গাঁজাখুরি- বলতে বা লিখতে গেলে সেইসব ভাবনাকেই আমরা উল্টেপাল্টে দেখি রুমালের মতো। সাথে, যদি লেখকের অন্যান্য লেখার সাথে পূর্বে যাত্রার অভিজ্ঞতা থাকে আমাদের- সেটাও প্রভাব ফেলে কোনো উপন্যাসকে নিয়ে বলবার সময়।

কিন্তু যখন ঔপন্যাসিকের রচনা-প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত থাকেন পাঠক?

না, পাঠক যদি হয় লেখকের পূর্বপরিচিত, আর সে যদি টের পায় যে এই লেখা নামানোর সময় ঔপন্যাসিক ভাবনার অমুক সড়কটায় পা দিয়েছেন- তখন কিন্তু উপন্যাসটাকে সে অন্য দশটা বইয়ের সাথে একত্রে মেশাতে পারে না। শিরায় মাদক ঢুকলে যেমন চেনা জগতের মাত্রা সংখ্যা বেড়ে যায় – ঠিক তেমনই নতুন একটা বোধ, একটা দৃষ্টিভঙ্গি তখন তার চোখের সামনে চশমার মতো এসে দাঁড়ায় উদ্দিষ্ট উপন্যাস পড়তে গেলে।

Page 1 of 18

Powered by WordPress & Theme by Anders Norén

error: Content is protected !!